এই হার তো স্বাভাবিকই!

এই হার তো স্বাভাবিকই!

টেস্টে ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে জিম্বাবুয়েকে বিনোদিত করে বড় পরাজয় নিয়েই সিলেট সফর শেষ করলো বাংলাদেশ। যারা ক্রিকেটের নিয়মিত অনুসারী তারা প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত ম্যাচের পথ পরিক্রমা জানেন, সুতরাং সেদিকে না গিয়ে আমি বরং ব্যবচ্ছেদের চেষ্টা করবো ক্রমাগত ব্যর্থতার কারণ।

‘শুরু’তে এবং ‘গুরু’তেই গলদ 

গুরু দিয়েই শুরু করি। সময় বিবেচনায় স্টিভ রোডস সফল কি ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনার সময় এখনো আসেনি। কিন্তু, জিম্বাবুয়ে ম্যাচের পূর্বে জিম্বাবুয়েকে হারানোর যে তাবদির তিনি বের করেছেন, তাতে সফল হলে তিনি তাসকিন পেতেন বটে, তবে বাংলাদেশের তাতে কোনো উপকার হতো বলে আমার মনে হয় না। যেনতন উপায়ে জয়ের যে আত্মঘাতী পথ বাংলাদেশ অনুসরণ করে সামান্য সাফল্য পেয়েছিল তা আখেরে যে কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা দিবালোকের মত স্পষ্ট। এমন অবস্থায় খোদ কোচ যদি সে পথেই হাটার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন বলতেই হয় ভুল আদমির হাতে পড়েছে বাংলাদেশ।

সিলেট টেস্টের দল নির্বাচনই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তিন স্পিনার খেলানোর যে রেওয়াজ চালু হয়েছে তা বহাল রাখতে গিয়ে নাজমুল অপুর মতন সীমিত ওভার বিশেষজ্ঞকে নামিয়ে দেয়া হলো টেস্ট খেলতে! অপু উইকেট পেয়েছেন বটে, তবে তা কতটা কাজে এসেছে তা তো ম্যাচ শেষেই স্পষ্ট। টেস্টে সাধারণত বিশেষজ্ঞরাই প্রাধান্য পেয়ে থাকেন। সে হিসাবে ফিট থাকার পরেও মোস্তাফিজ বা নতুন ডাক পাওয়া খালেদ কেন সুযোগ পেলেন না সে সাওয়াল ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

ব্যাটিং এর দিকে যদি লক্ষ্য করা যায় তাহলে বাংলাদেশ দলের হর্তাকর্তাদের বাংলায় জ্ঞান নিয়ে সাওয়াল তুলবার অবকাশ সৃষ্টি হয়। হ্যাঁ, এমন দলের বিপক্ষে তরুণদের সুযোগ দেয়ার কথা বিশেষজ্ঞরাই বলেছেন। কিন্তু, তরুণদের সুযোগ দেয়ার মানে এই না যে, অভিজ্ঞতার কোনো প্রয়োজনই নেই। সাকিব-তামিম না থাকায় এমনিতেই ব্যাটিং অর্ডারে অভিজ্ঞতার যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। সেটি পূরণে অন্তত একজন হলেও অভিজ্ঞ ক্রিকেটার প্রয়োজন ছিল। আরিফুল বা নাজমুল এদের যে কোনো একজনের সাথে তুষার হলে বিষয়টা বাংলাদেশের জন্যই শ্রেয় হত। কিন্তু সৎ ছেলেকে বাজান ডাকার অনিহায় ব্যর্থতার আরো একটি নজির আমরা দেখলাম।

টেস্টকে বুঝতে পারার অক্ষমতা 

আপনি বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং এবং বোলিং নিয়ে শত আলোচনা করে একটি সমাধানের পথ খুঁজে দেখতে পারেন। তাতে, সময়ের নিদারুণ অপচয় বৈ কিছুই হবে না। কারণ, আমি অন্তত পরিষ্কার টেস্ট খেলার মতন পরিপক্ক বাংলাদেশ না। মাত্র একটি ম্যাচের ব্যার্থতায় যে এমন বলছি তা না, আপনি ২০০০ থেকে শুরু করে ২০১৮ পর্যন্ত বাংলাদেশের টেস্ট একাদশ গুলো খালি একটি পারলে খেয়াল করিয়েন। মাঝে সাত ব্যাটসম্যান এর সাথে একজন হালকা ব্যাটিং এবং হালকা বোলিং পারে মার্কা খেলোয়াড় দিয়ে দল সাজানো হত। প্রতিপক্ষের বিশ উইকেট নেয়ার ভাবনা যে এইখানে কাজই করেনি সেটি বললেও চলছে। এখন শুরু হয়েছে তিন স্পিনার রঙ্গ। টেস্টের যে মূল স্পিরিট সেটা বাংলাদেশ কখনোই ধরতে পেরেছেন বলে আমার অন্তত মনে হয় না।

