এর আগে একটি লেখা শুরু করেছিলাম ব্রিটিশ আমলের একটি কাহিনী দিয়ে। এবার আরো একটু পিছনে ফিরে যাই, অর্থাৎ মোঘল আমলে। সে সময়কার প্রতাপশালী এক সেনাপতি লোক মুখে সুন্দরবনের কথা বহুবার শুনেছেন। তো একদিন তারও মনোবাসনা জাগলো যার সৌন্দর্য্যের এত বয়ান লোক মুখে শুনেছেন সেখানে গিয়ে অবকাশ কাটিয়ে আসার। যেই ভাবনা সেই কাজ। বিশাল এক বহরসহ সেনাপতি রওনা হলেন সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে। আগেই উল্লেখ করে নেই, সমতলের আদমি হবার ফলে সমুদ্রের আচরণ বা জোয়ার ভাটা সম্পর্কে তার সামান্যতম ধারণাও ছিল না। দীর্ঘ যাত্রা শেষে সেনাপতি সুন্দরবন পৌঁছুলেন রাতের দিকে, যখন পূর্ণ জোয়ার চলছে। তিনি নাবিকদের নির্দেশ দিলেন সুবিধামতন জায়গায় নৌকাবহর ভেড়াতে। নিদ্রা শেষে ভোরের আলো ফুটলেই তিনি বের হবেন সুন্দরবনের সৌন্দর্য্য উপভোগে।
সকাল বেলায় ঘুম ভাঙ্গার পর সেনাপতির তো ভিমড়ি খাওয়ার দশা। ভোরের ভাটায় তার নৌবিহার আটকা পড়েছে। পানি বহুদুর। সাথে সাথেই সেনাপতি বলে বসলেন, জোয়ার আসার সাথে সাথে ঘরের পথে রওনা হতে, যে দেশের পানির মতলবেরই ঠিক নেই সে দেশের আদমির মন কতটা অস্থির হবে তা সহজেই অনুমেয়!
খেলার জগতে ইতিহাস টেনে আনা আমার বদভ্যাসের পরিণত হচ্ছে। কিন্তু, ক্রিকেটের মৌসুমে বিসিবি আর জাতীয় দল মিলে যে সকল ঘটনার জন্ম দেন তাতে চিত্ত স্থির রেখে সোজা ভাষায় দেখা চিত্রের বয়ান বড় কঠিন ঠেকে ইদানিং। আমি এ লেখায় আলোচনা করবো পেস বোলিং নিয়েই। প্রাসঙ্গিক ভাবে আসবে সর্বশেষ টেস্টের সুরতহাল করতে গিয়ে দেয়া প্রধান নির্বাচকের ‘অপব্যাখ্যা’ও।
পনেরোর বিশ্বকাপের পর থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশ একদিনের ক্রিকেটে কাটাচ্ছে নিজেদের সেরা সময়। এ সময়কালে ব্যাটসম্যানদের চোখে পড়ার মতন সাফল্য তো রয়েছেই সমান তালে পাল্লা দিয়েছেন বোলাররা। বিশেষ করে পেসাররা। মাঝে কিছুদিন ম্রিয়মান দেখালেও সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশের পেস আক্রমণ হয়েছে আরো ক্ষুরধার। যার পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে পরিসংখ্যানও। চলতি বছরেই ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পেসারদের ইকোনোমি এবং অ্যাভারেজ ঈর্ষনীয়। তারা পিছনে ফেলছেন, পেস বোলিংয়ে প্রতিষ্ঠিত অনেক দলকেই।
সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র টেস্টে। একই সময়কালে সবচেয়ে জঘন্য অ্যাভারেজ এবং স্ট্রাইক রেটের অধিকারি আমাদের পেস বোলাররাই! বিস্ময়করই বটে। যে বোলাররা রঙিন পোশাকের রঙ্গমঞ্চ অনায়াসে নিজেদের করে নিয়ে প্রতিপক্ষকে পর্যদস্তু করছেন নিয়মিত সে একই দলের বোলাররা সাদা পোশাকে বিবর্ণ কেন সে প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক। এতে যদি কেউ পুরো চিত্রটা না দেখে সরাসরি পেসারদের ওপর দায় চাপান তাতে তাকে দোষ দেওয়ারও জো নেই। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা আসলে কী?
