হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে এখনও চিন্তাশীল কাজের যথেষ্ট ঘাটতি আছে । এই লেখাটি উনার মৃত্যুর পরপরই লিখিত হয়েছে। প্রকাশের সাথে সাথে সাহিত্য পরিমন্ডলে বেশ আলোচিত হয়েছে। এখানে হুমায়ূনকে যে পদ্ধতীতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে তার গভীর দিন দিন যেন আরও প্রবল ভাবে ফুটে উঠছে। লেখক যদিও এটাকে মূল থিসিসের খসড়া হিসেবে দেখছেন। ১৩ নভেম্বর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। লেখকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে এই প্রবন্ধটি পাঠকদের কাছে নিবেদন করা হল।
এই লেখাকে হুমায়ূন পাঠের ভূমিকা হিসেবে নেওয়া যায়। ভূমিকা কথাটার একটা দ্ব্যর্থবোধকতা আছে। এক অর্থে শুরু, আরেক অর্থে এর তাৎপর্য। আমরা এই দুই অর্থকে আপাতত আলাদা না করে হুমায়ূন পাঠে ফিরতে চাই।
অনেকেই আমরা হুমায়ূন পড়ি। আমার মতো অনেক তরুণ হুমায়ূন পড়ে পড়েই বড় হয়েছেন। কিন্তু সত্য হলেও একটু করুণ শোনাবে যে, এখনও পর্যন্ত আমরা হুমায়ূনের ‘পাঠ’ দাঁড় করাতে পারি নি। এখন তাহলে প্রশ্ন এসে যাচ্ছে, কোনো কিছু পড়া মানে সাধারণ অর্থে রিড করা আর ‘পাঠ’ দাঁড় করানো কি এক কথা নয়? এ দুটা যে সম্পূর্ণ ভিন্ন তা আমরা প্রায়ই খেয়ালের মধ্যে রাখি না। আমাদের উদ্দেশ্য হুমায়ূনের ‘পাঠ’ দাঁড় করানো। কথাটা ভেঙে বলা প্রয়োজন।
আমরা এতদিন হুমায়ূন নিয়ে যত আলোচনা, মতামত-মাতম ইত্যাদি দেখেছি, তাতে হুমায়ূন পাঠের দিকটা আড়ালে চলে গিয়েছে। ফলে সেইসব রেটরিক্যাল/বাচালি কথা-বার্তার বাইরে হুমায়ূনকে ‘পাঠ’ করা অতি সহজ কাজ নয় মোটেই। আরও গোড়া থেকে প্রশ্ন করা যায়, কিভাবে হুমায়ূনকে বা তার কোনো টেক্সট/রচনাকে পাঠ করতে হবে?
কোনো রচনাকে আমরা শুধু তার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যের কারণেই পাঠ করে উঠতে পারি না। অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য কথাটার মানে হলো, লেখার ধরন, বিশেষ ধরনের বাক্যপ্রকরণ, চরিত্রের বুনন, হাস্যরস, জীবনদৃষ্টি ইত্যাদি নানা কিছু। এ সবের বাইরেও আরও মেলা কিছু আছে। তাই, কেবল টেক্সচুয়াল বা কিতাবি রিডিং-এ এর পুরোটা ধরা পড়ে না। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, কোনো রচনাকে পাঠ করতে হলে রচনার অর্ন্তগত এবং কনটেকচুয়াল বা সময়ময়তা এই দুই অর্থেই তাকে খতিয়ে দেখতে হয়।
তাতেও শেষ পর্যন্ত আমরা কোন রচনা থেকে আমাদের কাজে লাগে এমন বিষয়সমূহ ঠিক ঠিক উদ্ধার করতে পারি না। এর জন্য প্রথমত একটা বিষয়ের দিকে আমাদের নজর ফেরাতে হয়। সেটা হলো সাহিত্য পাঠ করার যে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা সমাজে গড়ে ওঠে তাকে আমলে আনা। এর মধ্যে সামাজিক-রাজনৈতিক শ্রেণি সম্পর্ক ও আদর্শের প্রশ্নও চলে আসে।
আমি হুমায়ূন সম্পর্কে যেটা বলছি তা হলো, আমরা এখনও হুমায়ূনের কোনো ‘পাঠ’ দাড় করাতে পারি নি। বা হুমায়ন ‘পাঠে’র কোনো তরিকাও আমরা জানি না। ‘পাঠ’ কথাটা যদি কনটেকচুয়ালাইজেশন অর্থে বলি তাহলে দেখব, হুমায়ূন যে ইতিহাসের মধ্যে বা বিশেষভাবে বললে, যে ইতিহাসের বয়ানের মধ্যে বা প্রধান্য বিস্তারকারী যেটাকে আমরা হেজিমনিক বয়ান বলি, তার মধ্যে লেখক হিসেবে গড়ে ওঠা সেই বয়নটার কোনো বিচার আমরা করি নাই।