ধাঁধাঁয় বিভ্রান্ত ব্যাটসম্যানরা 

সদ্য সমাপ্ত টেস্টটাই যদি খেয়াল করেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের নিয়ে অপনার বিভ্রান্ত হওয়াটা স্বাভাবিক। প্রথম ইনিংসে নির্বিষ পেসের ছোবলে পথ হারানো ব্যাটসম্যানরা দ্বিতীয় ইনিংসে পথ হারালেন স্পিনে! তাও, সিকান্দার রাজার মত একজন অকেশনাল স্পিনারের বলে। এখন ব্যাটসম্যানদের নিয়ে আপনি যদি ধাঁধাঁয়ে পড়ে যান দোষ দেয়ার জো নেই। সমস্যাটা হচ্ছে খোঁদ ব্যাটসম্যানরাই রয়েছে এক ধরনের ধাঁধাঁর মধ্যে।

খেলা শিখে আসার যে জায়গা, সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের মান নিয়ে কয়েকদিন আগে সাওয়াল তুলেছেন খোদ প্রধান নির্বাচক। আমি নিজেও তার সাথে একমত, কিন্তু আমি যেমন একমত হয়েই দায়মুক্ত সেটি তার বেলায় খাটে না, কেননা তিনি পদধারী একজন আদমি।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট কখনোই স্পোর্টিং উইকেটে হয় না। যেটুকু স্পিন উইকেটে হয়, তার সাথে টেস্টে যে স্পিন উইকেটে খেলা হয়, তার সামান্যতম মিল নেই। অতএব, ব্যাটসম্যানরা না মুখোমুখি হচ্ছেন ভালো পেস বোলিং এর না খেলছেন ভয়াল স্পিন উইকেটে। এমন একজনকে সরাসরি টেস্টে নামিয়ে দিয়ে ফল আশা করাটাও অন্যায়। দেশের মাটির উইকেটই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্য টেস্টে থাকে অচেনা! এমনটি আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ। বিপিএল নামক অর্থ কামানোর মচ্ছবে না মেতে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের উইকেটের মান উন্নয়ের পাশাপাশি প্রত্যেকটা দলে যদি অন্তত একজন বিদেশি খেলোনোর সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে বড় পরিসরে লাভবান হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটই। এমন ভাবনাটাও কেউ কখনো ভেবেছেন বলে মনে হয় না।

টেস্ট খেলার মত ‘টেম্পার’ ব্যাটসম্যান আছে তো? 

এই সাওয়ালটি উঠানোর আগে আরো একবার সেই ঐতিহাসিক জয়ের সময়কালটায় ফিরিয়ে নিয়ে বিরক্ত করতে চাই। পাঁচ দিনের খেলা টেস্ট তিন দিনেই শেষ করে ফল নিয়ে আসার পরিকল্পনার প্রভাব ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিংয়ে বাজে প্রভাব ফেলেছে। উইকেট বিবেচনায় অনেক সময় ত্রিশ রানও একশ সমতূল্য বলে বিবেচিত হয়। এখন, এই ধরনের উইকেটে নিয়মিত খেলানোর অভ্যাস গড়ে তুলে ব্যাটসম্যানদের যে ক্ষতিটা হচ্ছে সেটি বোঝার মতন কেউ আছেন বলে মনে হয় না। ত্রিশ-চল্লিশ করেই ব্যাটসম্যানরা ধৈর্য্য হারাচ্ছেন সহজে। এখন, সে সময় এই ত্রিশ চল্লিশ করেই যখন বর্তে যাওয়া গিয়েছে তখন সেটাই মনে দাগ কাটা স্বাভাবিক। আজকেই দেখুন, লিটন-ইমরুলরা কেমন সেট হয়ে উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসলেন। মুশফিকের মতন ব্যাটসম্যানও ঐ শট খেলার দায় এড়ান কিভাবে?

প্রথম প্যারায় যেমনটি বলেছি গলদটা গোড়াতেই। এখন এটির সমাধানে প্রয়োজন আত্ম-উপলব্ধির। পরিতাপের যে পরের টেস্টেই যদি ফল অনূকুলে আসে সেটির জায়গা দখল করে নিবে আত্মশ্লাঘা। আর তাতে জোডর হাওয়া দেবে আমাদের গণমাধ্যম। এই করেই চলছে বলে এক পা এগুলেও তিন পা পিছায় বাংলাদেশ! জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই হারকে অস্বাভাবিক বললেও আমি এটিকে স্বাভাবিকই বলবো। বরং, অস্বাভাবিক পন্থায় যে টেস্ট খেলা যায় না সেটির অনুধাবন কাম্য। নতুবা, গতকাল যেমন বলেছিলাম, আবারো বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পড়বে জোর সাওয়ালের মুখে। এবং সেটি যৌক্তিকভাবেই।