উমবার্তো ইকো যেভাবে আজকের ফ্যাসিবাদকে চিহ্নিত করেছেন

উমবার্তো ইকো যেভাবে আজকের ফ্যাসিবাদকে চিহ্নিত করেছেন

ফ্যাসিবাদ নিয়ে সারা দুনিয়ার আলোচিত দার্শনিকেদর মধ্যে অন্যতম একজন হলেন, উমবার্তো ইকো তার লেখা বিখ্যাত লেখা Ur-Fascism বা আমাদের ফ্যাসিবাদ প্রবন্ধটি নিয়ে ডেইলি বেস্ট পত্রিকায় ক্রিস্টোফার ডিকে ইকোর চিহ্নিত ফ্যাসিবাদের লক্ষণগুলো নিয়ে লিখেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই লেখাটি জবানের জন্য অনুবাদ করেছেন, উম্মে সালমা


ইতালিতে ফ্যাসিস্ট শাসন অবসানের দুই দশক পরে প্রয়াত ইতালিয়ান ঔপন্যাসিক এবং দার্শনিক উমবার্তো ইকোর আধুনিক ফ্যাসিবাদের উপর একটি অপ্রতিরোধ্য এবং স্বতন্ত্র্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, সেখানে হাজির করা তার সংজ্ঞাগুলোকে আজকের দিনের আলোকে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।

প্যারিস-ইউরোপে, লোকজন ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে দুই-একটা জিনিস মাত্র জানেন।
বার্নি সেন্ডার্স যখন তরুণ ছিলেন, বামপন্থিকর্মীরা তখনই প্রগতিশীল ধ্যান ধারণার বিপরীত ধারার চিন্তা-চেতনায় মগ্ন থাকতো। এমনকি তারা তাদের পিতা-মাতা এবং রাষ্ট্রপতির কাছেও সেসব ধারণাসমূহ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করতেন।

ইউরোপে ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ, স্ট্যালিনবাদ -এই নামগুলো সবচেয়ে জীবন্ত, স্পন্দিত, বিদ্বেষপূর্ণ শক্তি ছিল যা ইতিহাসে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধের জন্ম দিয়েছে। অতি সম্প্রতি, লাতিন আমেরিকায় সক্রিয় ভাবাদর্শ হিসেবে এর আবার উত্থান ঘটে। কিন্তু এটা এক ধরনের দমনমূলক বিপ্লব এবং ক্লিশে যুদ্ধের একটি ভিত্তি স্থাপন করে এবং এর প্রভাব অতীতে এত প্রকট ছিল যার কারণে ৬০ এর দশক হতে ৮০ এর দশক পর্যন্ত ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটেছিল।

প্রকৃতপক্ষে, ফ্যাসিবাদের মূলনীতিগুলো আমরা উপলব্ধি করতে পারি যখন দেখি আইএস’র ভূমি হত্যাযজ্ঞের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়, উত্তর কোরিয়ার নেতার উন্মত্ততা দেখা যায় ও ইউরোপে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন গড়ে ওঠে। এবং অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের কিছু প্রচারণায় ফ্যাসিবাদের কিছু সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে।

যখন আমি জানতে পারলাম বিখ্যাত ইটালিয়ান চিন্তক উমবার্তো ইকো মৃত্যুবরণ করেছেন, দুই দশক আগে নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকসে তার প্রকাশিত দীর্ঘ রচনার কথা মনে পড়ল। এবং এটি আবার যখন পড়ি, আমি বিস্মিত হই কেননা এটি ক্ষমতাসম্পন্ন প্রধান রাজনৈতিক দল, এর সম্মোহনী শক্তি এবং এর সহজাত, অসংখ্য বিপদ সম্পর্কে আমাদের চিন্তা চেতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
কারণ বিংশ শতাব্দীতে ফ্যাসিবাদী সরকারবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য এবং অসংগতি দৃশ্যমান হয়েছে। একজন সেমিওটিশিয়ান হিসেবে ইকোর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিলো সাংকেতিক আদান প্রদান যা তাকে চমৎকার কিছু উপন্যাস লিখতে অনুপ্রেরণা জোগায় যেমন, দ্য নেম অব রোজেস, সৌড টু আইডেন্টিটি। তিনি এক কথায় ফ্যাসিবাদের মূলনীতিগুলোকে ‘আমাদের –ফ্যাসিবাদ (Ur-Fascism) অথবা সনাতন ফ্যাসিবাদ’ হিসেবেই উল্লেখ করেন।