একদিনের ক্রিকেটে পেসারদের সাফল্যের পিছনে রয়েছে অধিনায়ক মাশরাফি মুর্তজার মূখ্য অবদান। তিন পেসার নিয়ে খেলার নীতিতে ফলাফল যাই আসুক সামান্যও টলেননি তিনি। আপনি সর্বশেষ সিরিজেই বাজিমাত করা সাইফউদ্দিনের দিকেই দেখুন। আফ্রিকা সফরে বেধড়ক পিটুনি খেলেও তার ওপর ভরসা রাখার ক্ষেত্রে পিঠ দেখাননি মাশরাফি। ভরসা রেখে গিয়েছেন রুবেল এবং মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেরা মোস্তাফিজের ওপরও। যার ফলে, পেসাররা খারাপ করলেও যখন দেখেছেন অধিনায়ক স্থির বিশ্বাস রাখছেন তাদের ওপর তারাও সর্বোচ্চটুকু নিংড়ে দিয়েছেন। ফলাফল তো আগেই ব্যাখ্যা করেছি।
তিন পেসারই না, এই সময়কালে চারজন বিশেষজ্ঞ পেসার নিয়েও খেলতে দেখা গিয়েছে বাংলাদেশকে। যাতে ভড়কে ভারত সিরিজই হেরে বসেছিল। আপনি যদি কারো কাছ থেকে ফল প্রত্যাশা করেন, তাহলে তার ওপর আস্থা তো রাখতে হবে। সুযোগ দিতে হবে নিজেকে প্রমাণ করার। মাশরাফির ভূমিকার কারণেই বাংলাদেশের পেস আক্রমণ এখন একদিনের ক্রিকেটে সমীহ আদায়ে সক্ষম হচ্ছে সাফল্যের সাথে। স্লগ ওভারে রুবেল অতীতে খারাপ করলেও তার ওপর আস্থা না হারানোর প্রতিদান ইদানিং তিনি দিতে শুরু করেছেন। সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে, আমাদের পেসারদের মান রয়েছে।
টেস্টে আসলেই চিত্রটা ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে কেন? হ্যা, অধিনায়ক হিসাবে একজন মাশরাফি নেই, কিন্তু থিঙ্ক ট্যাঙ্কের বাকি সব মুখগুলো তো একই। বাঙালির মনের অস্থির চিত্রের মাঝে মাশরাফি এক ব্যতিক্রম বলা যায়, নতুবা অবস্থা বিবেচনায় বলা যায় বাকি সবাই সেই জোয়ার-ভাটার মতনই অস্থিরতায় ভুগছেন। যার প্রভাব পড়ছে খেলার মাঠে।
চলতি বছর কয়টা টেস্টে বাংলাদেশের পেসাররা নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণের সুযোগ পেয়েছেন? কয়জন পেসারই বা ধারাবাহিকভাবে পাঁচ-দশটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন? সুযোগই যদি দেয়া না হয়, তাহলে একজন পেসার শিখবে কিভাবে? টেস্টের প্রত্যেকটি সেশনই আলাদা। আপনি যদি অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগই না দেন, তাহলে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেয়ার অভ্যাসটাই বা গড়ে উঠবে কিভাবে? সর্বশেষ টেস্টে রাহী ছিলেন একমাত্র পেসার। দুই ইনিংস মিলিয়ে যদি এক উইকেট পাওয়ার পাপে তাকে পরের টেস্টেই বাদ দেয়া হয় অবাক হবার কিছুই থাকবে না। আশ্চর্য বিষয় আঠারো বছর পরেও আমাদের দলে ত্রিশটা টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন পেসার নেই!
এখানে টেস্ট অধিনায়কের ভূমিকাও প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসে। মাশরাফি যদি স্থিরভাবে জানিয়ে দিতে পারেন যে তিনি তিন পেসার ফর্মুলা থেকে বের হবেন না, টেস্ট অধিনায়করা কেন পারছেন না?
এদিকে আবার, সরাসরি অধিনায়ককে অভিযুক্ত করারও বিপদ রয়েছে। আফ্রিকা সফরে পেসারদের লাল বলে উন্নতির তাগিদ দিতে গিয়ে মুশফিক হারিয়েছেন অধিনায়কত্বই। বিপদ সবদিকেই।
অথচ, বাংলাদেশের বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশ নিয়মিত বলছেন টেস্টে পেসারদের আরো বেশি সুযোগ দিতে এবং তাদের ওপর আস্থা রাখতে। কিন্তু, আমাদের নির্বাচকদের মন জোয়ার ভাটার মতই অস্থির। আজ শহীদে তারা সমাধান খুঁজে পান তো দুই ম্যাচ পরেই মনে হয়, শহীদ না রুবেলই বেহতার। বেহতার বেচারা ব্রাত্য হয়ে যান দু ম্যাচ পরেই। স্পিনাররা ভালো করছেন সত্য, কিন্তু পেসাররা পারছেন না, সেটি বলার আগে দুবার ভাবা উচিত। পারার মত যথেষ্ট সুযোগ কি তাদের দেয়া হচ্ছে? স্কোয়াডে থাকলেও একটি ম্যাচে কয় ওভার বোলিং এর সুযোগ পান পেসাররা? মাঝে মধ্যে তো মনে হয়, একাদশ পূর্ণ করার মধ্যেই দায় শেষ তাদের!