দুই, সাংস্কৃতিক যে ঐতিহ্য হুমায়ূনের সময়ে জারি ছিল তার নিরিখে হুমায়ূন নিয়া কোনো কথা আমরা দেখি না। এই দুটি দিক ছাড়াও আরও বিবেচনাযোগ্য দিক রয়েছে। আশা করি কনটেকচুয়ালাইজশন করা বলতে কি বুঝিয়েছি তা পরিষ্কার করতে পেরেছি। হুমায়ূন ‘পাঠ’ কথাটা এই কনটেকচুয়ালাইজ করা অর্থেই বলেছি। এটা আমাদের এখানে হয় নি। এর জন্য শুধু সাহিত্যের একাডেমিক বা অধ্যাপকীয় সমালোচনাই যথেষ্ট নয়। এর জন্য ঐতিহাসিক পর্যালোচনার রাজনৈতিক-সামাজিক বিবেচনা দরকার। সেই দিক থেকে হুমায়ূনের ভাগ্য খুব খারাপ বলতে হবে। তিনি ব্যাপক পাঠক পেয়েছেন কিন্তু তার বিশাল কাজের কোনো কনকেটচুয়াল বা পাঠ-পর্যালোচনা দাঁড়ায় নাই। চেষ্টাও দেখা যায় নাই। আমরা হুমায়ূন নিয়ে ঘুরে ফিরে মুখস্থ কিছু কথাবার্তা শুনি, এই যা।
হুমায়ূনকে ‘পাঠ’ করতে হলে এইসব দিক একইসাথে বিবেচনায় নিতে হবে। মনে হতে পারে এ আর এমন কী! কথাটা এ জন্যই জোর দিয়ে বলা দরকার। এতদিন হূমায়ন নিয়ে আমরা যে আলোচনা দেখেছি তাতে আগের দুটি বিষয় কমবেশি এসেছে। অর্থাৎ তাঁর রচনার অন্তর্নিহিত বিষয় এবং কনটেন্ট ধরে সমালোচকরা আলোচনা করেছেন। কিন্তু সেই আলোচনা দিয়ে হুমায়ূনকে বুঝবার ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। কারণ আমাদের এখানে সাহিত্য পাঠের যে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা গড়ে ওঠেছে তার মধ্যে যে গভীর কু-শিক্ষা রয়েছে সেটার কোনো হদিস আমরা রাখি নি। ফলে হুমায়ূন-পাঠের জন্য ভূমিকা প্রস্তাবনার উছিলায় এই জরুরি দিকটি সংক্ষেপে আলোচনা করতে হচ্ছে।
হুমায়ূন-পাঠে বাংলা সাহিত্যে যে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা গড়ে উঠেছে তাকে খতিয়ে দেখা হয় নি। এই প্রশ্ন না করলে হুমায়ূন পাঠ করার মূল সূত্রটিই আমরা ধরতে পারব না। ঐতিহাসিকভাবেই হূমায়ূনের পথটি এত আলাদা যে তাবৎ সাহিত্য মূল্যায়নের ট্র্যাডিশন হুমায়ূনে এসে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। আমরা এতদিন সাহিত্য মূল্যায়নের যে চর্চা জারি রেখেছি তা মূলত বঙ্গীয় রেনেসাঁ প্রভাবিত। বাবুআনার রুচি ধরে এইটা তৈরি হইছে। কিন্তু বাংলাদেশ তো সরাসরি এই রেনেসাঁ প্রকল্পের মধ্যে পড়ে না।
এই উপনেবেশ কিন্তু আবার সেকেন্ড হ্যান্ড উপনিবেশ। এটাকে বলতে পারেন সাবলেট কলোনিয়ালিজম।
এর স্বাতন্ত্র্য এত স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আমরা ঔপনিবেশিক রুচির মধ্যেই বাংলাদেশের সাহিত্য বুঝবার চেষ্টা করেছি। এই উপনেবেশ কিন্তু আবার সেকেন্ড হ্যান্ড উপনিবেশ। এটাকে বলতে পারেন সাবলেট কলোনিয়ালিজম। মানে কলকাতা পশ্চিমের রুচি মতো নিজেদের সাহিত্যরুচি তৈরি করছে। এর সাথে সংস্কৃতিজানা হিন্দুয়ানি গরিমা মিশাই দিছে। আর সেই ঠুলি দিয়া বাংলাদেশের সাহিত্য দেখা হইতেছে। নন্দনতত্ত্বের রাজনীতি নিয়ে অন্য এক লেখায় এগুলো বলেছি। আজ হুময়ূনেই থাকি। তো সেই দিক থেকে হুমায়ূন ঔপনিবেশিক সাহিত্য রুচির জন্য বিরাট হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। বিশেষ করে, আমাদের এখানে তথাকথিত ক্লাসিক সাহিত্যের যে ধারণা গড়ে উঠেছে তা পশ্চিমা এনলাইটনমেন্টের প্রভাবেই গড়ে উঠেছে। হুমায়ূন সচেতনভাবে এই প্রকল্পকে থোড়াই কেয়ার করেছেন। সেই কারণে, হুমায়ূনকে সস্তা-বাজারি লেখক বললে আর কাজ হচ্ছে না। কোথায় তাঁর লিটারেরি প্রকল্পটা, আলাদা তার হদিস না করলে আমরা হুমায়ূন বিচারে বড় ধরনের অবিচারই করে ফেলব। টীকা আকারে এতটুকুই বললাম আপাতত।
