আসামের তিনসুকিয়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম খেরনিবাড়ি। এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা মজদুর, শ্রমিক শ্রেণির। গ্রামে দিন শুরু হয় কাকভোরে, অন্ধকার নামে ঝুপ করে। সেই গ্রামে একটি দোকান আছে সহদেব নমশূদ্র নামে এক যুবকের। দিনভর খাটাখাটনির পর কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে গ্রামের কিছু মানুষ সেই দোকানে জমায়েত হয়। খোশগল্প-আড্ডা চলে বেশ কিছুক্ষণ। পরচর্চা আর মশকরা দিয়েই জমে যায় আড্ডা। রাজধানীর অলিন্দের হাল-হকিকত সম্বন্ধে ওরা তেমন একটা খোঁজখবর রাখে না। আড্ডা শেষ হয়। তারপর বাড়ি গিয়ে একপেট খেয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙে কাকভোরে। এভাবেই চলে জীবনের গতানুগতিক ধারাপাত।
১ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার। প্রায় রাত আটটা। সেই দোকানের বাইরে রোজকার মতো জমেছে আড্ডা, বসেছে লুডো খেলার আসর। রাতের নিস্তব্ধতা চিরে ভটভট শব্দে তিনটি রয়েল এনফিল্ড বাইক এসে দাঁড়ায়। বাইক থেকে নামে পাঁচজন হৃষ্টপুষ্ট চেহারার মানুষ। পরনে জলপাই রঙের সামরিক পোশাক। মুখে কালো কাপড় বাঁধা, কাঁধে রাইফেল। ওরা বেশ ধমকের সঙ্গে বলে, জরুরি আলোচনা আছে, চল আমাদের সঙ্গে। গ্রামের মানুষেরা ভেবেছিল, সেনা ছাড়া আর কী হতে পারে! ভয়ে-ভয়ে, নিমরাজি হয়েও ওরা যায় সেনাদের সঙ্গে। গ্রামের এবড়োখেবড়ো রাস্তা, তাই পথ দেখতে মোবাইলের টর্চ জ্বালায় ওরা। সেনারা ধমক দিয়ে মোবাইল কেড়ে নেয়। তখনই সন্দেহ দানা বাঁধে। সেনারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল অসমিয়ায়, ওদের সঙ্গে হিন্দিতে। ব্রহ্মপুত্র নদের চরে ধোলা-শদিয়া সেতুর নিচে এসে দাঁড়ায় ওরা, দেখা যায় আরও কয়েকজন সশস্ত্র জোয়ান পায়চারি করছে। সকলকে লাইন দিয়ে বসতে বলে ওরা। প্রথমে বসতে চায়নি অনন্ত, অবিনাশ। ধমক দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। তারপর সেই সেতুর নিচে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ধাঁ ধাঁ শব্দে গর্জে ওঠে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। শুরু হয় আর্তনাদ, ধোঁয়ায় ভরে যায় চারদিক। তখনই একটা গর্ত আর কাঁটাঝোপের মতো জায়গায় প্রাণ বাঁচাতে লাফ দেন সহদেব। তারপর জ্ঞান হারিয়ে যায়। কিছুক্ষণ অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকার পর জ্ঞান ফেরে। ছুটে গিয়ে গ্রামের মানুষদের ডেকে আনেন। সকলে এসে দেখেন, পাঁচটি নিথর লাশ শায়িত। একই পরিবারের তিন সদস্য-সহ পাঁচজন নিহত হন ঘটনাস্থলে। নিহতদের নাম শ্যামলাল বিশ্বাস (৬০), অবিনাশ বিশ্বাস (২৩), অনন্ত বিশ্বাস (১৮), সুবল দাস (৬০), ধনঞ্জয় নমশূদ্র (২৩)। বরাতজোরে বেঁচে যান সহদেব নমশূদ্র, একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী তিনিই।
যে-সেতুটির নিচে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেই সেতুটি ভারতের দীর্ঘতম সেতু, দৈর্ঘ্য ৯.১৫ কিমি। আসাম এবং অরুণাচল প্রদেশ জুড়েছে এই সেতুর মাধ্যমে। ২০১৭ সালের ২৬ মে এই সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাংলা-আসাম সম্প্রীতির দূত ভূপেন হাজারিকা, যিনি কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী, তিনি ব্রিটিশ-শাসিত শদিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। এই সেতুটি তাঁর স্মরণেই নামাঙ্কিত করা হয়েছে ভূপেন হাজারিকা সেতু। সাধু উদ্যোগ। এলাকাবাসীর গর্ব এই সেতু। এই সেতুটিই সাক্ষী থাকল নিরীহ মানুষদের নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের।
তাদের যাওয়ার আগেই আরও কয়েকজনকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। পায়চারি করছিল আরও পাঁচ-সাতজন সশস্ত্র জঙ্গি। পাকড়াও করে আনা ওই লোকগুলোকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, হিন্দিতে উত্তর দেয় ওরা। ছেড়ে দেওয়া হয়। টার্গেট কি তবে বাংলাভাষী?
