গলদ ফর্মুলা আর গোয়ার্তুমিতে বাঁধা ক্রিকেট!

গলদ ফর্মুলা আর গোয়ার্তুমিতে বাঁধা ক্রিকেট!

১৮৯২ সালের এক ঘটনার জিকর দিয়ে আজকের লেখা শুরু করছি। তৎকালীন ঢাকার নবাব আহসানউল্লাহ বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে ফিরিঙ্গি দেশ থেকে একজন ‘লেডী’ আনলেন। সে লেডি বেলুনে উড়ে নগরবাসীকে তামাশা দেখাবেন। ঘোষণাটি ছিলো এরুপ। তো এ তামাশা দেখার জন্য প্রচুর লোকও জড়ো হইলো। বিপত্তি বাধলো তখনই যখন নবাব সাহেব লেডিকে নদীর ওপার থেকে উড়ে এসে আহসান মঞ্জিলের ছাদে নামার অনুরোধ করলেন সে সময়; অন্দরের নারীরা যাতে তামাশা বঞ্চিত না হয় তাই এ আব্দার ছিলো। প্রাথমিক চুক্তি দশ হাজারের সাথে আরে বাড়তি পাঁচ হাজার টাকা দাবি করে লেডি নবাবের আব্দার রাখতে রাজিও হলেন। কিন্তু দখিন দিক থেকে প্রচণ্ড বাতাস বইবার কারনে সে লেডি মঞ্জিলের ছাদে নামবার বদলে আরো দু’তিন মাইল দূরে একটি ঝাউ গাছে গিয়ে আটকে গেলেন। সাঝ বেলায় বাম্বু নিয়ে এক পুলিস গেলেন আটকে থাকা লেডিকে উদ্ধার করতে। লেডি যতই বলে তার মা-ভাই আর রশি নিয়ে আসতে, পুলিশ ততই বধির হইতে থাকে। তার এক কথা বাম্বু বেশ শক্ত আছে, তা ধরেই নামা সম্ভব। কিন্তু মধ্যিপথেই সে বাম্বু ভেঙ্গে পড়লে লেডি মুহুর্তেই অক্কা পান। গোয়ার্তুমির ফল যে ভয়ানক হয় এ গল্পটি তার অকাট্য প্রমাণ। আরেকভাবে বলা যায়, পরিণাম চিন্তা না করে শুধু ইচ্ছা চরিতার্থ করার ফলাফলও কখনো মধুর হয় না।

খেলার পাতায় নওয়াব পরিবারের জিকর কিছুটা বিভ্রমের জন্ম দিতে পারে। বিষয়টা খোলাসা করা যাক। ‘৯৯ এর বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ দল যতটা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিল তার চেয়ে বেশি বিস্ময়কর ছিল তার ঠিক এক বছর পর বাংলাদেশকে টেস্ট খেলতে দেখাটা, কেননা তখনো পূর্ণাঙ্গ প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের কাঠামোই বাংলাদেশের ছিল না।

এখন একটু গল্পে ঢুকি আবার। নওয়াব আহসানউল্লাহর এহেন তামাশা দেখানোর মনোবাসানার পিছনে ছিল শহরবাসীর সামনে নওয়াবী শক্তির জাহির করে তাক লাগিয়ে দেয়া। একই রকমভাবে, তৎকালীন বিসিবি প্রধানও চেয়েছিলেন টেস্ট খেলুড়ে দেশের মর্যাদা লাভ করে সবাইকে তাক লাগাতে। তাক তারা দুজনই লাগিয়েছেন বটে, তবে, একজন তাক লাগানোর খেসারত দিয়েছেন একজনের জীবন নিয়ে অপরজন ইজ্জত ধরে টান দিয়ে। এখানে, একজনের সহায়ক হিসাবে কাজ করেছে বিপুল ধনদৌলত অপরজনের দর্শক। আমি দুজনের কারোই উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছি না, কিন্তু পরিপূর্ণ বিবেচনা ব্যতীত যে কোনো সিদ্ধান্তই যে আত্মঘাতী হতে পারে তা এ দুটো ঘটনাতেই স্পষ্ট।

নভেম্বর মাসটা বাংলাদেশের ক্রিকেটে আলাদা একটি তাৎপর্য বহন করে কেননা এই মাসেই প্রথম ‘টেস্ট’ খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ। আঠারো বছর পরে এসেও অপ্রিয় সাওয়াল আরো একবার করতে হচ্ছে যে, বাংলাদেশ অদৌ টেস্ট খেলার যোগ্য কি না? জিম্বাবুয়ের সাথে চলতি টেস্টের ফলাফল যদি অনুকূলেও আসে তাতেও আমার সাওয়াল সামান্য বদলাবে না। এর আর পেছনে যেমন বিসিবি দায় রয়েছে, দায় রয়েছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আইসিসির একই রকম দায় রয়েছে আমাদের গণমাধ্যমেরও।

