ঢাকা লিট ফেস্ট : সাহিত্যের মঞ্চ নাকি মঞ্চের সাহিত্য

ঢাকা লিট ফেস্ট : সাহিত্যের মঞ্চ নাকি মঞ্চের সাহিত্য

“বস্তুত বহিঃপ্রকৃতি এবং মানবচরিত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অনুক্ষণ যে আকার ধারণ করিতেছে, যে সংগীত ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে, ভাষায় রচিত সেই চিত্রই এবং গানই সাহিত্য।”  -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

উদ্ভিদের দুই শ্রেণি, ওষধি আর বনস্পতি। ওষধি ক্ষণকালের ফসল ফলাতে ফলাতে ক্ষণে জন্মায়, ক্ষণে মরে। বনস্পতির আয়ু দীর্ঘ, তার দেহ বিচিত্র রূপে আকৃতিবান, শাখায়িত তার বিস্তার। ভাষার ক্ষেত্রেও প্রকাশ দুই শ্রেণির। একটাতে প্রতিদিনের প্রয়োজন সিদ্ধ হতে হতে তা লুপ্ত হয়ে যায়; ক্ষণিক ব্যবহারের সংবাদবহনে তার সমাপ্তি। আর-একটাতে প্রকাশের পরিণাম তার নিজের মধ্যেই। সে দৈনিক আশুপ্রয়োজনের ক্ষুদ্র সীমায় নিঃশেষিত হতে হতে মিলিয়ে যায় না। সে শাল-তমালেরই মতো; তার কাছ থেকে দ্রুত ফসল ফলিয়ে নিয়ে তাকে বরখাস্ত করা হয় না। অর্থাৎ, বিচিত্র ফুলে ফলে পল্লবে শাখায় কাণ্ডে, ভাবের এবং রূপের সমবায়ে, সমগ্রতায় সে আপনার অস্তিত্বেরই চরম গৌরব ঘোষণা করতে থাকে স্থায়ী কালের বৃহৎ ক্ষেত্রে। এ’কেই আমরা ব’লে থাকি সাহিত্য।

সাহিত্য’ শব্দটি ‘সহিত’ থেকে উদ্ভূত। সাহিত্য বলতে সঙ্গ, সাহচর্য বা মিলনকে বুঝায়। মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক চিন্তার সম্মিলনে সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। সাহিত্য হচ্ছে একই সাথে মানুষের জ্ঞানের ভিত্তি এবং অভিজ্ঞতার সমন্বয়। আরো বিশদভাবে সাহিত্য হচ্ছে মানুষের সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তির বহিঃপ্রকাশ। কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস প্রভৃতিকে একেকটি সাহিত্যরূপ বলে বিবেচনা করা হয়। যারা এসব সাহিত্যকর্ম সম্পাদন করেন তাদেরকে বলা হয় সাহিত্যিক। এই মিলন, এই সঙ্গ, এই সংসর্গ কার সাথে কার? কোন সময়ের সাথে কোন সময়ের? এর স্থানই বা কোথায়?

এর সহজ উত্তর হিসেবে আমরা বলতে পারি, ‘এই মিলন মানুষের সাথে মানুষের’। চলতি কালের সাথে চলতি কালের, বিগত কালের সাথে এই কালের এবং কখনো বর্তমানের সাথে ভবিষ্যতের। এর স্থান ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের মন।

