হেফাজত বারবার বলেছে, তারা অরাজনৈতিক সংগঠন। এটা একটা কথার কথা। রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসে আমরা দেখেছি রাজনৈতিক দল আকারে ঘোষণা না দিয়েও নাগরিক সংগঠন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে রাজনীতির অঙ্গনে।এখন যেমন হেফাজত রাখছে কুরাজনীতির পক্ষে। হেফাজতের উত্থান হয়েছিল এক ঐতিহাসিক সময়ে। যখন গেটা বাংলাদেশকে একটা নাস্তিক্যবাদী প্রগতিশীলতা দখল করতে চাইছিল, এক ধরণের দলীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জাগরণ তৈরি করে ফ্যাসিবাদের উত্থান হচ্ছিল, তখন হেফাজত মাঠে নেমেছিল।
স্বাভাবিকভাবেই ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের শিকার হতে হয়েছে তাদের। ৫ মে ইতিহাসের সব চেয়ে ভয়াবহ পুলিশি আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ভিডিও চিত্র ও বিশ্ব মিডিয়ার সংবাদে নিহতের প্রমাণ জনগণ দেখেছেন।
সেই হেফাজতকে জাতায়াত-বিএনপির ফোর্স আখ্যায়িত করে সবাইকে জঙ্গি হিসেবে প্রচার করেছিল সরকার সমর্থক মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীরা।
হেফাজত আমিরের একটি বক্তব্যকে নিয়ে উঠেছিল ঝড়। তেতুল হুজুর বলে কটাক্ষ করা হয়েছিল । এখন সেই তেতুল মিষ্টি হয়ে গেল। হেফাজত-লীগ মিলে একটা অদ্ভূদ পরিস্থিতি আমরা দেখছি। কয়েকটি বিষয় একটু মনোযোগ দিতে হবে :
১. হেফাজত নিয়ে লীগ প্রধান এমন তাদের বুদ্ধিজীবীরা যা বলেছে এতোদিন তাতে লীগ নিজেই জঙ্গিবাদী রাজনীতি শুরু করল হেফাজতকে সাথে নিয়ে। তাদের বুদ্ধিজীবীদের যুক্তি মতে, এরা নিজেরাই এখন জঙ্গি।
হেফাজতের সাথে লীগে ঐক্য একটা টাকা-পয়সার ডিল ও কওমি সনদ নিয়ে করা হয়েছে -এটা সবাই জানেন। এতে এই লুটপাটের ক্ষমতার সুবিধাভোগী হিসেবে হেফাজত ও লীগ এখন ভাই ভাই হল। অন্যদিকে বেকার সমস্যার এই চরম অবস্থায় কওমি সদন দিয়ে কোন চাকরি দেয়া সম্ভব হবে না।
২. হেফাজতের সাথে লীগে ঐক্য একটা টাকা-পয়সার ডিল ও কওমি সনদ নিয়ে করা হয়েছে -এটা সবাই জানেন। এতে এই লুটপাটের ক্ষমতার সুবিধাভোগী হিসেবে হেফাজত ও লীগ এখন ভাই ভাই হল। অন্যদিকে বেকার সমস্যার এই চরম অবস্থায় কওমি সদন দিয়ে কোন চাকরি দেয়া সম্ভব হবে না। এটা একটা অজুহাত। অন্যদিকে এলেম চর্চার যে ঐতিহ্য ও গর্ব ছিল তা এই সরকারি লোভের কাছে বিক্রি হল যা জাতিগত ভাবে আমাদের জন্য লজ্জার।
৩. হেফাজতের উপর সাধারণ মানুষের যে বিশ্বাস ছিল তা খতম হয়ে গেল এমন প্রকাশ্য কৌতুকের রাজনীতির খাদেমদারি করার জন্য।
এমন আরও বহু পয়েন্ট বলা যাবে। কিন্তু আসল যে ক্ষতিটা আমাদের হল তা অতি গভীর :
ক.