আমাদের ফ্যাসিবাদ (Ur-Fascism) সরলতার ছদ্মবেশেও ফিরে আসতে পারে। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে একে সবার সামনে উন্মোচন করা এবং নতুন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলেই একে চিহ্নিত করা -প্রতিদিন, পৃথিবীর প্রত্যেকটি জায়গায়।

 

১৯৯৫ সালের জুন মাসে যখন ইকোর এই রচনা প্রকাশিত হয় পৃথিবীতে তখন অনেকটাই প্রশান্তি বিরাজমান ছিল, এবং আজকের তুলনায় দুনিয়া যথেষ্ঠ পরিমাণে কম ফ্যাসিবাদী ছিল। তবে হ্যাঁ, অনেক ভয়ংকর ব্যাপারও ঘটেছিল তখন। রুয়ান্ডার গণহত্যা মাত্রই শেষ হয়েছিল। বলকান যুদ্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। একজন জাপানি ধর্মানুরাগী সারিন গ্যাস উন্মুক্ত করে দিয়েছিল টোকিও মেট্রোতে। কিন্তু কিউবা এবং উত্তর কোরিয়া ব্যতিত প্রায় সব জায়গায় কমিউনিজম প্রায় বিকল হয়ে পড়েছিল। এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আবেশ থেকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ দূরেই ছিল। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন তখনও আততায়ীর হাতে নিহত হননি। এবং ‘মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি’ প্রকৃতপক্ষে তখনও স্থিতিশীল ছিল। রাশিয়ান সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এবং আমেরিকান নভোচারীগণ রাশিয়ার নভোচারীদের সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিল তাদের মীর স্পেস স্টেশনে।

ইকো তখনও লিখে চলেন, “আমাদের ফ্যাসিবাদ ( Ur-Fascism) এখনো আমাদের চারপাশে বিদ্যমান, মাঝে মাঝে এটি সাদা পোশাকের আড়ালে থাকে “ তিনি সতর্ক করেন, “আমাদের ফ্যাসিবাদ (Ur-Fascism) সরলতার ছদ্মবেশেও ফিরে আসতে পারে। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে একে সবার সামনে উন্মোচন করা এবং নতুন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলেই একে চিহ্নিত করা -প্রতিদিন, পৃথিবীর প্রত্যেকটি জায়গায়।”সত্যিই যখন এটি আবার ফিরে এসেছে, আমাদের কর্তব্য হচ্ছে একে চিহ্নিত করা।

প্রত্যেকেরই ইকোর ১৪টি পয়েন্ট স্মরণে রাখা দরকার যেহেতু আমরা বৈশ্বিক রাজনৈতিক ভূদৃশ্য নিয়ে গবেষণা করি। এমন কি নিজেরাই যখন এই পয়েন্টগুলো তুলনামূলক ভাবে আলোচনা করি, আমাদের মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত প্রবাহিত হয়। ইকোর পয়েন্টগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করছি।

ইকো আমাদের অবহিত করেন, “আমাদের- ফ্যাসিবাদ (Ur-Fascism) এর একটি অন্যতম উপসর্গ হলো বুদ্ধিজীবীদের ভেতরে চরম অবিশ্বাস

 