এখন প্রশ্ন কিসের মাধ্যমে ঘটে এই মিলন? কে বা ঘটায় তা?এই মিলন ঘটে অজস্র ঘটনার ঘনঘটার মধ্য দিয়ে । যে ঘটনা ঘটে যা ঘটছে বা ঘটা সম্ভব, অথবা যা কিছু ঘটতে পারে আমাদের বোধের সীমানার ভিতর তার মাধ্যমে ঘটে এই মিলন। ঘটনার ঘনঘটাগুলো দলে দলে এসে মেঘের মতো জড়ো হয় যে কোন সাহিত্য অন্দরে। পরে সেই ঘটনার মেঘ ঘনীভূত হয়ে বর্ষণ করে অনুভবের বৃষ্টি বিন্দু বারি। কোন ঘটনার অংশ না হয়েও অংশীদার হতে পারে মানুষ তার চির ‘কল্পনাপ্রবণতা’র দ্বারা। সাহিত্যিকেরা যেমন কল্পণাপ্রবণ সাহিত্যের পাঠকেরাও তেমনি। কল্পনার এই অংশীদারিত্বই লেখক ও পাঠককে এক সূতোয় বাঁধে। বিশেষ ঘটনাটা তাই কোথাও কোন কালে না ঘটলেও সংঘটিত হয় তা আমাদের মনে।

মানুষের অনুভব অদৃশ্য, অশ্রুত। তা স্পর্শের অতীত, অতীত ঘ্রাণেরও। তাকে অনুমান করতে পারে না কোন চোখ, বরণ করতে পারেনা কোন কান বা নাক অথবা কোন সংস্পর্শ। কেবল অনুধাবন করা যায় তাকে মেধায় ও মননে। সাহিত্য হলো সেই শক্তি যা নিজ নিজ জীবনের বাইরেও অসংখ্য জীবনকে ঘটনা, গল্প বা বক্তব্যের মাধ্যমে অনুধাবন করাতে পারে আমাদের। সাহিত্য তার অপূর্ব শক্তি দিয়ে আমাদেরকে অত্যন্ত সহজে পৌঁছে দিতে পারে আমাদের দূর যেকোন সময়ের যেকোন স্থানের মানুষের ভুবনে। তাদের সুখ-দুঃখের বর্ণনার মধ্য দিয়ে দোলাতে পারে আমাদের হৃদয়। পাঠক যখন পড়ছেন কোন সাহিত্য তখন তিনি তার অনুভবের নৌকায় ভেসে চলছেন সাহিত্যেকের সৃষ্ট জীবন-সাগরের স্রোতে। সেই সাগর পাড়ি দিতে তিনি অক্লান্ত, এবং অনেক সময়ই, আনন্দিত।  যখন তিনি সেই পথে ভেসে চলেন তখন তিনি একাত্মতা অনুভব করেন। বিশেষ ঐ সাহিত্যকর্মটির পাত্র-পাত্রীর সাথে, কখনো হয়ত সেসব পাত্র-পাত্রীরা অতীতে ছিলেন।

সাহিত্য আমাদেরকে প্রথমত আক্রান্ত করে অনুভবে। পরে তা আমাদের চেতনাকে নিয়ে যায় জীবনের পথে। আর আমাদের চেতনা নিয়ে সাহিত্যের কাজটি এক ধরনের মানবিক কর্ম। সাহিত্য তাই সব মানুষের জন্য নির্মাণ করে মানবিকতার মহান সৌধে পৌছানের এক উন্মুক্ত দুয়ার।

 

অর্থাৎ, সাহিত্য আমাদেরকে প্রথমত আক্রান্ত করে অনুভবে। পরে তা আমাদের চেতনাকে নিয়ে যায় জীবনের পথে। আর আমাদের চেতনা নিয়ে সাহিত্যের কাজটি এক ধরনের মানবিক কর্ম। সাহিত্য তাই সব মানুষের জন্য নির্মাণ করে মানবিকতার মহান সৌধে পৌছানের এক উন্মুক্ত দুয়ার। তবে ব্যাপারটা সবসময় যে মানুষকে মানবিকতার পথে আন্দোলিত করে এমন নয়। পরোক্ষ উদ্দেশ্য যাই হোক প্রত্যক্ষ ও সরাসরি অনুভবের সংক্রমণ ঘটানোও হয়ে উঠতে পারে সাহিত্যের মুখ্য উদ্দেশ্য। যে কোন মহৎ সাহিত্য আমাদের অনুভবের মহাবিশ্বকে কেবল আন্দোলিতই করেনা, তা আমাদের মানব-বিশ্বাস ও মানব-আচারকে শিহরিত করে। আমাদেরকে জানায় যে মানব জীবনের ঘটনা রাশির সব কিছুতে যেমন আমাদের হাত নেই তেমনি অনুভবের দুনিয়াটাও আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সেখান থেকে বুঝি জীবনের এক অভাবনীয় দর্শন। সাহিত্যিক হয়েও তিনি হয়ে ওঠেন শিক্ষক। তার কাজ হয়ে ওঠে মানব জাতির চিরকালীন সম্পদ।