শুরুর দিককার বছরগুলো বাদই দেই, বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘ঐতিহাসিক’ জয়গুলো যে সময়ের মধ্যে এসেছে, সেই ‘১৪ এর পর থেকে যদি বর্তমান সময় পর্যন্ত নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করা হয়, বাংলাদেশের ক্রিকেট সত্যিই কতটা এগিয়ে সে সাওয়ালটি বেশ জোরেসোরেই উচ্চারিত হবে। এ সময়ের মধ্যে আমরা অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের মতন দলকে ঘড়ের মাটিতে হারিয়েছি সত্যি, কিন্তু সেটি যে রেসিপি প্রয়োগে এসেছিল সেটি সত্যিকার অর্থে সাফল্যের জন্য সহায়ক ছিল নাকি আত্মঘাতি সে সাওয়ালটি গণমাধ্যম সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছে, কেননা তাতে পাঠক অশোন্তোষ্ট হতে পারে। হক কথা, কিন্তু পাঠককে বিভ্রান্ত করে সত্য জানানোর দায়টাও কিন্তু গণমাধ্যমেরই। এখানেও আমরা চূড়ান্ত ব্যর্থ।

অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড এর মতন দলকে আপনি যখন হারাবেন তখন সাধারণে এই বার্তাই পৌছাবে যে আপনি সঠিক পথে রয়েছেন এবং যথেষ্ট উন্নতি করছেন। বাস্তব চিত্রটা কী? তারপর থেকে আমরা প্রায় সম শক্তির শ্রীলঙ্কা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে লজ্জাজনকভাবে হেরেছি। আফ্রিকা সফর তো ইয়াদে আনাও পাপসম। অর্থাৎ, অজি এবং ইংলিশদের যে রেসিপিতে আমরা হারিয়ে আত্নশ্লাঘায় ভুগছিলাম তা ছিল চরম আত্মঘাতী। স্পোর্টিং উইকেটের বদলে মাইন ফিল্ড বানিয়ে টস ভাগ্যের সহায়তায় ফল তো অনুকুলে আনা গিয়েছে কিন্তু ক্ষতিটা এখন স্পষ্ট চোখেই দেখা যাচ্ছে। আফ্রিকা প্রথাগত পেস উইকেটের বদলে ফ্ল্যাট উইকেটে খেলেছিল বাংলাদেশের সাথে, সেখানেও আমাদের ব্যাটসম্যানরা খাবি খেয়েছে দৃষ্টিকটূ ভাবে। উইন্ডিজের যে বর্তমান বোলিং লাইন আপ, তার বিপক্ষে যেভাবে আমরা আত্মসমর্পণ করেছিলাম সেটাও সাওয়ালের জন্ম দেয়। অবস্থা এতটাই সঙ্গীন যে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও আমাদের সম্মিলিত স্কোরই ২০০ হচ্ছে না। ঐতিহাসিক জয়ের মূল্য নাকে খত দিয়েই দিতে হচ্ছে।

আমি জয় দুটোর প্রসঙ্গ বারবার টেনে আনছি এই জন্য যে, তিন স্পিনার নিয়ে টেস্ট খেলার, এবং স্পোর্টিং এর বদলে ঘাতক পিচ বানানোর যে রেওয়াজ বর্তমানে চলছে, তার সূচনা ঐখান থেকেই। এর মাঝে র‌্যাঙ্কিয়ে একধাপ এগোনোটা আমাদের গণমাধ্যমগুলো এমন ফুলিয়ে ফাপিয়ে প্রকাশ করেছিল যে, নগ্ন সত্যটা আড়ালেই চলে গিয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে আব্রু রক্ষাতেই জীবন বাজি রাখার মতন অবস্থা।

এরপরের অবস্থাটা লক্ষ্য করুন। পিচে যদি ফাটল না থাকে দেশের মাটিতে আমাদের ভয়ঙ্কর স্পিনাররা হয়ে পড়েন নখদন্তহীন। টেস্টে তো পেসাররা বলতে গেলে শো পিসের ভূমিকা পালন করেন। যার ফলে আফ্রিকার পেস কন্ডিশন বা উইন্ডিজের সবুজাভাব উইকেটের সুবিধাটুকুও তারা কাজে লাগাতে পারেন না। এমন ভুতুড়ে পিচ ব্যাটসম্যানদের খেলাতেও প্রভাব ফেলছে বাজে ভাবে। আফ্রিকা, উইন্ডিজ বাদই দিন লাল বলে পেস খেলার অনভ্যাসে জিম্বাবুয়ের বোলাররাও হয়ে যাচ্ছেন স্টেইন-অ্যান্ডারসন! প্রথম ইনিংসে জিম্বাবুয়ের পেসাররা যে পাঁচটি উইকেট নিয়েছে তার একটিও উইকেট পাবার মতন ছিল?