বারবার এই ধরনের হত্যালীলা শুভবাদী মানুষদের মনে পড়িয়ে দিচ্ছে নবারুণ ভট্টাচার্য রচিত সেই অমোঘ কবিতার লাইন, “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না/ এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না…” প্রবীণ কবি শঙ্খ ঘোষ বলছেন, “বেশ কিছুকাল ধরে আমাদের দেশ যে একটা মহা দুর্বিপাকের দিকে এগিয়ে চলেছে, অসমের (আসামের) সাম্প্রতিক ঘটনা তারই একটা নতুন চিহ্ন। এখনও যদি সকলে একসঙ্গে মিলেজুলে এর প্রতিরোধের কথা না ভাবি, তাহলে সর্বনাশ অনিবার্য এবং অবশ্যম্ভাবী!”
এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বেশ কিছু প্রশ্ন উঠছে।
প্রশ্ন ১ : প্রত্যক্ষদর্শী সহদেব জানাচ্ছেন, তাদের যাওয়ার আগেই আরও কয়েকজনকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। পায়চারি করছিল আরও পাঁচ-সাতজন সশস্ত্র জঙ্গি। পাকড়াও করে আনা ওই লোকগুলোকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, হিন্দিতে উত্তর দেয় ওরা। ছেড়ে দেওয়া হয়। টার্গেট কি তবে বাংলাভাষী?
প্রশ্ন ২ : তিনসুকিয়া এলাকায় একটি জঙ্গি সংগঠনের শক্ত ঘাঁটি আছে। ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (ইন্ডিপেনডেন্ট), যা উলফা (স্বাধীন) নামে পরিচিত, এলাকায় তাঁদের দাপট থাকায় পুলিশি টহল থাকে। ঘটনার দিন পুলিশি টহল ছিল না। কেন? এমনকি, বারবার ফোন করে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়েছিল, প্রথমে ফোন রিসিভ করা হয়নি। কিছুক্ষণ পর সুইচড অফ করা হল পুলিশের ফোন। মাত্র ২০০ মিটার দূরে পুলিশ চৌকি। কেন এল না পুলিশ?
প্রশ্ন ৩ : কেন্দ্রীয় সরকার নাকি দিনসাতেক আগে আসাম সরকারকে জানিয়েছিল, উলফা যে-কোনও সময়ে আচম্বিতে বাঙালিদের ওপর হামলা চালাতে পারে, অতএব প্রশাসন যেন সদাজাগরুক থাকে। আসাম সরকারও বিজেপি-শাসিত, মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার অভিন্ন, কাদা-ছোড়াছুড়ি হওয়ার প্রশ্ন নেই। আগাম চেতাবনী সত্ত্বেও কেন সতর্ক ছিল না সর্বানন্দ সোনোয়াল সরকার? ক্ষুব্ধ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। সেদিন রাজ্যে ছিলেন না মুখ্যমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদি ফোন করে নির্দেশ দিলেন, কড়া হাতে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে। ফোন করে পরামর্শ দিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ।
প্রশ্ন ৪ : পুলিশ প্রশাসন থেকে জঙ্গি সংগঠন, দায় ঝেড়ে ফেলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে সকলের মধ্যেই। প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া হয়েছিল, এই হত্যাকাণ্ড করেছে উলফা (স্বাধীন)। গত অক্টোবরে ফ্যান্সিবাজারে বিস্ফোরন ঘটিয়েছিল তারা, পরে তা স্বীকার করে নিয়েছিল। স্বীকার করে নেওয়াটা সংগঠনের বিধান। এই হত্যাকাণ্ডে অভিযোগের তির ছিল তাদের দিকেই। তাই সংগঠনের নেতা পরেশ বড়ুয়া শীঘ্র বিবৃতি মারফত দাবি করলেন, তারা এই হত্যাকাণ্ডে কোনওভাবে জড়িত নন। তবে, আরও কি কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মজবুত ঘাঁটি তৈরি করেছে তিনসুকিয়া এলাকায়?
প্রশ্ন ৫ : পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থলে পাওয়া গিয়েছে চীনে তৈরি একে-৮১ রাইফেলের গুলির খোল। অতএব, এই কাজ জঙ্গিদের? ব্যাস, দায়িত্ব শেষ? ৩ নভেম্বর ঘটনাস্থল ঘুরে দেখলেন এনআইএ-র একটি তদন্তকারী দল। হয়তো তাঁদের হাতেই সরকারিভাবে তুলে দেওয়া হবে তদন্তভার। এসপি বিবেকানন্দ দাসের নেতৃত্বাধীন দলটি বলল, এত বড় ঘটনার পর পুলিশ ঘটনাস্থল ঘিরে দেয়নি কেন? গত ৪৮ ঘন্টায় আমজনতা, সাংবাদিক এবং অন্যদের অবাধ চলাফেরার কারণে ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করার মতো কোনও নমুনা নেই। ভীষণ অসন্তুষ্ট তাঁরা, স্বাভাবিক। পুলিশের গা-ছাড়া মনোভাব কেন?