মানব-প্রাণ আর সব প্রাণের মতো নিজেকে প্রকাশ করতে চায় প্রতি নিমেষে। কিন্তু তার নিজের কি আছে যা সে প্রকাশ করবে? সে প্রকাশ করতে চায় অপ্রকাশিতকে, মূর্ত করতে চায় বিমূর্তকে। অর্থাৎ, যত কিছু মানুষ প্রকাশ করে তার সবই এক সময় ছিলো অপ্রকাশিত। অপ্রকাশিতকে প্রকাশ করার এই আয়োজনে অংশ নিয়েছে মানব ভাষা। শিল্পকলা। ভাষা কেবল অপ্রকাশিতকে প্রকাশ করেনা, তা প্রকাশ করা সম্ভব এমন বিষয় বা ঘটনাকে সহজে প্রকাশ করে ও পৌঁছে দেয় মানুষের চেতনায়। ভাষা তাই সাহিত্যের শরীর। তার মাঝে প্রাণ সঞ্চার করে পাঠকের কল্পনা। যে কোনো সাহিত্য কর্মকে তাই ব্যাখ্যা করা যায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। একই সাহিত্য পাঠ করে বিভিন্ন পাঠক তাই অর্জন করেন বিভিন্ন অনুভূতি। সাহিত্য তাই লেখক ও পাঠকের যৌথ প্রয়াস; তাকে স্রেফ লেখকের ভূবন ভাবার কোন সুযোগ নেই।

২.

এই গ্লোবালাইজেশন এর যুগে লেখক আর পাঠককেও কারো কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে পারেন না। এখন বিশ্বকে বলা হচ্ছে গ্লোবাল ভিলেজ। এখন বিশ্বের যেখানে বসে যিনি লিখবেন, সারা পৃথিবীর পাঠকদের কথা ভেবেই তাঁকে লিখতে হবে। কারণ পূর্বে নিজ দেশ ও তার ঘটনা সম্পর্কে যে তথ্য ও নিজ দেশে কোন ঘটনার যেই প্রভাব লেখকের উপর পড়ত বর্তমানে পৃথিবীর অপর ভাগের যে কোন তথ্য আর খবর আমরা মুহূর্তেই পাই আর আলোড়িত হই। অনেক ক্ষেত্রে তো দেখা যায়, এমন অনেক লেখক আছেন যাদের স্বদেশী পাঠকের চেয়ে ভিনদেশি পাঠকদের সংখ্যা অনেক বেশি।

ইউরোপীয় সাহিত্যের বর্তমান যে অবস্থা সেই অবস্থায় আমরা এখনও পৌঁছাতে পারিনি, সেটা কেবল লেখার গুণগত মান নয়, সাহিত্য দর্শন, সাহিত্য প্রকাশ ও বিপণনের কোন ক্ষেত্রেই না। আর আলাদা সমাজ বাস্তবতায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাহিত্যের তুলনার সময় বুঝি এখনো আসেনি। এর কারণ আমাদের জীবনযাত্রা আর ওদের জীবনযাত্রা এক নয়। আমরা প্রতিনিয়ত নানান সমস্যার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছি। উপনিবেশ সময়ের অনেক ক্ষত এখনো আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি।