এই ফ্যাসিবাদ যখন জনমানুষের কাছে একটা দানবীয় রুপ নিয়ে বিরাজ করছে। সামনে নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশে এক ধরণের মেরুকরণ চলছে। সেই মেরুকরণে গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সংগঠন এক দিকে, লীগ ও তাদের দোসররা আরেক দিকে। দেশে একটি আইয়ুবখানী শাসন চলছে বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন ইতোমধ্যে। এই অবস্থায় হেফাজত ‘৭১ সালের জামায়াতের ভূমিকায় হাজির হল। এই অবৈধ ক্ষমতাকে আরও মজবুত করা এবং আগামিতে জনগণের ভোটের অধিকারকে অগ্রাহ্য করে আবারও ক্ষমতায় আসার সব পরিকল্পনা যখন নেয়া হয়ে গেছে তখন হেফাজতের এই শুকরানা মাহফিলের নামে, পাবলিক পরীক্ষা বাদ দিয়ে এমন জমায়েত। হাস্যকর পদবী দেয়া, দেশের মানুষের স্বার্থকে কোন গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে এমন সমাবেশ, জনগণ ভাবতেই পারেন যে আলেমরা শয়তানের শুকরিয়া আদায় করতে উঠে পড়ে লেগেছে।
সমাজের মানুষ নৈতিক অথরিটি আকারে এখনও আলেমদের বিশেষ করে কওমি আলেমদের সম্মান করেন। সমাজের মূল্যবোধ রক্ষায় তাদের ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। সেই আলেম সমাজ যখন এমন অবৈধ দানবীয় ক্ষমতা ও টাকার কাছে প্রকাশ্যে বিক্রি হয়ে যায় তখন সমাজের নৈতিক ভিত্তির বিলোপ হয়
খ.
সবচেয়ে জরুরি ক্ষতি যেটা হল। তা হচ্ছে, সমাজের মানুষ নৈতিক অথরিটি আকারে এখনও আলেমদের বিশেষ করে কওমি আলেমদের সম্মান করেন। সমাজের মূল্যবোধ রক্ষায় তাদের ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। সেই আলেম সমাজ যখন এমন অবৈধ দানবীয় ক্ষমতা ও টাকার কাছে প্রকাশ্যে বিক্রি হয়ে যায় তখন সমাজের নৈতিক ভিত্তির বিলোপ হয়। গোটা সমাজে অনৈতিকতাই নীতি হয়ে যায়। একজন মানুষ অপরাধ করে তওবা করার জন্য যে আলেমের কাছে যাবে সেই আলেমই টাকার কাছে বিক্রি। ফলে অপরাধী আর তাকে পবিত্র মানুষ মনে করতে পারেন না। এভাবে সে মনে করতেই পারে তার পবিত্র হওয়ার রাস্তাটিও বন্ধ হয়ে গেল।
মুখে ইনসাফের কথা। ইসলামের কথা, শান্তির কথা। জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলা আর জালেমের সাথে ঐক্য করে তার কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে সমাজে টিকে থাকার লজ্জা হেফাজতেকে হাস্যকর ও ইতিহাস বিরুদ্ধ শক্তিতে পরিণত করল।
ভোটের রাজনীতিতে এর প্রভাব খুব বেশি পড়ার কথা না। কারণ মানুষ লীগকে বিশ্বাস করে না। লীগের সাথে যারা যায় তাদেরও বিশ্বাস করবে এমনটা মনে করার কোন কারণ নাই। অন্যদিকে জনগণের টাকায় এইসব কওমি প্রতিষ্ঠান এতো দিন চলছিল। এতে জনগনের সাথে একটা সম্পর্কও ছিল এই প্রতিষ্ঠানগুলোর। এখন এরা যখন লুটপাটের টাকার ভাগিদার হয়ে নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করছেন তখন জনগণ আর এদের সাথে আত্মার সেই টান অনুভব করবে না এটাই স্বাভাবিক। ফলে এটা অনেক বড় ক্ষতি। যারা টাকার গন্ধে অন্ধ আলেম সমাজ বুঝতে পারবে না। তবে যেসব আলেম এই প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন প্রতিবাদ করেছেন তাদের ভূমিকা ঐতিহাসিক বলতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, হেফাজতের আওয়ামীকরণে বাংলাদেশের চলমান নৈতিক সংকটের আরও অবনতি হল। যখন আইনের লোক বেআইনি নীতির মধ্যে থাকে। যখন নীতির এজেন্ট কুনীতির খাদেম হয় তখন গোটা জাতির জন্য অপেক্ষা করে ভয়াবহ জুলুম। এটার অবসানের জন্য প্রকৃত দেশ প্রেমিক ও আল্লাহকে ভয়কারী মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের বিকল্প নাই।