ঐতিহ্যের পূজা – [‘হাজার বছরের বাঙালি সংষ্কৃতি’র মিথ তৈরির কথা পাঠক মনে রাখতে পারেন] এ ধারণাটি পুরনো আমলের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাকে একেটটা সর্বজনীন সত্য হিসেবে হাজির করে। ইকো বলেন, “এর ব্যাখ্যা বিশদভাবে করা হয়েছে এবং আমরা শুধুমাত্র এর অস্পষ্ট একটি ব্যাখা দাঁড় করাতে পারি।” তথাকথিত স্ব-ঘোষিত ইসলামি স্টেটের তথাকথিত খিলাফতের শাসনামলকে সবার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। এই জন্য একধরণের  কোরানিক ব্যাখ্যার প্রচারণা ছিল এবং এটা সমসাময়িক একটা উদাহরণ হতে পারে। তবে ইউনাইটেড স্টেটে কিছু রাজনৈতিক ধর্মান্ধদের স্বৈরাচারী, আক্রমণাত্মক ধারণাই আমাদের বিকল্প চিন্তা চেতনাকে প্রভাবিত করছে।

আধুনিকতাকে প্রত্যাখ্যান আর প্রযুক্তির প্রত্যাখ্যান এক নয়। (আজকের আইএস এবং ইন্টারনেটের দিকে তাকালেই এটা বুঝা যায়) বরং এটি আজকের যুক্তিবাদের যুগে জ্ঞানবার্তাকেই প্রত্যাখ্যান, “যা মূলত আধুনিক দুরাচারেরই শুরু।” এই অর্থে, ইকো লিখেছেন, “আমাদের-ফ্যাসিবাদকে ( Ur-Fascism) অযৌক্তিকতাবাদ হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।” ইকোর মতে, “যুক্তিবাদ যখন অচল হয়ে যায়, কর্মের খাতিরেই কর্ম তার আপন সৌন্দর্য প্রকাশ করে এবং নির্দিষ্ট গতিতে চলে যার পূর্বেকার অভিজ্ঞতার আর প্রয়োজন হয় না।” ইকো সনাতন ফ্যাসিবাদীদের সম্পর্কে আরো বলেন, “তাদের চিন্তাভাবনা একরকমের অসহায়তা বা দূর্বলতার বহিঃপ্রকাশ।”

ইকো আমাদের অবহিত করেন, “আমাদের- ফ্যাসিবাদ (Ur-Fascism) এর একটি অন্যতম উপসর্গ হলো বুদ্ধিজীবীদের ভেতরে চরম অবিশ্বাস। তিনি Goering এর বিবৃতি থেকে কতিপয় অভিব্যক্তি বার বার ব্যবহার করেন যেমন, ‘degenerate intellectuals’ অর্থাৎ ‘অধঃপতিত বুদ্ধিজীবী’, ‘eggheads’ যার অর্থ দাঁড়ায় ‘অতিশয় পান্ডিত্যাভিমানী ব্যক্তি’, ‘effete snobs’ বা অক্ষম উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি, ‘universities are a nest of reds’ বা বিদ্যাপীঠগুলো বামপন্থিদের আখড়াতে পরিণত হয়।’

ইকো লিখেছিলেন, ঐতিহাসিক ফ্যাসিবাদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিল হতাশাগ্রস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সমর্থন করা, যে শ্রেণিটি অর্থনৈতিক সংকটে ভুগতো অথবা রাজনৈতিক অবমাননা মেনে নিত, এবং নিম্ন সামাজিক গ্রুপগুলোর চাপ সৃষ্টির কারনে আতঙ্কগ্রস্ত থাকতো।

 

এই শতাব্দীতে ইউনাইটেড স্টেটে Anti-intellectualism বা  ‘বুদ্ধিবৃত্তিককতা বিরোধীতা এই শব্দটি ‘political correctness’ বা ‘রাজনৈতিক বিশুদ্ধতা’ হিসেবে প্রকাশ্যে নিন্দিত হয়েছে। এই সনাতন ফ্যাসিবাদকে উদ্দেশ্য করে ইকো লিখেছেন, তারা মনে করেন, মতভেদই হলো রাজদ্রোহ বা বিশ্বাসঘাতকতা। এবং সনাতন ফ্যাসিবাদকে বর্ণবাদী আখ্যায়িত করে ইকো আরো বলেন, এরা বেড়ে ওঠে পরাশ্রমজীবীর মতোই এবং এদের ভেতর প্রাকৃতিকভাবেই নানারকমের ভীতির সঞ্চার ঘটে।

