চুরুলিয়া এক ঐতিহ্যশালী জনপদ। হিন্দু শাসক রাজা নরোত্তম সিংহের রাজধানী ছিল চুরুলিয়া। এই গ্রামের উত্তরে প্রবাহিত অজয় নদী। ভাগীরথী অতিক্রম করে এবং ইন্দ্রাণী-কন্টকনগর-উজানী স্পর্শ করে শত-শত বাণিজ্যতরী অজয়ের বুক বেয়ে যাতায়াত করত এই গ্রামে। শিল্প-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হওয়ার জন্য মারাঠা বর্গীদের বারংবার আক্রমণে কিছুটা বিনষ্ট হয়েছিল চুরুলিয়ার নাগরিক রুপশ্রী। এক সংবর্ধনা সভায় কাজী নজরুল বলেছিলেন, “আমি অজয়ের কবি।”
চুরুলিয়া গ্রামের নামকরণ নিয়ে মতভেদ বিদ্যমান। প্রবীণ বাসিন্দাদের মতে, চার আউলিয়া থেকে চুরুলিয়া। এই চার আউলিয়া অর্থাৎ পীরদের মধ্যে দু’জন স্বীকৃত- পীর হাজী পাহলোয়ান সাহেব এবং দাতাসাহেব। পীর পাহলোয়ান সাহেব ছিলেন কাজী পরিবারের একজন পূর্বপুরুষ। পীরসাহেবের মাজার চুরুলিয়ার এক দর্শনীয় স্থান। বর্তমানে জরাজীর্ণ এই মাজারের সংস্কারকার্য হয় না পীরসাহেবের নির্দেশ মোতাবেক। এই মাজার পীরপুকুর নামের এক জলাশয়ের তীরে অবস্থিত। কথিত, পীর পাহলোয়ান সাহেব নিজে এই পুকুর খনন করেছিলেন, তাই এমনতর নামকরণ। মাজারের সন্নিকটে এক প্রাচীন মসজিদও আছে। এই মসজিদের প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।
রাজা নরোত্তম সিংহের শাসনকালে পীর পাহলোয়ান সাহেব নাকি চুরুলিয়ায় ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। ঘটনাক্রমে রাজা নরোত্তম সিংহের সঙ্গে পীরসাহেবের কোনও বিষয়ে বাদানুবাদের ফলে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে প্রচুর মানুষ হতাহত হয়েছিল এবং ঘটনাস্থলে অগণিত কাটা মুণ্ড পড়ে ছিল। এই কারণে সেই বিস্তৃত ময়দান বর্তমানে মুড়মালা বা মুণ্ডমালা নামে পরিচিত। এই সংঘর্ষে পরাজিত হয়ে রাজা নরোত্তম সিংহ চুরুলিয়া ছেড়ে পলায়ন করেন এবং পরবর্তীকালে তার কোনও খবর পাওয়া যায়নি। চুরুলিয়ায় রাজার দুর্গটি আগুন লেগে ভস্মীভূত হয়ে যায়। ভগ্ন এই দুর্গ চুরুলিয়ার ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে। এই ভগ্নদুর্গ, পীরপুকুর, মাজার-দরগায় ছোট্ট ছোট্ট পায়ে খেলা করত নজরুল। রানিগঞ্জ সিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে পাঠরত বালক নজরুল এই দুর্গ নিয়ে ‘রাজার গড়’ নামে কবিতা লিখেছিল। এই কবিতা বাল্যবন্ধু শৈলজানন্দের উৎসাহে ‘ভগ্নস্তুপ’ নামে প্রকাশিত হয় আসানসোল থেকে প্রকাশিত ‘পল্লীশ্রী’ পত্রিকায়।
কাজী পরিবারের প্রথম পুরুষ হিসাবে যাঁর নাম পাওয়া যায় তিনি বাগদাদ শহরের নাগরিক ছিলেন। সুফী সৈয়দ মহম্মদ ইসলাম নামের ওই ব্যক্তি ভারতবর্ষে এসে প্রথমে পাটনার হাজিপুরে, অতঃপর শরিফাবাদে এবং সর্বশেষে চুরুলিয়ায় বাস করতেন। তাঁর চুরুলিয়ায় বসবাসকালে দিল্লির নবাব ছিলেন কুতুবুদ্দিন।