 

ইউরোপীয় সাহিত্যের বর্তমান যে অবস্থা সেই অবস্থায় আমরা এখনও পৌঁছাতে পারিনি, সেটা কেবল লেখার গুণগত মান নয়, সাহিত্য দর্শন, সাহিত্য প্রকাশ ও বিপণনের কোন ক্ষেত্রেই না। আর আলাদা সমাজ বাস্তবতায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাহিত্যের তুলনার সময় বুঝি এখনো আসেনি। এর কারণ আমাদের জীবনযাত্রা আর ওদের জীবনযাত্রা এক নয়। আমরা প্রতিনিয়ত নানান সমস্যার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছি। উপনিবেশ সময়ের অনেক ক্ষত এখনো আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি। ইউরোপের সমাজ জীবনের কাফকা যে জগতটা চিহ্নিত করছেন তার সেই জগতটা অফিস আদালত ও আমলাদ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশে প্রায় আশি হাজার গ্রাম আছে। কাজেই কাফকার জগতটা এখানে একটা বৃহৎ শ্রেণির কাছে অচেনা। ইউরোপীয় আধুনিক উপন্যাস নিজস্ব ধারায় অস্তিত্বের নানান দিক উন্মোচন করেছে। বালজাক মানুষের ঐতিহাসিক অস্তিত্বকে আবিষ্কার করেছেন, ফ্লবেয়ার মানুষের দৃষ্টির সামনের অদেখা জগতকে উঠিয়ে এনেছেন। তলস্তয় মানুষের আচরণগত দিক ফুটিয়ে তুলেছেন, প্রুস্তের মাধ্যমে ক্ষয়ে যাওয়া অতীত আর জয়েসের মাধ্যমে অন্তর্মুখী বর্তমানে প্রবেশ করেছে সাহিত্য। টমাস মানের মাধ্যমে সাহিত্য অতীত-পুরাণকে বর্তমানের চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য করেছে।

কাজেই ইউরোপে বা উন্নত রাষ্ট্রে বর্তমান সাহিত্যের কাজ হল মানুষের আত্মপরিচয় বা আত্মসত্তাকে খুঁজে বের করা। সাহিত্য ওখানে সমাজ থেকে ব্যক্তিমুখী। মানে ব্যক্তির চোখ দিয়ে সমাজকে দেখা হয়, সমাজের চোখ দিয়ে ব্যক্তিকে নয়। ইউরোপে পুঁজির বিকাশের সাথে সাথে ব্যক্তির যে বিকাশ বা একাকীত্ব তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে তা এখনও হয়ে ওঠেনি। আমাদের এখানে একটা বৃহৎ অংশের কাছে ব্যক্তির চেয়ে সমাজ বড়। মানুষজন আধুনিক দর্শন, ধ্যান ধারণায় পুরোপুরি ধাতস্থ নয়। মানুষ তাদের পরিণতির জন্যে অদৃষ্টের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঈশ্বরের শক্তিই এখানে পরম শক্তি। ব্যক্তির বিকাশ বিশ্বাস দিয়ে দাড় করানো হয়। এখানে এখনও মানুষের মুক্তি সম্ভব হয়নি। প্রমথ চৌধুরীর সেই মেটাফরিক দোতলা ঘরের নিচ তলায় এখনো আমাদের বাস। কাজেই এখানে এখন সাহিত্যের প্রধান কাজ হল মানুষের মুক্তির পথ বাতলে দেওয়া। মানে পাঠককে প্রস্তুত করে তোলা। সমাজ ও রাষ্ট্র এখানে বন্দি—একটা বায়বীয় অচল অবস্থার কাছে। আমাদের অস্তিত্বের সংকট আর ইউরোপীয়দের অস্তিত্বের সংকট মোটেও এক নয়। আমাদের সাহিত্য এখনও জনগণ বা সমাজের কাছে কমিটেড বা দায়বদ্ধ। মানে সামাজিক গুরুত্বটাকে হালকা করে দেখবার সময় এখনও আসেনি।