ইকো লিখেছিলেন, ঐতিহাসিক ফ্যাসিবাদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিল হতাশাগ্রস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সমর্থন করা, যে শ্রেণিটি অর্থনৈতিক সংকটে ভুগতো অথবা রাজনৈতিক অবমাননা মেনে নিত, এবং নিম্ন সামাজিক গ্রুপগুলোর চাপ সৃষ্টির কারনে আতঙ্কগ্রস্ত থাকতো। অযৌক্তিকতাবাদ, অন্ধবিশ্বাস, এবং হতাশার এই পরিবেশে অবধারিতরূপে একটি চক্রান্তের আবেশ গড়ে তোলে, এবং একে ইকো ‘সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক চক্রান্ত’ বলেও অভিহিত করেন।

অনুসারিদের অবশ্যই নিজেদের অবরুদ্ধ মনে হবে’, ইকো আরো বলেন, “এই চক্রান্তের সমাধানের সবচেয়ে সহজ উপায় হলো বিদেশিদের সম্পর্কে অহেতুক ভয়কে সমর্থন করা। কিন্তু এই চক্রান্তের শুরু ভেতর থেকেই; (ইউরোপ-আমেরিকার প্রেক্ষাপটে) যেখানে ইহুদিরা সাধারণত লক্ষ্যবস্তু কেননা তারা ভিতর এবং বাহির উভয় দিক থেকেই সুবিধা আদায় করছে।”

আজকে যুক্তরাষ্ট্রে বহিরাগতরা হলো মেক্সিকান এবং মুসলমানেরা। ইউরোপে আফ্রিকান এবং মুসলিমরাও একই ভাবে বিবেচিত হন। শত্রুদের জাঁকজমকপূর্ণ অর্থ এবং ক্ষমতার প্রভাবে এই অধপতিত অনুগামীরা অপমানিত বোধ করে। এই জন্যই, উদাহরণস্বরূপ, আমরা শুনতে পাই আজকে আমেরিকা দূর্বল, রাশিয়া সেখানে ভালো নেতৃত্ব দিচ্ছে, আবার চীনারা যুক্তরাষ্ট্রকে ক্লীনার্স পন্যের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডিল করছে। একই সময় ইকো আরো লিখেন, “এই অন্ধ অনুসারীদের উপলব্ধি করতে হবে যে তারাই পারে শত্রুদের বিহ্বল করে দিতে। ঘনঘন লক্ষ্যের পরিবর্তনের ফলে শত্রুরা একই সময় শক্তিশালী হবে এবং দূর্বলও হবে। “আমরাই পারি আমেরিকাকে আবার মহান করে তুলতে, যার জন্য প্রয়োজন একজন সঠিক নেতাকে ঠিক করা  আমাদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য।

ইকো popular elitism বা জনপ্রিয় অভিজাতবাদ সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, এরা মনে করে “প্রত্যেক নাগরিক বিশ্বের সেরা সম্প্রদায়, পার্টি বা দলের সদস্যরাই সেরা নাগরিক, প্রত্যেক নাগরিক দলের সদস্য হতে পারে (হওয়া উচিত)। তবে জনসাধারণের অংশগ্রহণ ছাড়া শুধুমাত্র অভিজাতবর্গ অংশগ্রহণ করতে পারে না।” যদি কেউ সামরিক উপায়ে ক্ষমতা দখল করে অথবা নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা হয় (হিটলার যেভাবে হতেন) তিনি জানেন, “তার শক্তির ভিত্তি হচ্ছে জনসাধারণের দূর্বলতা, তারা এতই দূর্বল যে তারা মনে করে তাদের একজন নিষ্ঠুর শাসকের প্রয়োজন।”

 

