তালেবানের সাথে বৈঠক : শান্তি ফেরানো নাকি আমেরিকার পরাজয় এড়ানোর কৌশল

তালেবানের সাথে বৈঠক : শান্তি ফেরানো নাকি আমেরিকার পরাজয় এড়ানোর কৌশল

গতকাল ৯ নভেম্বর রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে তালেবানের সাথে বৈঠকে বসেছিলেন ১২টি দেশের সরকারি প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকগন। মস্কোর আমন্ত্রণে উক্ত বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন চীন, ইরান, পাকিস্তান, সেন্ট্রাল এশিয়ার পাঁচ দেশ যথাক্রমে— কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও তাজিকিস্তানের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিরা। আমেরিকা ও তাদের এশিয়ান মিত্র ভারত প্রথমে অংশগ্রহণ করা নিয়ে গাঁইগুঁই করলেও পরে সরকারি প্রতিনিধি না পাঠিয়ে পর্যবেক্ষক আকারে দুইজন করে সাবেক রাষ্ট্রদূত পাঠিয়েছেন। আফগানিস্তানের আশরাফ ঘানির সরকার সরকারি প্রতিনিধি না পাঠালেও তাদের জিরঘা প্রধানের নেতৃত্বে পর্যবেক্ষক পাঠিয়েছেন। মস্কো বৈঠকের আলোচনার পূর্বে একটু অতীত ইতিহাস ঝালাই করে নিই।

ওয়ার অন টেররের পূর্বে তালেবানের সরকার আফগানিস্তান শাসন করছিলেন। সেই সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন গতকালকের বৈঠকে নেতৃত্ব দেয়া মোল্লা শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানাকজাই। আবার তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়েনের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন গতকালকের মস্কো বৈঠকে উপস্থিত হওয়া পাঁচ জনের মধ্যে তিনজনই। এই তিনজন আবার যুক্তরাষ্ট্রের সেই কুখ্যাত ‘গুয়ানতানামো বের কারাগারে’ বন্দি ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনার জন্য উক্ত তিনজনসহ পাঁচ জনকে মাস ছয়েক আগে মুক্তি দেয় পেন্টাগন। যুক্তরাষ্ট্রের আফগান বিষয়ক বিশেষ দূত আফগান বংশোদ্ভূত জালমেই খলিলজাদের সাথে গত মাসে কাতারের রাজধানী দোহাতে পরপর দুই দফা বৈঠক হয়। শোনা যাচ্ছে আমেরিকার দক্ষিণ ও মধ্যএশিয়া বিষয়ক স্টেট মিনিস্টারের সাথেও দোহাতে বৈঠক হয়েছে মোল্লা শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানাকজাইয়ের সাথে। যে তালেবানকে উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠী শয়তানের প্রেতাত্মা বলে জাহির করে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আফগানিস্তানে নির্বিচারে বিমান হামলা করে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করেছে সেই তালেবানের সাথে আজ ১৬ বছর পর আলোচনা করছেন আমেরিকা। দোহা বৈঠকে আলোচনার অগ্রগতিতে পাকিস্তানে ৬ বছর ধরে বন্দি ‘মোল্লা ব্রাদার’কে পাকিস্তান আমেরিকার অনুরোধে বিনাশর্তে মুক্তি দেয়।

আশরাফ ঘানির প্রেশারে আমেরিকা তালেবানকে প্রস্তাব দিলে তালেবান মুখপাত্র জবাব দেয় – আমরা আশরাফ ঘানিকে বৈধ সরকার কিংবা আফগান প্রতিনিধি বলে মনে করিনা। আলোচনা হলে আমেরিকার সাথেই হবে সাথে আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে আমেরিকাকে বসতে হবে

 