হুমায়ূন পাঠের ক্ষেত্রে আমরা যে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অবলম্বন করেছি তা আমাদের জন্য আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে। আমি হুমায়ূন নিয়ে আমাদের এখানে যে সকল আলোচনা ইতোমধ্যেই হাজির হয়েছে তার দিকে নজর রাখার চেষ্টা করেছি। এবং এ সকল আলোচনার কোনোটাই এখন পর্যন্ত হুমায়ূনের মূল শাঁসটা বা নাড়ি বা অন্তর্গত পালস্টা ধরতে পারে নাই । এ জন্য তাদের দোষারোপ করার কোনো যুক্তি নাই। কারণ হূমায়ূনপাঠের জন্য তারা যে টেক্সচুয়াল এবং কনটেক্সচুয়াল পথ অনুসরণ করেছেন তা দিয়ে তারা যথারীতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক মতামতের অবতারণা করে ফেলেছেন। কিন্তু হুমায়ূন যে তাদের এত দিনের অনুসরণীয় কনটেকচুয়ালের বাইরের লেখক তা তারা ঠিক ঠিক ঠাওরে উঠতে পারেন নি।
ফলে সাহিত্যিক আলোচনার জন্য যে ঐতিহাসিক সিলসিলা বা ভাবধারা দ্বারা এইসকল পণ্ডিতকুল তাড়িত, হুমায়ূন সেই পথ থেকে শত মাইলের দূরত্বে থাকেন। এতে করে তাকে গড় গড় করে পড়েও আমরা তাঁর ‘পাঠ’ দাঁড় করাতে পারি নাই। এইবার আমরা দেখব হুমায়ূনকে নিয়ে আমাদের সাহিত্য পাড়ায় কী কথা হয় এবং তার সাথে হুমায়ূনের ফারাক কতখানি?
ট্র্যাডিশনাল সাহিত্যের আলোচনায় হুমায়ূন সম্পর্কে অনিবার্যভাবে উচ্চারণ করা হয়, হুমায়ূন জনপ্রিয় লেখক। আরও বলা হয়, তিনি পাঠকপ্রিয় লেখক, তিনি প্রকাশনা ব্যবসায় বিপ্লব এনেছেন, তিনি পাঠক তৈরিতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন, তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যের বাজার থেকে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের একচেটিয়া প্রভাব প্রায় একাই হটিয়ে দিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। পাঠক একটু যদি খেয়াল করেন, দেখবেন, একসকল কথাবার্তার কোনোটাই হুমায়ূনকে বুঝবার ক্ষেত্রে আমাদের কোনো কাজে আসে না।
যদি তাদের প্রশ্ন করি ‘জনপ্রিয়তা’ কী? একটু ব্যাখ্যা করে বলেন তো। এই প্রশ্নের জবাবে তারা যা বলেন তা এককথায় আবোল তাবোল বকা ছাড়া আর কিছু নয়। হুমায়ূন আলোচনার জন্য তারা যেসকল প্রশ্ন বা প্রসঙ্গ সামনে আনেন তা হুমায়ূনের যে ঐতিহাসিক কনটেক্সট সেদিক থেকে খুবই গৌণ। কারণ তারা হুমায়ূনের ঐতিহাসিক পটভূমি কখনও তালাশ করবার চেষ্টা করেন নি। তাই হুমায়ূন আলোচনায় তাদের খেই হারানো ভাবটা লুকাতে তারা হুমায়ূনকে বাজারি লেখক আখ্যা দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে চান। তাকে হালকা চালের লেখক বলে সাহিত্যেও একটা ‘এলিটিজম’ খাড়া করে হুমায়ূনের ব্যাপারে পাহাড়প্রমাণ মূর্খতাকে পণ্ডিতি বলে চালিয়ে দেন। ফলে এত আবর্জনার ভেতর হুমায়ূনপাঠের একটা ধরন বের করা খুবই কষ্টকর কাজ সন্দেহ নেই।
এখন আমরা দেখব কেন হুমায়ূন-‘পাঠ’ এতদিনেও দানা বাঁধে নি।
হুমায়ূনপাঠের জন্য দুই বাংলাতেই অভিন্ন যে ডমিনেন্ট সাহিত্যরুচি দাঁড়ায় গেছে তা সবচেয়ে বড় বাধা। এই সাহিত্যরুচি মোটা দাগে ঔপনিবেশিক। ফলে আলাদা করে যেই আমরা হুমায়ূনের ‘পাঠ’ নির্মাণের দিকে আগাব, সাথে সাথে ধসে পড়বে কলোনিয়াল আধুনিক সাহিত্যরুচি।
এই কলোনিয়াল সাহিত্যরুচির জন্য হুমায়ূন বিপদ আকারে হাজির হয়েছে। তাই হুমায়ূনের বিশাল পাঠক থাকা সত্ত্বেও ক্যালকেশিয়ান এলিটি পারোকোয়াল সাহিত্যধারা হুমায়ূনকে প্রতিনিয়ত তাচ্ছিল্য করে চলেছে।