ইউরোপ একসময় সমস্ত বিশ্বকে শাসন ও শোষণ করেছে। এখনও তারা চলমান আমেরিকার আধিপত্যবাদের অংশীদার। কাজেই আমেরিকান-ইউরোপীয় সাহিত্যের এই আধিপত্যবাদে বিরক্ত হবার কোনো কারণ ঘটেনি। আমরা শুধু ব্রিটিশ না—পাকিস্তান রাষ্ট্রেরও ঔপনিবেশিক ছিলাম। কাজেই আমাদের সাহিত্যের কাজ আর ঐ আধিপত্যবাদের সাহিত্যের কাজ এক হবার নয়। যদিও নীতিগতভাবে সাহিত্যের কাজ গোটা বিশ্বেই একই হবার কথা। কিন্তু অন্য এক রাজনৈতিক সত্যের মুখোমুখি আমরা।

আমাদের সাহিত্যিকরা বরাবরই সঠিক কাজটিই করে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমস্ত সাহিত্য বাঙালিকে বাঙালি হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। তিনি অনুজ সাহিত্যিকদের জন্যে বাংলা ভাষাকে আধুনিক সাহিত্য উপযোগী করতে সাহায্য করেছেন। রবীন্দ্রনাথ যদি ভাষা দিয়ে থাকেন, মাইকেল মধুসূদন দিয়েছেন ঢং বা কাঠামো। তারাশঙ্কর ও মানিক দিয়েছেন বিষয়বস্তু। তাঁরা ছাড়া আমরা আমাদের সত্তাটাকে ধরতে পারতাম না। বিভূতিভূষণ আমাদের বোধকে আরও গভীর করেছেন। নজরুল সাহিত্যের আপাত শান্ত ভুবনে গেয়েছিলেন অগ্নি বৃষ্টির গান, সতীনাথ ভাদুড়ী লিখলেন জীবনমুখি এক তীব্র সংগ্রামের কথা, বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথরা বাস্তবে দাঁড়িয়ে বাস্তবতার ক্লান্তি অগ্রাহ্য করে দিয়েছেন জীবন সৌন্দর্যের বর্ণনা।

ঢাকার বেশিরভাগ সাহিত্যিক কুয়ার ব্যাঙ। এরা সারাবছর নানা দল ও গ্রুপ করার পিছনে ব্যাস্ত থাকে। থাকে না পারস্পরিক ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ। দু’টাকার পুরস্কারের জন্য পা চাটে বিনাদ্বিধায়, জাতীয় দৈনিকের তথাকথিত সাহিত্য পাতায় নাম তোলার জন্য নীতিবর্জিত  সাহিত্য সম্পাদকদের সাথে সন্ধ্যার পরে অন্ধকার গলিতে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই এরা নৈতিক কারণে বিরোধিতা করেনি নিশ্চয়। আর ভাষা?

 

৩.

কয়েক বছর ধরে ঢাকায় লিট ফেস্ট হচ্ছে। প্রথম দিকে কিছু লোকজন এর বিরোধিতা করেছিল। যারা বিরোধিতা করেছে তারা বিরোধিতা করতে হয় বলেই করেছে, এই দেশে বামদলগুলো যেমন করে আরকি। বিরোধিতা করার অবশ্যই যৌক্তিক কারণ আছে, যেটা পরে বলছি, কিন্তু এরা নিজেরাও বোঝেনি যে কেন এই বিরোধিতা।  এমন না যে এই বিরোধিতার পিছনে নৈতিক কোন নীতি ছিল বা ভাষা প্রেম। ঢাকার বেশিরভাগ সাহিত্যিক কুয়ার ব্যাঙ। এরা সারাবছর নানা দল ও গ্রুপ করার পিছনে ব্যাস্ত থাকে। থাকে না পারস্পরিক ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ। দু’টাকার পুরস্কারের জন্য পা চাটে বিনাদ্বিধায়, জাতীয় দৈনিকের তথাকথিত সাহিত্য পাতায় নাম তোলার জন্য নীতিবর্জিত  সাহিত্য সম্পাদকদের সাথে সন্ধ্যার পরে অন্ধকার গলিতে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই এরা নৈতিক কারণে বিরোধিতা করেনি নিশ্চয়। আর ভাষা?