নওয়াবের সেদিনের খেয়ালের রক্ষাকর্তা হতে পারতেন দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্তাটি। কিন্তু তিনি ছিলেন আরেক কাঠি গোয়ার। যার খেসারত তো আগেই উল্লেখ করেছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশেও তেমন এক পুলিশ কর্তার হাতেই পড়েছে যার নাম স্টিভ রোডস। যিনি সিরিজ শুরুর আগে জানিয়েছেন কিভাবে আসল সেটা মূখ্য না, জয় আসাটাই আসল! যার পথ দেখানোর কথা, তিনিই যদি অন্ধ হন তাহলে বিপদ বৈ কিছুই আর সামনে নেই। এই যেন তেন উপায়ে জয়ের রেসিপির জনমদাতা ভারত। যারা মাঝে টেস্টের শীর্ষস্থানে পৌছুলেও কারো সমীহ আদায় করতে পারেনি কারণ তাদের জাড়িজুড়ি ঐ ঘরের মাটিতেই সীমাবদ্ধ। প্রশ্নবিদ্ধ একটি ফর্মুলা যা সকলের কাছেই সমালোচিত তাতে যদি আপনি সমাধান খুঁজে পান, তাহলে বলতেই হয় সামনে বড় বিপদই অপেক্ষা করছে।

তিন স্পিনার খেলানোর দিব্যির ফলে অভিষেক হলো নাজমুল অপুর। তিনি কি অদৌ টেস্ট মানের বোলার? অপুর যে শক্তির জায়গা সেটি দিয়ে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তিনি সফল হতে পারেন, হচ্ছেনও কিন্তু টেস্টে এটা সম্ভব না। এই সামান্য বুঝটুকু কর্তাদের মাথায় ঢুকবে না এটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। তিন স্পিনারের সিদ্ধান্তেই যদি অটল থাকা স্থির হয়ে থাকে, তাহলে খালেদকে ডাকা কেন?

এটা নগ্ন সত্য যে, বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পিছনে যতটা ক্রিকেটিয় কারণ প্রাধান্য পেয়েছে, তারচেয়ে বেশি পেয়েছে বাণিজ্যিক কারণ। আইসিসির এই সিদ্ধান্ত বহুবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের নৈপুণ্যের জন্যই। আঠারো বছর পরেও যখন সাওয়ালটি আবার সামনে আসছে, বলাই যায় ভুল থেকে নূণ্যতম শিক্ষা নিতেও বাংলাদেশের অনীহা চরমে। নওয়াবজাদা যেমন তাক লাগিয়েই বাজিমাত করতে চেয়েছিলেন তেমন আমরাও সাদা পোশাকে খেলাটাকেই অর্জন বলে ধরে নিয়ে বসে রয়েছি।

পুলিশ কর্তার গোয়ার্তুমি এবং নওয়াবজাদার অবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্তের জেড়ে যে ফলাফলটি ঘটেছিল সেটি তিনি ধামাচাপা দিয়েছিলেন অর্থ জোড়ে। এই টেস্টের ফলাফল যদি নেতিবাচক হয়, আমাদের কর্তারা সেটি করবেন বুলি আউড়িয়ে। তাতে কাজের কাজ যে কিছুই হয় না, সেটি ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়। পরিতাপের যে, শুধু বোর্ড না, আমাদের গণমাধ্যমগুলোও বধির অথবা বেবোধ। নতুবা, চোখের সামনে ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়ার বদলে যত্রতত্র ঐতিহাসিক শব্দটি ব্যবহার করে ভুলের মাত্রা এই হারে বাড়তে দিত না।

ইতিহাস বদলানো যায় না। যা যায়, তা হলো ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া। আবার, ইতিহাস থেকে যে কেউ শিক্ষা নেয় না, এটাও ঐতিহাসিক সত্য। বিসিবির অনুধাবন প্রয়োজন, তারা শিক্ষা নিবে নাকি সমালোচকদের সুযোগ করে দিবে আরো একবার বাংলাদেশের টেস্ট খেলার যোগ্যতা নিয়ে সাওয়াল তোলার? লিখে রাখুন, এই মনোভাবের যদি বদল না হয়; এই সাওয়াল খুঁব নিকটেই উঠবে এবং সেটি আগের চেয়েও জোরেসোরে।