কাজী বংশের পরবর্তী পুরুষ হজরত কাজী গোলাম নক্সবন্দ। বিদ্যাবত্তায় পান্ডিত্য ও সৎকর্মের জন্য তিনি বাদশাহ শাহজাহান কর্তৃক প্রচুর ভূ-সম্পত্তি ইনাম অর্থাৎ উপহারস্বরূপ পেয়েছিলেন। তিনি ওই সম্পত্তি বিনা খাজনায় নিতে অসম্মত হওয়ায় নামমাত্র খাজনা ধার্য হয়ে তা আয়মা তালুকে পরিণত হয়। বর্ধমান কালেক্টরির বর্তমান ১৩৭২ এবং ১৩৭৩ নম্বর তৌজি উক্ত আয়মা সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল। উল্লেখ্য, বাদশাহ জাহাঙ্গীরের আমল থেকে আয়মা তালুক প্রথা প্রচলিত হয়।
নক্সবন্দ সাহেবের পরবর্তী নাম পাওয়া যায় মওলানা কাজী খেবরাতুল্লাহ। কাজী পরিবারের দলিল-দস্তাবেজে তাঁর নামের উল্লেখ আছে। বাদশাহ প্রদত্ত অধিকাংশ আয়মা সম্পত্তি স্বত্ব দখল থাকার ফলে এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন তিনি। আরবি-ফারসি-উর্দু ভাষায় তার পাণ্ডিত্য ছিল। চার পুত্রের পিতা ছিলেন তিনি। কাজী গোলাম হোসেন ছিল জ্যেষ্ঠ পুত্র। গোলাম হোসেনের দুই পুত্র কাজী আমিনুল্লাহ এবং কাজী নজিবুল্লাহ। চুরুলিয়ায় বাস করতেন আমিনুল্লাহ। সম্পত্তি তত্ত্বাবধান করতেন তিনি। নজিবুল্লাহ বিহারের চাইবাসায় পূলিশের দারোগা ছিলেন। আমিনুল্লাহর একমাত্র পুত্র কাজী ফকির আহমেদ (জন্ম: আনুমানিক ১২৫৪ বঙ্গাব্দ)। অল্প বয়সে পিতৃবিয়োগ হওয়ায় ফকির আহমেদ শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে পিতৃব্যের সঙ্গে চাইবাসায় যান। কয়েক বছরের মধ্যে পিতৃব্য প্রয়াত হওয়ার ফলে চুরুলিয়া ফিরে আসেন; লেখাপড়ায় ইতি টানতে হয়।
কাজী ফকির আহমেদ যুবা বয়সে স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ ছিলেন। পিতার ওয়ারিশ সূত্রে তিনি প্রায় চল্লিশ বিঘা জমি পেয়েছিলেন। কিন্তু, সাংসারিক জ্ঞানহীনতা ও পাশা খেলায় আসক্তির কারণে সমস্ত জমি হাতছাড়া হয়েছিল। মহানন্দ আশ নামক এক বণিক পাশা খেলায় তার কাছে জিতে নিয়ে প্রচুর সম্পত্তি হস্তগত করেছিল। বার্ধক্যকালে বসতবাড়ি ব্যতীত কিছু ছিল না তার। শেষ জীবনে মাজারে খাদেমগিরি ও মসজিদে ইমামতি করে সংসার নির্বাহ করতেন। অতীব সুন্দর হস্তাক্ষর ছিল তার, দলিল-দস্তাবেজ লিখেও আয় হত। উচ্চাঙ্গের মিলাদ পাঠে সুনাম থাকায় ভক্তদের বাড়িতে মিলাদ শরীফ পড়ার ডাক আসত মাঝেমধ্যে। এই অমায়িক মানুষটি ষাট বছর বয়সে ১৩১৪ বঙ্গাব্দের ৭ চৈত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কাজী ফকির আহমেদের প্রথম স্ত্রী কাজী সৈয়দা বিবি। তার গর্ভে একমাত্র সন্ততি কাজী সাজেদা খাতুন। সৈয়দা বিবির অকালমৃত্যুর পর ফকির আহমেদের দ্বিতীয় বিবাহ জাহেদা বিবির সঙ্গে। ভূড়ি গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা ছিলেন তিনি। তার গর্ভে তিন পুত্র কাজী সাহেবজান, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আলি হোসেন এবং একমাত্র কন্যা উম্মে কুলসুম।