এই দেশে বাংলা এখনো মাতৃভাষা। তা রাষ্ট্র ভাষা নয় কখনই। এখানে আদালতের রায় থেকে শুরু করে উচ্চতর পড়াশুনা কোন কিছুর মাধ্যম ই বাংলা না। তারা আসলে বিরোধিতা করেছে নিজেদের অস্তিত্বতের সংকটের কথা ভেবে। মানুষ ভালো কিছুর সন্ধান পেলে তো আর তাঁদের মুড়ি চানাচুরের মতো সাহিত্যের যে ন্যূনতম বাজার সেখানেও টান পড়বে। অবশ্য বর্তমানে সেই বিরোধী কণ্ঠগুলো কিছু ক্ষীণ। এর পেছনে স্বার্থের কিছু যোগ আছে। সে আলোচনায় না যাই। আয়োজন নিয়ে বলি কিছু কথা।

কিন্তু যারা আয়োজক তারা আসলে শেষমেশ কি দেখান? দেখান সাজগোজ, চমক আর জাকজমক চাটুকার ও অশিক্ষিত লোকজন ছাড়াও যে অল্প সংখ্যক চিন্তক ঢাকায় আছেন, তারা কি আদৌ পাত্তা দেন? এ সময়ের এক চিন্তক রেজাউল করিম রনি গতবছর লিট ফেস্টের পরে লিখেছিলেন, “যারা হীনমন্য তারাই ভড়কে যায় এই সব জাকজমক দেখে। এরা যে সব গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের নিয়ে আসেন তাদেরকে খাচায় বন্দি করে রেখে পাবলিককে দেখায়। ঢাকার কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের সাথে তাদের কোন ইন্টারেকশনের সুযোগ দেয়া হয় না। শুধু মাত্র নিজেদের মিডিয়ায় কিছু খবর ছাপায়। এর বাইরে অন্যরা বা গোষ্ঠির বাইরের লেখকদের ইন্টারেকশনের কোন সুযোগ নাই। নানান কাহিনী তৈরি করে এরা একটা বলয় তৈরি করে রাখেন।

এরা আসলে দেখাতে চায় এতো সহজ না এতো বড় রাইটারকে আনা। সো এটাকে তো নিজের হাতে রাখতে হবে। মানে কিছু ইতর লোক যেমন, গরিবের সামনে মুরগার রান চিবায়ে মজা পায়, গরীবদেরকে নিজের চাকচিক্য দেখাতে আরাম পায় ঢাকা লিট ফেস্টে এই একই ফকিন্নিপনার ব্যাপক হাজিরা আছে। ফলে এইভাবে ৫০ হাজার বছর ধরেও আয়োজন চলতে থাকলে আমাদের সাহিত্য পরিমণ্ডলে তার কোন প্রভাব পড়বে না। বরং হীনমন্যতা বসত কিছু লোক ওদের দলে ভিড়ে যাবে। কিছু লোক খামোখা বিরোধিতা করবে।
কিন্তু ইন্টারেকশনের সুযোগটা গোষ্ঠিবদ্ধ তা আর ওদের গণ্ডির বাইরে না আসলে এর কোন সুফল ঢাকার সাহিত্য পাবে না। সাহিত্য কোন দিন শুধু দলবাজি করে হয় না”।