দোহা বৈঠকে তালেবানের সাথে আমেরিকার ওয়ান টু ওয়ান আলোচনায় বড় বেজার হন আমেরিকান পাপেট আশরাফ ঘানি। আফগান সরকারের ভাষ্য তালেবানের সাথে বৈঠকে আমরা যদি অংশগ্রহণ ও মতামত দিতে না পারি তাহলে এতবছর আমেরিকার পাপের বোঝা কেন টানছি? আশরাফ ঘানির প্রেশারে আমেরিকা তালেবানকে প্রস্তাব দিলে তালেবান মুখপাত্র জবাব দেয় – আমরা আশরাফ ঘানিকে বৈধ সরকার কিংবা আফগান প্রতিনিধি বলে মনে করিনা। আলোচনা হলে আমেরিকার সাথেই হবে সাথে আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে আমেরিকাকে বসতে হবে। উল্লেখ্য, চীন-রাশিয়া-পাকিস্তানের উদ্যোগেই কিন্তু মস্কোর এই আলোচনা বৈঠক। আমেরিকা চাচ্ছে তালেবানের সাথে ওয়ান টু ওয়ান আলোচনার মাধ্যমে একটা সমঝোতার পথ বের করতে। কিন্তু তালেবান চাচ্ছে এই আলোচনায় আঞ্চলিক দেশসমূহের সম্পৃক্ততা, কারণ তালেবান মনে করে আঞ্চলিক দেশগুলোর সহযোগিতা ছাড়া এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব না।

ওয়ার অন টেররের পর থেকে গত ১৬ বছরে আমেরিকা খরচ করেছে প্রায় সাড়ে ৩ ট্রিলিয়ন ডলার! শুধুমাত্র আফগানিস্তানে খরচ করেছে ১ ট্রিলিয়ন ডলার। ১ লাখ চল্লিশ হাজার সৈন্য সামন্ত নিয়ে ১ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেও আফগানিস্তানে একটা সর্ব গ্রহনযোগ্য সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বর্তমান বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তিধর দেশটি। ২০১১ পরবর্তী আমেরিকা তাদের সৈন্য সংখ্যা ১ লক্ষ ৪০ হাজার থেকে নামিয়ে সাড়ে ১৪ হাজারে নিয়ে এসেছেন। গত ফেব্রুয়ারির বিবিসির এক রিপোর্টে জানানো হয় — আফগানিস্তানের ৬৬ ভাগ অঞ্চল তালেবানের অধিনে চলে এসেছে। তালেবান তথা হাক্কানী নেটওয়ার্কের উপর্যুপরি হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আফগান বাহিনী। গত সেপ্টেম্বর -অক্টোবরের দুইমাসে তালেবানের হামলায় কান্দাহার প্রদেশের পুলিশ প্রধান ও আমেরিকান মেজরসহ নিহত হয়েছে প্রায় ১২ শতাধিক আফগান বাহিনী। ন্যাটোর ২৯ টি দেশের প্রেশার আছে সেইফ এক্সিটের এমতাবস্থায় আমেরিকা একটা উপযুক্ত সমঝোতার সমাধান খুঁজে পেতে চান, এর মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হতে চলেছে আফগান্তিানে আসলে কোন পরাশক্তি যুদ্ধে জিততে পারে না। তাই সরাসরি পরাজয় এড়াতে এই আলোচনার উদ্যোগ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ন্যাটোর ২৯ টি দেশের প্রেশার আছে সেইফ এক্সিটের এমতাবস্থায় আমেরিকা একটা উপযুক্ত সমঝোতার সমাধান খুঁজে পেতে চান, এর মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হতে চলেছে আফগান্তিানে আসলে কোন পরাশক্তি যুদ্ধে জিততে পারে না। তাই সরাসরি পরাজয় এড়াতে এই আলোচনার উদ্যোগ

 