দারিদ্রদীর্ণ পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র হওয়ায় রুটিরুজির জন্য রানিগঞ্জের কয়লাখনিতে কাজ নেন সাহেবজান। তিনিও দলিল-দস্তাবেজ লিখতে পারতেন। সাওতালি সংগীতের অনুকরণে ঝুমুর গান রচনায় তিনি পারদর্শী ছিলেন। দীর্ঘদিন কয়লাখনিতে কাজ করার ফলে রোগভোগে পঞ্চাশ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
কাজী পাড়ার মক্তবে শিক্ষালাভ করেন কাজী আলি হোসেন। দলিল লেখার কাজ তিনিও করতেন। আইন-আদালত বিষয়ে তিনি জ্ঞানার্জন করেছিলেন। কয়েক বছর তিনি ব্যবসা করেন। সেই সূত্রে এলাকার কৃষক-শ্রমিক তথা মজদুর মানুষদের নিকট মসীহা হয়ে ওঠেন তিনি। তাই জমিদার-জোতদারদের রোষে পড়ে তাকে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হতে হয়। তারিখটা ছিল ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতেই হয়, কিছু ‘ভুঁইফোড়’ তথাকথিত লেখক কাজী পরিবারের চিত্রায়ন করেছেন যে, নজরুল জন্মেছিলেন অশিক্ষিত পরিবারে এবং তিনিও অশিক্ষিত ছিলেন। তাহলে রবীন্দ্রনাথ? তিনিও তো সম্পূর্ণ করেননি প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা। ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে তিনি কিছুদিন করে পড়াশোনা করেছিলেন। তিনিও অশিক্ষিত? তর্কাতীতভাবে না।
পরাধীন ভারতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাপক হারে প্রসারলাভ করেনি। তাই বৃহত্তর জনসমাজ বিদ্যালয়-শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে অসমর্থ হত মূলত দারিদ্র্যের কারণে। কাজী পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু, অনস্বীকার্য যে এই কাজী পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন বেশ কিছু প্রতিভাবান ব্যক্তি। মওলানা কাজী খেবরাতুল্লাহ, কাজী বজলে করিম-সহ কাজী পরিবারের কতিপয় ব্যক্তির অন্যান্য ভাষায় পান্ডিত্য নজরুল-গবেষকগণ প্রমাণ করেছেন। কাজী ফকির আহমেদ তথা নজরুলের ভ্রাতাগণ কোনও নিরিখে অশিক্ষিত ছিলেন না।
কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বিশ্বপাঠশালার ছাত্র। চার-দেওয়ালের সীমায়িত শিক্ষায় তাঁরা অনাগ্রহী হবেনই। তাই বলে তাদের অশিক্ষিত বলে দেগে দেওয়া নেহাত মূর্খামি ছাড়া কিছু নয়। কাজী পরিবারকে কালিমালিপ্ত করতে ওই ভুঁইফোড় লেখকেরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই ধরনের গাঁজাখুরি গল্প ফেঁদে থাকেন।
কৃতজ্ঞতা : সুবর্ণ কাজী