অন্যদিকে আরও কিছু বিপত্তি আছে ,তাও একটু একটু করে আলোচনা করা হবে। আমাদের এখানে কোনো লেখককে আমরা যেসব কোয়ালিটির জন্য নমস্য বিবেচনা করি হূমায়ূন সচেতনভাবে সেগুলোকে নিজের লেখা-লেখির এলাকা থেকে বিদায় করেছিলেন। যেমন, লেখায় ভীষণরকম একটা মতাদর্শ থাকতে হবে। চরিত্রগুলোকে হতে হবে খুবই আদর্শিক। ভাষা হবে ঠাস-বুনট, উপন্যাসের ক্ষেত্রে থাকতে হবে মহাকাব্যিক দ্যোতনা ইত্যাদি। এক কথায় আমাদের সাহিত্যিক রুচি ভীষণরকম ধর্মতাত্ত্বিক। (উনিশ শতকের বাঙালি রেনেসাঁই আমাদের রুচি তৈরি করেছে, এরা এসেছে সরাসরি ইউরোপের প্রোটেস্টান্ট রুচি থেকে। সেই অর্থে ধর্মতাত্ত্বিক।) ফলে হুমায়ূন সবসময়ই এখানকার তথাকথিত প্রগতিশীলতার নামে মৌলবাদী সাহিত্যিক, আলোচকদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যারা হুমায়ূনকে গালি দিতেন তারাও হুমায়ূনের নতুন বই পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। হুমায়ূন পড়তেন গোপনে আর প্রকাশ্যে করতেন গালাগালি। তাদের সাহিত্যিক এলিটিজম হুমায়ূনকে হজম করতে পারত না। কিন্তু হুমায়ূনের আকর্ষণ এড়ানোও তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। আমরা যদি এতদিন নিজের কাছে এই প্রশ্নটাও করতাম, আমি কেন হুমায়ূন পড়ি, তাহলেও হুমায়নের ব্যাপারে যে কুসংস্কার তৈরি হয়েছে তা এত পর্বতসমান হতো না। আজকে আমি ইচ্ছে করেই গভীর কোনো তত্ত্ব কথায় যাব না। জাস্ট খসড়া কিছু কথা বলতে বলতে আগাব।
আমরা যদি নিজেদের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হতে পারি তাহলে এতসব আলোচনা-সমালোচনার তোয়াক্কা না করে ঘোষণা দিতে পারতাম, আমি হুমায়ূন পড়ি এবং এই কারণেই হুমায়ূন জরুরি। এই ‘আমি’ মানে পূর্ব বঙ্গের ‘আমি’। হুমায়ূন আহমেদের সাথে এখানকার তাবৎ লেখকদের সাথে যে জায়গাটায় সবচেয়ে বড় ফারাক তাকে এক কথায় ‘আমি’র ফারাকও বলা যায়। আধুনিক বা আধুনিক-উত্তর চিন্তায় আচ্ছন্ন লেখকের কাছে ‘আমি’ মানে একক। তাদের কাছে ‘আমি’ কেবল ইনডিভিজুয়ালের আইডেন্টি মাত্র। ফলে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হুমায়ূনের সাথে এসে যেখানে মার খায় তা হলো, লেখক মাত্রই ইনডিভিজয়াল চরিত্র সৃষ্টি করেন, কিন্তু হুমায়ূনের ‘আমি’ কোনোভাবেই পশ্চিমা আধুনিকতার আছর-পড়া ইন্ডিভিজুয়াল আমি না। তার আমি হলো বাংলার চিন্তার ভেতর থেকেই উঠে আসা।
আমরা পৃথিবীতে যখন বাস করতে আসি তখন আমির সাথে যুক্ত হয় সন্তান, স্ত্রী, বন্ধু–বান্ধব, স্বজন। জন্মের আগে এবং মৃত্যুর পরে আমি বলে কিছু থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু জীবিত অবস্থায় আমি বলে কিছু নেই।
‘একে বহে অনন্ত ধারা
তুমি আমি নাম বেওয়ারা।’ —লালন ফকির
আর হুমায়ূন বলেন, ‘আমি’ আমার কিছু অপছন্দের শব্দের একটি। আমরা পৃথিবীতে যখন বাস করতে আসি তখন আমির সাথে যুক্ত হয় সন্তান, স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব, স্বজন। জন্মের আগে এবং মৃত্যুর পরে আমি বলে কিছু থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু জীবিত অবস্থায় আমি বলে কিছু নেই।’
—আমি, হুমায়ূন আহমেদ, অন্য প্রকাশ-২০১১
এটা সমষ্টির ‘আমি’ এবং সে এখনও নিজের সম্পর্কে সচেতন হয় নি। তার এখনও চৈতন্যপ্রাপ্তি ঘটে নি। বাংলার চিন্তাভূমিতে যে দার্শনিক তর্কটা অতি জরুরি, মানুষ একইসাথে বিশেষ এবং সামান্য। এই বিশেষ বা সামান্যকে ধরার জন্য আধুনিক ‘আমি’র নিরাকরণ ঘটাতে হয়। এই দিক থেকে হুমায়ূন বাংলার চিন্তামূলের সাথে সরাসরি যুক্ত।