মস্কোর বৈঠকটি চলমান আলোচনাকে আরও সামনের দিকে নিয়ে যাবে বলে প্রতীয়মান হয়। গতকালের মস্কোর বৈঠকে তালেবানের প্রথম শর্তই ছিলো আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ও একটি গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক নির্বাচন করা নিয়ে। তালেবানের মুখপাত্র বলেন — আফগানিস্তান একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ এখানে কোনমতেই বিদেশি সেনা থাকতে পারবেন না। আর আমরা জঙ্গি নই, আমি ফ্রিডম ফাইটার, স্বদেশের জন্য আমরা লড়ে যাচ্ছি। তালেবানের দ্বিতীয় শর্ত ছিলো, তালেবানের আটক বন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে রাশিয়া ও চায়না কেন তালেবানকে মূল স্রোতে নিয়ে এসে স্বীকৃতি দিতে চায়? আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা না আসলে উত্তর আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় আইএস ও আল কায়েদার উত্থান ঘটতে পারে আমেরিকার মদদে। তারা রাশিয়ার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল চেচনিয়ায় ঢুকে রাশিয়ার স্থিতিশীলতা ও শান্তি বিনষ্ট করতে পারে। চায়নার ইন্টারেস্ট হচ্ছে বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) ড্রীম প্রজেক্টের জন্য পুরনো সিল্করোডের মূল কেন্দ্রস্থল তাজিকস্তানে যাতায়াতের সহজ মাধ্যম হচ্ছে আফগানিস্তান। আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসলে আফগানিস্তান দিয়ে মধ্য এশিয়া হয়ে পূর্ব ইউরোপ তথা বলকান অঞ্চলে বাণিজ্যিক যাতায়াতে চীনের জন্য হবে যথেষ্ট লাভজনক। ইরানের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে কাজে লাগিয়ে এ অঞ্চলে আইএসের উত্থান ঘটাবে এ আশঙ্কা আছে ইরান সরকারের তাই তারাও চায় আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক। আর আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে তালেবানকে নিয়ে আসা ছাড়া অন্যকোন অপশন নেই।

আফগানিস্তানে ভারতের বর্তমান বিনিয়োগ প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার, তালেবানের ক্রমবর্ধমান হামলায় ভারতের বিনিয়োগও হুমকির মুখে পড়েছে। ভারতও উপায়হীন অবস্থায় এ বৈঠকে উপস্থিত হতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছে। এ অঞ্চলের আঞ্চলিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে — আমেরিকা কোনমতেই চাইবেনা আফগানিস্তান ত্যাগ করতে, আমেরিকার মনোভাব হচ্ছে জিওপলিটিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ এ অঞ্চল কোনমতেই হাতছাড়া করা যাবেনা। পেন্টাগন চাচ্ছে তালেবানের সাথে ওয়ান টু ওয়ান নেগোসিয়েশন করে এর একটা হাল বের করতে, প্রয়োজনে আফগানিস্তানের ৭০ ভাগ অঞ্চলে তালেবানকে স্বায়ত্তশাসন দিয়েও আমেরিকা কাবুলে অবস্থান করতে চায়। তালেবান এ প্রস্তাবে রাজি নয়, তারা চাচ্ছে রাশিয়া-চায়না-পাকিস্তানও এ আলোচনায় যুক্ত হোক। তালেবানের চাওয়াতেই মস্কোর এই বৈঠক। এদিকে তালেবানের সাথে আলোচনার অন্তরালের মূল খেলোয়াড় পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উষ্ণ করতে চায় আমেরিকা। দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকায় বন্দি পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ৮৬ বছরের সাজাপ্রাপ্ত ড. আফিয়া সিদ্দিকীকে ফেরত দিতে চায় আমেরিকা।

আমেরিকার সৃষ্ট ওয়ার অন টেররে গত ১৬ বছরে নিহত হয়েছেন প্রায় দশ লক্ষাধিক আদম সন্তান। ইরাক-আফগানিস্তান-পাকিস্তানে আমেরিকার ফেইক যুদ্ধের বলি হয়েছেন প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মুসলমান। তারপরও মস্কো বৈঠকের ইতিবাচক দিকগুলো সামনে রেখে আফগানিস্তানে বহুল আকাঙ্খিত ও কাঙ্খিত স্থিতিশীলতা ও শান্তি ফিরে আসুক এটাই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি।