বর্তমান বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তিগণের তালিকায় শীর্ষে থাকবে তার নাম। বহু প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বর্তমান বিশ্বের সফলতম ব্যক্তি তিনি। এই লড়াকু মানসিকতার মানুষটি মাইক্রোসফট কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তথ্য-প্রযুক্তি জগতের সম্রাট তিনি- বিল গেটস। খোদ তিনিই বলছেন, “বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালন করা খুব সহজ কাজ নয়। তার শিশুটি কেমনভাবে বেড়ে উঠবে, তা নির্ধারণ করুন তার অভিভাবকই। তাই কখন তার শিশুর হাতে মোবাইল তুলে দেবেন, সেই সিদ্ধান্ত ভেবেচিন্তে গ্রহণ করা উচিত শিশুটির পিতামাতার।”
৬৩ বছর বয়সি বিল গেটস নিজে তিন সন্তানের জনক। তার তিন সন্তানের বয়স যথাক্রমে ২০, ১৭ এবং ১৪। তার কোনও সন্তান উচ্চতর বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরুর আগে হাতে মোবাইল পায়নি। সন্তানদের কঠোর অনুশীলনে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত করিয়েছেন বিল গেটস। সন্তানদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, অল্প বয়স থেকে মোবাইল ব্যবহার করলে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা!
২০১৬ সালে প্রকাশিত “কিডস অ্যান্ড টেক: দ্য ইভলিউশন অব টুডে’জ ডিজিটাল নেটিভস” শীর্ষক এক রিপোর্ট জানিয়েছে, পৃথিবীব্যাপী যে-বয়সে শিশু হাতে মোবাইল পায়, তাদের গড় বয়স মাত্র ১০.৩ বছর। এবং পৃথিবীব্যাপী সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী শিশুদের গড় বয়স ১১.৪ বছর। তাবড়-তাবড় মনোবিজ্ঞানী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান বিশ্বে শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য এই তথ্য ভীষণ দুশ্চিন্তার।
মা-ঠাকুমা হয়তো সাংসারিক কর্মে ব্যস্ত। শিশু কোনও এক বায়না ধরল। কিংবা, কোনও জরুরি কাজের সময় শিশু দৌরাত্ম্য শুরু করেছে। শিশুটিকে দমন করতে, তাকে সব ভুলিয়ে দেওয়ার সহজ উপায়, মোবাইলে একটা গেম চালিয়ে তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া। শিশুটি যেন হাতে চাঁদ পেয়ে যায়! এই কৌশল বিন্দুমাত্র যুক্তিযুক্ত নয়। এভাবেই শিশু ক্রমশ মোবাইল ফোনের প্রতি অতিরিক্ত আসক্ত হয়ে পড়ে, দেখা দেয় বহু অসুখ।
কলকাতার বিখ্যাত মনোবিদ অমিতাভ মুখোপাধ্যায় বলছেন, “শিশুরা মোবাইল ফোনের প্রতি অতিরিক্ত আসক্ত হয়ে পড়ার ফলে তাদের চোখের রোগ এবং মানসিক রোগের প্রকোপ বাড়ছে। শহর কলকাতা মুক্ত নয় এই বদভ্যাস থেকে।” ঢাকা শহরের মনোবিদও বলছেন, বাংলাদেশের চিত্রও একই ধরনের।
সম্প্রতি আরও একটি রিপোর্ট আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। ব্রিটেনের একটি বিখ্যাত স্বাস্থ্য-বিষয়ক পত্রিকা সাতটি দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী পড়ুয়াদের ওপর একটি সমীক্ষা চালায়। দেশগুলি হল: স্পেন, জার্মানি, গ্রিস, রোমানিয়া, আইসল্যান্ড, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস। ওই পত্রিকা সমীক্ষা চালানোর পর স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, নজরদারি এবং সামাজিক মাধ্যম সম্বন্ধে পর্যাপ্ত জ্ঞান না-থাকলে ইন্টারনেট ব্যবহার করা থেকে দূরে রাখা উচিত জেন-নেক্সটদের। ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সি মোট ১২,২৩৭ জন পড়ুয়াকে নিয়ে এই সমীক্ষা করা হয়। তাতে প্রকাশিত হয় কোন দেশে কত শতাংশ ছেলেমেয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে- রোমানিয়া (৩৭.৩%), গ্রিস (২৬.৮%), জার্মানি (২৪.৩%), পোল্যান্ড (২১.৫%), নেদারল্যান্ডস (১৫.৫%) এবং আইসল্যান্ডস (১৩.৫%)। গবেষকগণ জানিয়েছেন, নেদারল্যান্ডস এবং আইসল্যান্ডের পড়ুয়াদের ইন্টারনেট ব্যবহার তুলনামূলক নিরাপদ। কারণ, ডিজিটাল প্লাটফর্ম এবং সামাজিক মাধ্যম সম্বন্ধে তাদের সম্যক ধারণা আছে। বাকি দেশগুলোর পড়ুয়াদের ব্যাপক হারে ইন্টারনেট ব্যবহার যথেষ্ট উদ্বেগজনক।
গবেষকগণ দাবি করেছেন, বেশিক্ষণ সামাজিক মাধ্যমে সময় কাটালে ছেলেমেয়েরা ক্রমশ অসামাজিক হয়ে পড়ে; দূরত্ব বাড়ে আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে। বাইরের জগতের সঙ্গে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তারা অত্যধিক সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। সামাজিক মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি প্রকাশ হয়ে পড়লে তারা ভীষণ আহত হয়, ভেঙে পড়ে। প্রেমের সম্পর্কে বিচ্ছেদ হওয়ার ফলে অনেকে প্রতিশোধপ্রবণতায় ফাঁস করে দেয় অন্তরঙ্গ মুহূর্তের গোপন ছবি, ভিডিও। তাদের গ্রাস করে মানসিক অবসাদ। এমনকি, অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে মানসিক আঘাত সহ্য করতে না-পেরে। ভারতেও বেশ কয়েকবার ফেসবুক লাইভ করে আত্মহত্যার ঘটনায় শিউরে উঠেছে অগণিত মানুষ!
আপনার অল্পবয়সি সন্তানের হাতে মোবাইল তুলে দেওয়ার আগে একশোবার ভাবুন!