আমরা আলোচনা করছিলাম আমাদের সাহিত্যিক রুচিটা ধর্মতাত্ত্বিক। এই ধর্মতত্ত্বের বয়ানও দাঁড়িয়েছে পরদেশি যাজকদের বয়ানের মারফতে। ফলে এর প্রতি আমরা এতদিন যে প্রশ্নহীন অবস্থানে ছিলাম তা নতুন করে আর ব্যাখ্যা করছি না। তবে হুমায়ূনপাঠের সরাসরি ফজিলত হলো এটাকে সমূলে উপড়ে ফেলার কাজটা সহজ হয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে আবার যদি শুধু সাহিত্যের ইতিহাস আকারে দেখি তাহলে সেই দেখাটাও আংশিক দেখা হবে, এর সাথে ইতিহাস নির্মাণের প্রশ্নটা সরাসরি জড়িত। আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটা ডাইরেক্ট জড়িত। এই আত্মপরিচয়ের যে অলিখিত ন্যারেশন বাংলাভূগোলে ছড়িয়ে আছে, তাকে আধুনিক সাহিত্যরুচির শাসনকে থোরাইকেয়ার করে হাজির করার যে ক্যারিশমা হুমায়ূন দেখিয়েছেন তাকে আমি বিপ্লবী প্রচেষ্টা আকারে দেখছি। এটা আবিষ্কার করার জন্য আমাদের যে ধরনের জ্ঞানগত প্রস্তুতি নিয়ে সাহিত্যের দিকে তাকানো দরকার তার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এইটা অতি আফসোসের কথা। হুমায়ূনপাঠের সময় একটু খেয়াল করে বাংলার জনগোষ্ঠির আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটা এখন মাথায় রাখলে নতুন অর্থ তৈরি হতে থাকবে। আর সাহিত্য বিচারের পুরানা অচলায়তনটাও ভাঙতে থাকবে বলে মনে হয়।
একটা বিষয় আমরা সাদা চোখেই দেখতে পারি, আমরা প্রায়ই বলতে শুনি, পশ্চিম বঙ্গের লেখকরা বড় বড় উপন্যাস লিখতে পারেন। তাদের উপন্যাসের আখ্যান হয় বহু বিস্তৃত। অন্যদিকে বাংলাদেশের লেখকরা উপন্যাস লিখতে পারেন না। পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লিখতে না পারার অভিযোগ বাংলাদেশের বড় বড় লেখকদেরও ছেড়ে যায় নি। এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি বঙ্কিমচন্দ্রের কথা। ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস নাই’ বলে বঙ্কিমচন্দ্রের যে আফেসোস তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে বাংলাদেশে যারা লেখালেখি করেন তাদের কেউ আমাদের ইতিহাস নিয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে চিন্তাভাবনা করেছেন, কোনো প্রশ্ন তুলেছেন, এমনটা দেখা যায় নি। অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্র যেই অর্থে ইতিহাসের প্রশ্ন উত্থাপনের মধ্য দিয়ে একটা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর আবির্ভাবের প্রকল্প হাজির করেছেন, বাংলাদেশের লেখকদের বেলায় এমনটা নজরে পড়ে না। কিন্তু এর মধ্যে ইতিহাসের পরিহাস আকারে যে ঘটনা ঘটে গেছে তা হলো ৭১-এর স্বাধীনতার সংগ্রাম। এর ফলে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে নিজেদের আাত্মপরিচয় নির্মাণের ঐতিহাসিক কাজ ব্যতিরেকেই আমরা একটা রাষ্ট্র কায়েম করে ফেলার যোগ্যতা অর্জন করে ফেললাম। রাষ্ট্র তো করলাম, কিন্তু এর ইতিহাসের বয়ানটা নিলাম উনিশ শতকের যে সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিকতার ন্যারেশন দাঁড়িয়েছিল তার থেকে। যে কারণে ৭১-এর ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মুক্তির প্রশ্নটি এখনও কারেন্ট ইস্যু। এখনও এর মীমাংসা হয় নি। এখনও এটা নিয়ে রক্ত ঝরছে। এটা, এখন যারা জীবনযাপন করছেন, পথ চলছেন, খুব সহজেই বুঝতেছেন। এটা নিয়ে বেশি কিছু বলার দরকার নাই। জীবনই আমাদের এই অভিজ্ঞতার স্বাদ দিতেছে।