সত্যবাদী কে আছে যে এই লেখার সাথে একমত পোষণ করবে না? বাইরে থেকে যেসব লেখক আনা হয় তাঁদের কি হিসেবে সিলেকশন হয় এটা আয়োজকরাই বলতে পারবে।  আমার মনে হয় এমন লেখকদের আনা উচিৎ যাদের লেখায় বৃহৎ মানুষের কণ্ঠস্বর আছে। আছে চেতনার বহ্নি শিখা প্রজ্বলনের ক্ষমতা। কিন্তু আমরা দেখি এমন সব লেখক বা কবি আনা হয় যারা জীবন্মৃত বা পশ্চিমা মিডিয়ার আদরের লোক। পশ্চিমা মিডিয়ার আদর কেমনে পায় সেটা তো জানি আমরা।

এই লেখকদের যখন আনাই হয় তখন একটা ওপেন ফোরাম রাখা উচিৎ যেখানে তাঁরা পাঠকদের সাথে মত বিনিময় করবেন। চিড়িয়াখানার জন্তু বানায় মদ খাওয়ায় বিদায় করলে সাহিত্যের কিছুই হবে না। আয়োজকদের যারা দেশীয় বন্ধু ও স্তাবক কবি লেখক, এরা বেশিরভাগ এতো মূর্খ যে এই লিট ফেস্ট এ উপস্থাপনারও যোগ্যতা রাখেন না।

এটাকে এমন করে করুন যেন এই ভুখণ্ডের মানুষের সাংস্কৃতিক উন্নতি হয়। দরকারে ঢাকার বাইরে করুন। সাহিত্যকে খুব এলিট শ্রেণির উপযুক্ত করে তুলে ধরবেন না। কোন সাহিত্য কোন সমাজের স্বাভাবিক জীবন ও সাংস্কৃতিক হাওয়া ছাড়া বাঁচে না। লেখকদের মঞ্চ থেকে নামায় নিয়ে মানুষের কাতারে নিয়ে আসুন।

 

মোদ্দা কথা আমি চাই এমন এক আয়োজন যেখানে বাংলা সাহিত্য উপকৃত হবে, আমাদের লেখকদের জানা ও চেনার জগত বাড়বে, বাড়বে চিনা ও কাজের পরিধি। লিট ফেস্ট এর আয়োজকদের কাছে একটা অনুরোধ রাখছি। যেই উদ্দেশ্যেই এটা চালু হোক, এখন যেহেতু হচ্ছেই, এটাকে এমন করে করুন যেন এই ভুখণ্ডের মানুষের সাংস্কৃতিক উন্নতি হয়। দরকারে ঢাকার বাইরে করুন। সাহিত্যকে খুব এলিট শ্রেণির উপযুক্ত করে তুলে ধরবেন না। কোন সাহিত্য কোন সমাজের স্বাভাবিক জীবন ও সাংস্কৃতিক হাওয়া ছাড়া বাঁচে না। লেখকদের মঞ্চ থেকে নামায় নিয়ে মানুষের কাতারে নিয়ে আসুন। মাটিতে বসে লেখক পাঠক এর মিলন গড়ে উঠুক।

৪.

লিট ফেস্ট বা যা খুশি হোক। সাহিত্য নিয়ে যা হবে আমি তাতেই রাজি। এটা যেন বাণিজ্য ঘাটতির মতো সাহিত্য ঘাটতি বৃদ্ধি না করে। বিদেশি সাহিত্য থেকে কতটুকু নিলেন আর আপনার সাহিত্যের কতটুকু প্রসার হল ভাবেন। আরেকটা কথাও ভাবেন এতো এতো সাহিত্যিক থাকতে কেবল দুনিয়ার দালাল শ্রেণীর সাহিত্যিক যেন অতিথি না হয়। সাম্রাজ্যবাদী আর পুঁজিবাদী চক্রের বিরুদ্ধে বলতে পারা কাওকে কাওকে ও আনা যেতে পারে। তাই না? যোগ করতে হবে নিজ ভাষার স্বার্থ, নিজ সংস্কৃতির সাথে যোগ কতটুকু এই আয়োজনের আঙ্গিকে তাও আজ ভেবে দেখতে হবে। কত টুকু উন্মুক্ত সাধারণ পাঠক ও ভাবুকদের জন্য। সাহিত্য মানে মেলানো- মানুষ যেন মিলতে পারে, এই তো।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার এক সাক্ষাতকারে বলেছেন বিশ্ব ইতিহাসে বাংলা সাহিত্যের দিন শেষ। আর উঠবে না। যতটুকু আগ্রহ ছিলো সেটা যতটা না প্রাচ্যের সাহিত্য নিয়ে তার চেয়েও বেশি প্রাচ্য সম্পর্কে এক ধরনের নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। এমনকি, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পের যে আগ্রহ সেটাও সাহিত্য বুঝে নয় বরং একধরনের ব্যক্তিগত আকর্ষণ থেকে।

সুনীলের বক্তব্য ভুল। তার মৃত্যু হয়েছে তা নাহলে দেখা করে বলতাম। উনি নিজে বিশ্ব দরবারে বাংলা সাহিত্য পৌঁছে দেয়ার জন্য কি করেছেন?? শেষ বয়সে তো প্রায় মাফিয়ায় পরিণত হলেন। ওনাকে খুশি না করে কেউ কোন পুরস্কার পেত না।  বিশ্ব দরবারে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস কখন ছিল?? বিদেশিরা কি বাংলা শিখে বাংলা পড়বে?? আমাদের সাহিত্যের সেরা কোন কাজ ইংলিশে অনুদিত হয়েছে?? বুদ্ধদেব বসু, মানিক, তারাশঙ্কর, জীবনানন্দ, সতীনাথ ভাদুড়ী… নোবেল পুরস্কার পেতে এই মানের সাহিত্যিক না হলেও হয়। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ নিজে ইংলিশ জানতেন। নিজে অনুবাদ করে বিলেত গিয়েছেন।

আদুনিস নিজেই কিন্তু ইউরোপ বা পাশ্চাত্য এর স্তাবক। গতবছর এক সাক্ষাতকারে কবিতায় নোবেল বিজয়ী কবি আডোনিস ক্ষমতাসীনদের স্তুতি বা খুশি করা কবি সাহিত্যিকদের সমালোচনা করেছেন। অ্যাডোনিসের কথাটি সামগ্রিক হলেও বাংলা ভাষার সাহিত্যিক বা কবিদের ক্ষেত্রে এটি যথার্থই প্রযোজ্য বলেই মনে হয়েছে বিশেষ করে বাংলাদেশে। এই কথাটির ভিতরেই লুকিয়ে আছে সুনীলের হতাশার উত্তর। আমাদের এই অঞ্চলের এই সময়ের লেখকদের লেখার প্রকাশ যতটা ব্যক্তি নির্ভর বা নিজের যশ বা খ্যাতির জন্য সৃষ্টি তার কতটা বিশ্ব ইতিহাসে নিজের দেশকে নিয়ে যাবার লক্ষ্য কাজ করে সেটা নিয়ে তর্ক করার সুযোগ আছে। সম্মিলিত এফোর্টের চেয়ে একে অপরের কুৎসায় সময় যায়।

নিজেদের কিছু দেবার মত সামর্থ না থাকলেও সমালোচনায় আমাদের এই দেশের লোকেরা পিছিয়ে নেই। লিট ফেস্ট নিয়ে নাহক কুটনামী না করে কেমন করে এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কি করে  নিজের দেশের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব করা যায় এবং আন্তর্জাতিক সাহিত্যে বাংলা নিয়ে আগ্রহ জন্মানো যায় সেই চিন্তার পিছনে শক্তি ক্ষয় করলে হয়তো সুনীলের কথাকে ভুল প্রমাণের সুযোগ এলেও আসতে পারে।