ইকো popular elitism বা জনপ্রিয় অভিজাতবাদ সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, এরা মনে করে “প্রত্যেক নাগরিক বিশ্বের সেরা সম্প্রদায়, পার্টি বা দলের সদস্যরাই সেরা নাগরিক, প্রত্যেক নাগরিক দলের সদস্য হতে পারে (হওয়া উচিত)। তবে জনসাধারণের অংশগ্রহণ ছাড়া শুধুমাত্র অভিজাতবর্গ অংশগ্রহণ করতে পারে না।” যদি কেউ সামরিক উপায়ে ক্ষমতা দখল করে অথবা নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা হয় (হিটলার যেভাবে হতেন) তিনি জানেন, “তার শক্তির ভিত্তি হচ্ছে জনসাধারণের দূর্বলতা, তারা এতই দূর্বল যে তারা মনে করে তাদের একজন নিষ্ঠুর শাসকের প্রয়োজন।”

ইকোর মতে, সনাতন ফ্যাসিবাদীদের কাছে জীবন মানেই নিরন্তর যুদ্ধক্ষেত্র এবং শান্তির আলোচনা মানেই হলো “শত্রুদের সাথে অবৈধ বাণিজ্যের আলাপ।” এখানে রাষ্ট্রীয় বীরত্বের একটি ব্যাপার আছে যাকে আইএস এবং আল কায়েদা টাইপের সংগঠনগুলো martyrdom বা ‘শহীদী মৃত্যু’ বলে অভিহিত করেন।

এরকম পরিপ্রেক্ষিতে, ইকো বলেন, “বীর হতে হলে প্রত্যেককেই শিক্ষিত হতে হবে। প্রতিটি পৌরাণিক কাহিনীতে বীরকে ব্যতিক্রম হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, কিন্তু আমাদের-ফ্যাসিবাদ (Ur-Fascism) এই বীরত্বই হলো আদর্শ। বীরত্বের এই অর্চনা সূক্ষ্ম ভাবে জড়িয়ে আছে মৃত্যুকে পূজার সাথে। এখানে ফালাঞ্জের নীতিবাক্য ফলানোর সুযোগ নেই। যেখানে উল্লেখ ছিল Viva la Muerte (ইংরেজিতে এটির অনূদিত অর্থ হলো ‘মৃত্যু দীর্ঘজীবী হোক’) অ-ফ্যাসিবাদের(non-fascist)এই সমাজে নিম্ন শ্রেণির জনসাধারণের কাছে মৃত্যু হলো অপ্রীতিকর তবে একে সম্ভ্রমের সাথে মোকাবেলা করতে হবে। আবার বিশ্বাসী বা মুমিনদের কাছে এই মৃত্যু হলো অতিপ্রাকৃত সুখ লাভের একটি বেদনাদায়ক উপায়। বিপরীতে, আমাদের ফ্যাসিবাদের (Ur-Fascist) নায়কেরা বীরত্বপূর্ণ মৃত্যুর জন্য মুখিয়ে থাকে, যেখানে প্রচার করা হয় বীরত্বপূর্ণ জীবনের জন্যই আছে শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার। আমাদের ফ্যাসিবাদের (Ur-Fascism) বীরেরা মৃত্যুর জন্য অধীর আগ্রহে ছটফট করতে থাকে। এই সময় এরা অন্যান্যদেরও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে দ্বিধাবোধ করে না।”

এখানে বর্ণিত একটি অংশে machismo এর কথা উল্লেখ আছে যার অর্থ হলো পৌরুষ বা সাহস প্রদর্শন। ইকো বলেছেন, “যেহেতু নিরন্তর যুদ্ধ এবং বীরত্ব অতি জটিল ক্রিয়া, আমাদের ফ্যাসিবাদী( Ur-Fascist) বীর তার ইচ্ছাশক্তিকে যৌনতায় হস্তান্তর করে। এটি হলো machismo বা পৌরুষ এর উৎস (যেখানে নারীর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শিত হয় এবং অনাদর্শ যৌন চর্চা, সতীত্ব থেকে সমকামিতা -এই বিষয়গুলোর প্রতি নিন্দা এবং অসহনশীল ; উভয় অর্থই প্রকাশ পায়)। যেহেতু এখনো যৌনতা অতি জটিল ক্রিয়া, আমাদের ফ্যাসিবাদী (Ur-Fascist) বীর অস্ত্র চালনা করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে -যা প্রতিস্থাপিত লিঙ্গ চর্চারই শামিল।”