এই ঘটনার সরাসরি প্রভাব পড়েছে হুমায়নের উপর। তার প্রথম দুইটা উপন্যাস লিখিত হয়েছে সেই উনিশ শতকী সাহিত্যের ইতিহাসের প্যরাডাইমের মধ্যেই। যার ফলে এখানকার প্রগতিশীলরা দ্রুত হুমায়ূনে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। এবং এই দুইটা লেখাকে খুব সাদরে গ্রহণ করে নিছিলেন। কিন্তু হুমায়ূনের ধারাবাহিকতার দিক থেকে এ দুটি লেখা ভীষণভাবে অ-হুমায়ূনীয়। কিন্তু প্রগতিশীলদের হাস্যকর অভিযোগ হলো, হুমায়ূন আর নন্দিত নরকেএবং শঙ্খনীল কারাগার–এর মতো লেখা আর লিখতে পারেন নি? এবং এর জন্য তারা যে পেটি লজিক হাজির করেন তা হলো, এর পরে হুমায়ূন বাজারি হয়ে গেছেন। পাঠক, আমি কসম খেয়ে বলতে পারি, হুমায়ূন যদি এই দুটি বইয়ের মতো বাকি লেখাগুলোও একইভাবে লিখতেন, তাহলে তাকে নিয়ে একটা অক্ষরও লিখতাম না।
ইতিহাসের যে ব্রেকথ্রুটা দরকার ছিল, এরপরে হুমায়ূন সেটা করলেন। মনে রাখতে হবে ওই দুইটা বই ৭১-এর সময়েই লেখা। ৭১-এর পরে আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর আমরা যে হুমায়ূনকে পেলাম সে ছিল বাংলাদেশের হুমায়ূন। আগের হুমায়ূন মোটাদাগে বাঙালি বা বঙ্গু হুমায়ূন। এই বিভাজন তো ঘটালেনই এবং প্রায় একা সেটা জারি রাখলেন। তার বঙ্কিমের মতো ঘোষণার দরকার পড়ল না।
যেহেতু বঙ্কিম যে পরাধীনতার ভিতর থেকে একটা হিন্দু জাতীয় জাগরণের চেতনা জারি করাকে কর্তব্য মনে করেছেন সেদিক থেকে হুমায়ূন স্বাধীন একটা ভূখণ্ডের লেখক হওয়াতে তাকে বঙ্কিমের মতো গোড়া/কট্টর পথ ধরতে হয় নি। তাকে পড়তে হয় নি পাল্টা মুসলিম জাতীয়তাবাদের খপ্পরেও। বলা যায়, ৭১ বা নয়া বাংলাদেশ হুমায়ূনকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
এখানে সাবধানতার ব্যাপার হলো, বঙ্কিমের সাথে হুমায়ূনের কোনো কম্পারেটিভ আলোচনা পদ্ধতিগতভাবে যায় না। কারণ হুমায়ূন সম্পূর্ণ উল্টা ধারার নায়ক। যে ধারাটা এখনও ইতিহাসের নিরিখে পাঠ করে উঠতে পারি নাই আমরা। এই লেখা সে প্রচেষ্টার একটা খসড়া বলা যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, হুমায়ূন লেখার সময় কখনও খেয়াল করতেন না তার লেখাটা আধুনিক লেখা হলো কি না? এটা ব্যাকরণসম্মত হলো কি না? পুরো ঠাস-বুনট আছে কি না? উপন্যাসের মহাকাব্যিকতা নিয়েও হুমায়ূনের মাথা ব্যথা ছিল না। হুমায়ূন শুধু আমাদের গল্পটা বলতে চেয়েছেন। এবং সেটা তিনি পেরেছেন। এই পারার মধ্য দিয়া ক্যালকেশিয়ান আধুনিক সাহিত্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। হুমাযূনের এই বিজয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিজয়ের সাথে সরাসরি জড়িত।
ফলে রাবীন্দ্রিক মহল যে হুমায়ূনকে সব সময় আন্ডারমাইন করে তা বুঝেশুনেই করে।
এখন হুমায়ূনের পাঠ যদি দাঁড়িয়ে যায় তাহলে তথাকথিত আধুনিক সাহিত্য দেওলিয়া হয়ে যাবে। এর আর কোনো ভূমিকা আমাদের সাহিত্যসমাজে থাকবে না। সেই দিক থেকে হুমায়ূন এই ধারার সরাসরি শত্রু। ফলে রাবীন্দ্রিক মহল যে হুমায়ূনকে সব সময় আন্ডারমাইন করে তা বুঝেশুনেই করে। এটা র’ একটা কালচারাল পলিটিকস বা এর সাংষ্কৃতিক রাজনৈতিক দিকও আছে। আধুনিক সাহিত্য বেশ বিপদেই আছে হুমায়ূনের বাংলায়। এবার আমরা দেখি পশ্চিম বাংলা আর বাংলাদেশের সাহিত্য বলে যে পৃথক্করণ, তার হুমায়ূনী প্রকরণটা কী। পশ্চিম বাংলা ভারত রাষ্ট্রের একটি রাজ্য। আর বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র, যার রাজধানী ঢাকা। এই বিষয়টি একটু কড়াভাবে খেয়াল রাখার নিবেদন রাখি। পশ্চিম বঙ্গের লেখক দেবেশ রায় কিছু দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বলছেন:
‘প্রশ্ন: বাংলাদেশের সাহিত্য বলে আলাদা একটা সাহিত্যসীমা চিহ্নিত করার পক্ষে আপনিও বলছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশ-রাষ্ট্র-ইতিহাস বদলে গেলে সাহিত্যও বদলে যায় কি না? গেলে সেই বদলকে আমরা কোন কোন শর্ত দিয়ে চিনব?