সমাজকর্মী অখিল গগৈ আঙুল তুলছেন সরকারের দিকেই। তার অভিযোগ, ঘোলা জলে মাছ ধরতে সরকারই এই কাণ্ড ঘটায়নি তো? ফেলে দেওয়ার প্রশ্ন নয়।
প্রশ্ন ৬ : সমাজকর্মী অখিল গগৈ আঙুল তুলছেন সরকারের দিকেই। তার অভিযোগ, ঘোলা জলে মাছ ধরতে সরকারই এই কাণ্ড ঘটায়নি তো? ফেলে দেওয়ার প্রশ্ন নয়।
প্রশ্ন ৭ : উলফার একটি অংশ আলোচনাপন্থী শিবিরের দুই নেতা মৃণাল হাজারিকা এবং জিতেন দত্ত অতি সম্প্রতি বাঙালি-দমনের হুমকি দিয়েছিলেন। তাদের কাণ্ড নয় তো? জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২ নভেম্বরে মৃণাল হাজারিকাকে গুয়াহাটির পানবাজারে এবং জিতেন দত্তকে শিবসাগরের গৌরিসাগরে তলব করা হয়, পরে গ্রেফতার করা হয়। এখনও তারা স্বীকার করেনি। দিনকয়েক পরেও পর্দাফাঁস হতে পারে।
প্রশ্ন ৮ : উলফা সংগঠনের আলোচনাপন্থী অংশের শীর্ষ নেতা অনুপ চেটিয়া বললেন, সঠিক তদন্ত হলেই জানা যাবে কারা এই নিধন-যজ্ঞ করেছে। তবে আসামে যে বাঙালি-অসমিয়া বিদ্বেষের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, এর নেপথ্যে দায়ী কিছু নেতানেত্রীর উস্কানিমূলক মন্তব্য। তালিকায় প্রথমেই আছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! পশ্চিমবঙ্গেরও কিছু রাজনৈতিক শিবির ঠারেঠোরে একই কথা বলছে। তাই নাকি? এই তো মাসকয়েক আগে অসমে নাগরিকপঞ্জির নবায়ন প্রক্রিয়ার অছিলায় দুই কোটি মানুষকে ‘বিদেশি’ বানিয়ে দেওয়া হল। প্রতিবাদে গর্জে উঠলেন মমতা। নিন্দুকেরা বললেন, বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে উসকে দিচ্ছেন মমতা। কেন্দ্র দ্বিতীয়বার খসড়া তালিকা তৈরি করল, নির্ভুল হল না, চল্লিশ লক্ষাধিক বাঙালি বাদ গেল। আবারও সোচ্চার মমতা। প্রতিনিধি দল পাঠালেন বরাক উপত্যকায়, শিলচর বিমানবন্দরে আটকে দিল বিজেপি সরকারের প্রশাসন। ছিছিক্কার পড়ে দেশ-জুড়ে। কোনও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বললেন না, ওদের আটকে উচিত কাজ করেছে। তিনসুকিয়ায় পাঁচ বাঙালি হত্যায় দুঃখপ্রকাশ করলেন। বললেন, “গুজরাটে বিহারি খেদাও হচ্ছে, অসমে বাঙালি খেদাও হচ্ছে। সারা দেশে অশুভ সংকেত মনকে ভারাক্রান্ত করে রেখেছ।” মমতা সরাসরি বলে দেন, রাজা তোর কাপড় কোথায়? তাই দোষী? কিছুদিন আগে উত্তরবঙ্গের জনসভায় বললেন, “অসমে ব্যবসা-বাণিজ্যে অসুবিধা হচ্ছে? চলে আসুন আমাদের বাংলায়। সাদর অভ্যর্থনা! আমরা গ্রহণের ঐতিহ্য নিয়ে বাঁচি।” তিনসুকিয়ায় মমতা পাঠালেন তৃণমূলের চার সদস্যের প্রতিনিধিদল। দলে ছিলেন সর্বভারতীয় তৃণমূল মুখপাত্র এবং রাজ্যসভায় দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন, বিধায়ক মহুয়া মৈত্র, দুই সাংসদ নাদিমুল হক ও মমতাবালা ঠাকুর। আকাশপথে ডিব্রুগড় বিমানবন্দরে পৌঁছে তাঁরা সড়কপথে খেরনিবাড়ি যান। এবার তাঁদের হেনস্থা করেনি অসম পুলিশ। কড়া নিরাপত্তায় পুলিশের কনভয় তৃণমূল প্রতিনিধিদলকে নিহতের পরিবার পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। মমতা-শক্তি কী জিনিস, অসম সরকার সমঝে গিয়েছে তবে? ডেরেক, নাদিমুল শোকসন্তপ্ত নিহতের পরিবারে বলে এলেন, আমরা আপনাদের পাশে ছিলাম, আছি এবং থাকব। পরিবার-পিছু দিয়ে এলেন এক লক্ষ টাকা।
মমতার কুৎসা করার আগে কিছু সত্য, সঠিক যুক্তি সাজিয়ে নিন মশাই!