দেখুন ক্রিকেটে স্কিলের পাশাপাশি মানসিকতাও সমান গুরুত্ব রাখে। একজন পেসারের মনে যখন এইটা কাজ করে যে, পরের টেস্ট তিনি খেলতে পারবেন কি না, বা দলে তো রয়েছেন ঠিকই কত ওভার বোলিংয়ের সুযোগ পাবেন? তাতে উইকেট না পেলে তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হবে কি না, এমন অবস্থায় একজনের কাছে নৈপুণ্য দাবি করাটাও অন্যায্য।
এখানে, এই আলোচনায় আরো একটি বিষয় পরিষ্কার, আমাদের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক একটি দল কি করে গড়ে তুলতে হয় সেটিই এখনো শিখে উঠতে পারেননি। আমি হলফ করে বলতে পারি, মাশরাফির মত ব্যক্তিত্ববান একজনকে সরিয়ে একদিনের ক্রিকেটে নতুন একজন অধিনায়ক আনুন, অচিরেই খাবি খেতে শুরু করবে বাংলাদেশ। এখানে আরো একটি বিষয় পরিষ্কার করি, আমি মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ বা সাকিবের ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। আপনি যদি বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়মিত অনুসরণ করে থাকেন তাহলে এইটুকু খেয়াল থাকার কথা যে এই ত্রয়ী বাংলাদেশের বহু সাফল্য এনে দিলেও সামান্য পান থেকে চুন খসলেই বোর্ডের একটি অংশ তৎপর হয়ে উঠে তাদের ছেটে ফেলতে। মাহমুদুল্লাহ তো একদফা বাদই পড়েছিলেন দল থেকে।
এখন এখানে যদি আপনি অধিনায়ক হিসাবে মাশরাফির সাফল্যকে সামনে আনতে যান তাহলেও বিপদ অপেক্ষামান। কেননা, একদিনের পাশাপাশি টিটোয়েন্টি দলটিকে যখন গুছিয়ে এনেছেন প্রায় তখনই বোর্ডের চাপে অবসরে যেতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। সুতরাং, সফল হলেও যে আপনি প্রভাবক হিসাবে কাজ করবেন এই নিশ্চয়তা নেই। তারপরও মাশরাফি ঝুঁকি নিচ্ছেন কারণ তিনি ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে। যেটি মুশফিক বা সাকিব পারেননি। মাহমুদুল্লাহ যেহেতু ঠেকা কাজ চালান তাই, তার বিষয়ে কিছু বলছি না।
এবার একটু নজর দেই নাটের গুরুক দিকে। যার বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদে একাট্টা হয়েছিল এই দেশের গণমাধ্যম। সেই মিনহাজুল আবেদিন নান্নু সিলেট টেস্ট শেষে বলেছেন এটিই বর্তমানে বাংলাদেশের সেরা দল! শান্ত নিয়মিত রান পাচ্ছে ঘরোয়া লিগে, আরিফুলও ঠিক আগের ম্যাচেই ডাবল মেরেছেন। দুটোই নিরেট সত্য। কিন্তু তাদের চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে যে আদমিটি গত দুই বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের নহর বইয়ে দিচ্ছেন তার নাম ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করেননি। অতএব, যা বোঝা গেল, একটি ইনিংসে ডাবল মেরেই আপনি সফল হতে পারেন কিন্তু সেটি যদি নিয়মিত করেন তবে তা পাপের পর্যায়েই পরবে।
এই আদমি হচ্ছে নির্বাচক কমিটির প্রধান! প্রধানেরই যখন এই হাল তখন বাকি অবস্থা কতটা বেহাল না বললেও বোধ করি কারো বুঝে নিতে সমস্যা হবে না। আমরা এখনো না বুঝলেও কয়েশ বছর আগে মোঘল সেনাপতি ঠিকই বুঝেছিলেন। এ আদমি নিকট ভবিষ্যতেও যে অনুধাবন করবেন এই আশা আমি অন্তত করি না। বরং, অপেক্ষায় রয়েছি কতটা অমানিশা গ্রাস করলে এই রাহুর গ্রাস থেকে আমরা মুক্তি পাব সেই অপেক্ষায়। কেননা, প্রধান নির্বাচকের সেরা দলই যখন পাঁচদিন মাঠে কাটাতে পারে না জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তখন প্রতিপক্ষ বড় কোনো নাম হলে যে হালত কি হবে খোদা মালুম!