জুভেন্টাস : ইতালির প্রেমিকা

জুভেন্টাস : ইতালির প্রেমিকা

ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের জায়ান্টদের তালিকা তৈরি করলে শুরুর দিকেই থাকবে ‘লা ফিদানজাতা দ’ইতালিয়া’ (ইতালির প্রেমিকা) খ্যাত জুভেন্টাসের নাম। ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং তারকাখচিত প্লেয়ার দিয়ে সুসজ্জিত ১২১ বছরের ইতিহাস। ১২১ বছর, সময়ের হিসাবে বয়োজ্যেষ্ঠ ক্লাব হলেও জুভেন্টাসের জন্মই হয়েছে ফুটবলের ঝলকে তুরিণ বুড়িদের আজন্ম তরুণদের মত উজ্জীবিত করে রাখার জন্য।

১৮৯৭ সালের নভেম্বরের ১ তারিখে ‘ম্যাসিমো দ’আজিলিও লুসিয়াম’ নামক স্কুল স্পোর্টস ক্লাব জুভেন্টাস নামে ‘লা সিনোরা আমিসিদি’(ঘাতক নারী)দের যাত্রা শুরু হয়। তার বছর দুয়েক পর জুভেন্টাসকে শুধুমাত্র ফুটবল ক্লাব হিসেবে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং ক্লাবের পূর্বের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেয় ‘ফুটবল ক্লাব জুভেন্টাস’। ১৯০০ সালে প্রথমবারের মত জুভেন্টাস ইতালিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে। তার ৪ বছর পর ১৯০৪ সালের স্থানীয় ব্যবসায়ী অ্যাজমন মারসান জুভেন্টাসের মালিকানা কিনে নেয় এবং পরিচালনার দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন।

জুভেন্টাসের প্রথম সফলতা আসে ১৯০৫ সালে। অ্যাজমন মারসান মালিকানা গ্রহণ করার পর বাহির থেকে ভালো প্লেয়ার দলে ভেড়ান যার ফল স্বরূপ মালিকানা গ্রহণ করার এক বছর পরই জুভেন্টাস তাদের ইতিহাসের প্রথম শিরোপা ইতালিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করেন। ১৯০৬ সালে জুভেন্টাস তাদের জার্সির রঙ কালো-গোলাপি পরিবর্তন করে সাদা-কালো স্ট্রাইপের ডিজাইন করেন। জার্সির এই রঙ ও ডিজাইনটি ইংলিশ ফুটবল ক্লাব নটস কাউন্টি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে করা হয়েছিলো। সে বছরেই জুভেন্টাসের কিছু কর্মকর্তা জুভেন্টাস ছেড়ে গিয়ে নতুন ক্লাব ‘এফবিসি তুরিনেসে’(বর্তমান তুরিনো এফসি)প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি সে সময়কার  জুভেন্টাসের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট  আলফ্রেড ডিকের ভালো লাগেনি। সে সময় থেকেই জুভেন্টাস ও তুরিনোর মাঝে দা-কুমড়া সম্পর্ক। সেখান থেকেই জুভেন্টাস ও তুরিনোর ম্যাচকে ‘ডার্বি দেল্লা মোল’ বলা হয়।

প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর ১৯২৩ সালে জুভেন্টাসের মালিকানা কিনে নেয় ইতালির শিল্পপতি এবং ইতালির গাড়ি ফিয়াট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক এডওয়ার্ড আগ্নেল। সে বছরই জুভেন্টাস তাদের নিজস্ব নতুন স্টেডিয়াম তৈরি করে। সে সময় থেকেই জুভেন্টাসের নতুন দিগন্তের পথ চলা শুরু হয়। এরপর কখনও আর জুভেন্টাসকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সে সময় থেকে ইতালি তথা ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের কাছে পরিচিত নাম ছিলো জুভেন্টাস। সিরিআ-এসহ ইতালির সকল ধরনের লিগে ছিলো জুভেন্টাসের সরব উপস্থিতি ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলে যখন ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন লিগ(বর্তমান উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ) চালু হয় সেখানেও জুভেন্টাস ধারাবাহিক অংশগ্রহণ ও পারফর্মেন্স করে যাচ্ছিলো। ১৯৭৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৩ বার (১৯৭৭, ১৯৯০ ও ১৯৯৩)  ইউরোপা লিগ এবং  ১৯৮৫ ও ১৯৯৬ সালে ২ বার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে জুভেন্টাস। জুভেন্টাস গৌরবান্বিত একটি সফল ক্লাব হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলো পুরো ফুটবল বিশ্বের কাছে।

২০০৪ সালে জুভেন্টাস তখন দূর্দান্ত ফর্মে এমন অবস্থায় জুভেন্টাসের কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় ফ্যাবিও ক্যাপেলোর হাতে। তারকা নির্ভর দল পেয়ে ফ্যাবিও ছিলেন সফল। টানা দু’বছরেই শিরোপা জিতে নেয় ফ্যাবিওর অধীনস্থ জুভেন্টাস। তাছাড়া সে সময় জুভেন্টাসের স্কোয়াডে ছিল সব সুনামধন্য ফুটবলাররা। ২০০৬ সালে জুভেন্টাসের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে সময় পার করে। কারণ সে সময় জুভেন্টাস কালকিওপোলি স্ক্যান্ডালে জড়িত থাকার কারণে সিরিআ-এ থেকে সিরিআ-বি তে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং ক্যাপেলোর অধিনে জেতা ২০০৫-০৬ সালের সিরিআ-এ লিগ জয় বাতিল করে তা ইন্টার মিলানকে সেই দুই সিজনের লিগ জয়ী ঘোষণা করেন।

লিগ টেবিলের শীর্ষ থেকে দ্বিতীয় সারির লিগে চলে যাওয়ায় সে সময় জুভেন্টাসের খেলোয়াড় ইব্রাহিমোভিচ ও ফ্যাবিও ক্যানাভারো দল থেকে চলে যায়। তবে বুফন পিরলোরা জুভেন্টাসের বাজে সময় পাশে থেকেই লড়ে গেছেন। তাদের চেষ্টায় এক সিজন পরেই আবার সিরিআ-এতে ফিরে আসেন।

তারপর থেকে সিরিআ-এতে প্রায় একচেটিয়া রাজত্ব করছে জুভেন্টাস। জিতে নিয়েছে টানা ৭টি লিগ টাইটেল একই সাথে দলে ভিড়িয়েছেন বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার পর্তুগিজ ফুটবল রাজপুত্র ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে। জন্মলগ্ন থেকেই অপ্রতিরোধ্য জুভেন্টাস হয়তো মাঝে হোঁচট খেয়েছিলো তবে থেমে যায়নি, ঘুরে দাঁড়িয়েছে ফিরেছে আরও ভয়ঙ্কর রূপে। লা ফিদানজাতা দ’ইতালিয়া (ইতালির প্রেমিকা) এখন আর শুধু ইতালিয়ানদের মনেই সীমাবদ্ধ নয়, জায়গা করে নিয়েছে লাখো কোটি ফুটবল ভক্তের হৃদয়ে।