নাগরিকেরা কোনো কাজ করে না,তাদের শুধুমাত্র জনগণের ভূমিকা পালন করতে আহ্বান করা হয়।

 

ইকো selective populism বা নির্বাচনী জনপ্রিয়তার ব্যাপকতা প্রসঙ্গে উল্লেখ করে ফ্যাসিবাদী শাসনে নাগরিকদের বিষয়ে বলেন, “নাগরিকেরা কোনো কাজ করে না,তাদের শুধুমাত্র জনগণের ভূমিকা পালন করতে আহ্বান করা হয়।” এবং তিনি জর্জ অরওয়েল রচিত 1984 গ্রন্থে ব্যবহৃত Newspeak বা সর্বগ্রাসী ভাষা যা স্ট্যালিনবাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং ফ্যাসিবাদের মতোই সাধারণ, এর বিরুদ্ধে সতর্কতা জারি করে তার লেখার যবনিকাপাত টানেন। তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেন, “এই সকল নাজি অথবা ফ্যাসিবাদের পাঠ্যপুস্তকে জটিল এবং সংকটপূর্ণ দলিলের কার্যসম্পাদনের জন্য নিম্নমানের শব্দতালিকা এবং আদিকালের বাক্যগঠন ব্যবহৃত হতো।” তিনি আরো বলেন, “তবে আমাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে এই সকল সর্বগ্রাসী কৃত্রিম ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে, এমনকি তারা যদি নিষ্কলঙ্ক রূপে হাজির হয় জনপ্রিয় টক শোতে।”

বর্তমানে যখন আমরা বিশ্ব মানচিত্রের দিকে তাকাই, এই আইএস অথবা মুসলিম ভ্রাতৃত্বের ইসলামি –ফ্যাসিবাদের (Islamo-Fascist) (এখানে ব্যবহৃত একটি যথোপযুক্ত শব্দ) কোনো সমস্যা আসলে খুঁজে পাওয়া যায় না। যথেষ্ঠ পরিষ্কার ভাবে আমরা এর উথান দেখতে পাই পোল্যান্ড, গ্রীস, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, বৃটেন, এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোতে। এর যথার্থতা প্রকাশ পায় যখন রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন এই টার্ম বা শব্দকে ঘৃণার সাথে বর্ণনা করেন। তবে আমেরিকান রাজনীতির সাথে ইকোর সনাতন ফ্যাসিবাদের সংগতি কোথায়? এটা কি হতে পারে যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বছরে আমাদের সামনে নিজেদের খারাপ সহজাত প্রবৃত্তিগুলো জাহির করবে?

এরা কি পূর্বগতানুগতিক ভয়, এবং অসন্তোষ, হতাশা এবং মানহানির মোকাবেলা করে? তারা কি নিজেদের অযৌক্তিকতাবাদ এবং এন্টি-বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যকলাপের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে? তারা কি নিজেদের পৌরুষ বা সাহস প্রদর্শনের জন্য বন্দুক বহনকারী বীর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করে? ওহ, নিপাত যাক! আমার এসব খুঁজে বের করার প্রয়োজন নেই। উমবার্তো ইকোই এই কাজটি করছেন কবর থেকে। কেননা তিনি তো বিশ বছর আগেই লিখে গেছেন ১৯৩৮ সালের ৪ নভেম্বরে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট মূল্যবান কিছু কথা বলেছিলেন  “যদি আমেরিকার গণতন্ত্র সম্মুখে অগ্রসর হওয়া থামিয়ে দেয় জীবিত শক্তি হিসেবে, যে শক্তি আমাদের নাগরিকদের ভালো রাখতে দিনরাত শান্তিপূর্ণ উপায় অনুসন্ধান করে, ফ্যাসিবাদ আমাদের ভূমিতে শক্তিশালী হয়ে গড়ে উঠবে।”

ইকো বলেছেন, “স্বাধীনতা এবং মুক্তি একটি বিরামহীন প্রচেষ্টা।”