উত্তর: এই প্রশ্ন নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে আমি আলোড়িত আছি। এ কারণে আলোড়িত আছি যে, বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে আমার আগ্রহ ও পড়াশোনা বেড়েছে এবং আমি কতগুলো সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, যার সঙ্গে এই প্রশ্ন ভীষণভাবে জড়িত। আমি মনে করি, পশ্চিম বঙ্গ এবং বাংলাদেশের সাহিত্য দুটোই বাংলা ভাষায় লেখা হলেও এক সাহিত্য নয়। এপার-বাংলা ওপার-বাংলা বা এক বাংলা —এসব সেন্টিমেন্টাল কথা দিয়ে সাহিত্যের ইতিহাস নির্ধারণ হয় না।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পর এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের পর, অর্থাৎ সুদীর্ঘ ষাট বছরে যে ইতিহাসের মধ্য দিয়ে দুটি দেশ অগ্রসর হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্য পশ্চিম বঙ্গ থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এটাকে ভাবাবেগ দিয়ে বোঝা যাবে না।
মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় এটা স্বীকার করা যে, দুটো দেশের সাহিত্য আলাদা সাহিত্য। আমি এই তুলনার মধ্যে যেতে চাইছি না যে একই ভাষায় পৃথিবীতে কত আলাদা আলাদা সাহিত্য তৈরি হয়েছে। যাচ্ছি না এ কারণে যে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা কারণ সক্রিয় থেকেছে। সুতরাং তুলনার কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষের জীবনযাপন, সমাজের জীবনযাপন, রাজনীতি, পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক, দৈনন্দিন জীবনের রকমফের এগুলোর বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গল্প-উপন্যাসও বদলায়। কবিতার কথা বলছি না, তবে বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাস আর পশ্চিম বঙ্গের গল্প-উপন্যাস সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।’
(৩০-১১-১২, প্রথম আলো)
আমি যে কথাটা উপরে বলার চেষ্টা করেছি দেবেশ রায় বেশ জোর দিয়ে বলে দিয়েছেন। এই যে আলাদা, তাকে দেবেশ রায় যেভাবে শুধু জীবনযাপন বা সাংস্কৃতিক ভিন্নতা দিয়ে বুঝতে চাইছেন তা মনে হয় না কাজের হবে। এই আলাদা ঐতিহাসিকভাবে যেমন তেমনি ভাবাদর্শ অর্থেও। চিন্তাশীলতার বাংলাদেশীয় যে দার্শনিক অবস্থান তা পশ্চিম বঙ্গ থেকে আলাদা বলেই বাংলাদেশের সাহিত্য আলাদা। অন্যদিকে দেবেশ রায়ের কথাটা পাকাপাকিভাবে মেনে নেবার জন্য টেক্সট ধরে ধরে দেখাতে হবে কিভাবে কোন কালপর্বে বাংলাদেশের সাহিত্য আলাদা। এখানে সেই সুযোগ নাই। খেয়াল রাখতে হবে অন্য কারণগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি এতেই সন্তুষ্ট না।
পশ্চিম বঙ্গের সাহিত্য থেকে বাংলাদেশের সাহিত্যের স্বাতন্ত্র্য দিয়ে আমার কোনো কাজ নাই। আমি আরও এক কাঠি আগায় যাইতে চাই। আমি বলতে চাই, পশ্চিম বঙ্গে যা কিছু হয়েছে, হচ্ছে তা আমাদেরই সম্পদ। আমরা সেটাকে আলাদা বলে দূরে রাখতে চাই না। মানে তারা ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবের ফলে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গের মানুষের সাহিত্যকে যেভাবে অবহেলা করেছেন, আজ তা হিন্দি আর ইংরেজির দাপটে আত্মারাম খাঁচা-ছাড়া অবস্থায় আছে। আমরা তাদের অবহেলা করতে চাই না। পচা সেন্টিমেন্ট নিয়ে তাদের সাথে দূরত্ব বাড়াতে চাই না। আমাদের একটা রাষ্ট্র আছে। যেটা আমাদেরকে পশ্চিম বঙ্গ থেকে এক হাজার বছর এগিয়ে দিয়েছে। ফলে আমাদের এখন কিছুটা দায়িত্বও নিতে হবে। এই ঘোর বিপর্যয়ের দিনে পশ্চিম বঙ্গের সাথে আমরা যেন তাদের অতীত আচরণের অনুবৃত্তি থেকে বিরত থাকি এটা সতর্কতার সাখে খেয়াল রাখতে হবে।
এই ঘটনা হুমায়ূনের মধ্যে কী প্রভাব ফেলেছে সেটা একটু দেখা দরকার। হুমায়ূন লিখছেন :
ঔপন্যাসিক বিমল মিত্র এসেছেন বাংলাদেশে। উঠেছেন সোনার গাঁ হোটেলে। কৈশোরে বিমল মিত্রের বই কড়ি দিয়ে কিনলাম খাটের তলায় বসে শেষ করেছি। ক্ষণে ক্ষণে অশ্রু বিসর্জন করেছি।
এক সন্ধ্যায় বিমল মিত্রের কাছ থেকে টেলিফোন, হুমায়ূন, আসো, আমার সঙ্গে দেখা করে যাও। আমার আনন্দিত হয়ে ছুটে যাবার দরকার ছিল। তা না করে আমি বিনয়ের সাথে বললাম, আমি কারো সাথে দেখা করি না। আমি আসছি না। আপনি কিছু মনে করবেন না। আমার কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা— লেখককে চিনব তার লেখা দিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে তাকে চিনার কিছু নেই। কিন্তু সেটাই সব কথা নয়, পশ্চিম বঙ্গের লেখকের প্রতি আমার বিরাগও ছিল, তাঁরা পিঠ চাপড়ানো কথা বলতে ভালবাসেন। নিজেদের ব্রাহ্মণ ভাবেন। বাংলাদেশের লেখকদের জল–চলজাতের উপরে কিছু ভাবেন না।
(চতুরঙ্গ, সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭ কলকাতা। তবে আমি এই উদ্ধৃতি নিয়েছি মাসিক উত্তরাধিকার শ্রাবণ ১৪১৯ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ৫০ থেকে)
হুমায়ূন কিন্তু বর্জনবাদী ছিলেন না। আমরা জানি, কলকাতার প্রায় সব তথাকথিত বড় বড় লেখকদের সাথে তার যোগাযোগ ছিল। তিনি সেখানকার সেরা পত্রিকাতে উপন্যাসও লিখেছেন। কিন্তু একটি বারের জন্য তিনি দাদাগিরির কথা ভুলে যান নি। আমরা হুমায়ূনের এই দিকটি একটু বিশদভাবে হাজির করলাম এ জন্য যে, এই বিষয়টি আমাদের এখানে এখন সাহিত্যিক তর্কের একটি রেলিভেন্ট ইস্যু। যার মীমাংসা হুমায়ূন তার মতো করে সেরেছেন। এই মীমাংসার জন্য যে গোড়ার জোর দরকার তার সাথে ইতিহাসের প্রশ্নটি সরাসরি জড়িত। ফলে আমাদের এখানে এখনও অনেকে বলেন, কলকাতার লেখকরা বড় মহান আর এখানকার লেখকরা নাদান। আসলে এখনকার লেখকরা অনেক অগ্রসর, পশ্চাৎপদ তারা, যারা ইতিহাসের দুইটি ভিন্ন দিক সম্পর্কে সজাগ না থেকেই এই সব বিষয়ে তর্ক করেন। কাজে এখনও আমরা হুমায়ূনকে কিভাবে পাঠ করব তার তরিকাটাই ঠিক করে উঠতে পারি নি। হুমায়ূন পাঠের সূত্রটা একবার ধরে ফেলতে পারলে আমাদের আধুনিকতার আপদ কেটে যাবে।
আমাদের লিখিত জাতীয় ইতিহাস নাই, সত্য। কিন্তু হূমায়ূনের মধ্যে ইতিহাসের ইশারাটা আছে। ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মিত্র বাংলাকে বলেছেন উপন্যাসপ্লাবিত জনপদ। যার ইতিহাস রচনা করা সত্যিই খুব কঠিন। হুমায়ূন এই প্লাবনের মধ্যে এত বেগে ছুটে চলেছেন যে, আমরা তাকে ধরতে পারছি না। কিন্তু তাকে ছাড়া আমাদের চলবে না। কলোনিয়াল আছর কাটানোর জন্য হুমায়ূন খুব শক্তিশালী হাতিয়ার বাংলাদেশের। আগামী দিনে আমরা হুমায়ূনের দিকে আরও বেশি করে ফিরব। ফিরব নিজেদের অন্তর্গত ইতিহাসের টানেই। ফিরতে বাধ্য হব।