ইন্ডাস্ট্রিতে মামা-কাকা-দাদা খুব জরুরি নয় : পায়েল সরকার

ইন্ডাস্ট্রিতে মামা-কাকা-দাদা খুব জরুরি নয় : পায়েল সরকার

স্মিতভাষী, সদা লাজুক, আবার সাহসী অভিনেত্রী পায়েল সরকার। লাইট, ক্যামেরা অ্যাকশন এর ফাঁকে জীবনের খুটিনাটি, পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে আড্ডা দিলেন জবানের কলকাতা প্রতিনিধি বৈশাখী নার্গিস।

প্রশ্ন : অভিনয়ের ইচ্ছে কি ছোট থেকেই ছিল?

পায়েল সরকার : একদম না। লাস্ট প্লানিং পর্যন্ত অভিনয় নামটি লিস্টে ছিল না। মানুষের প্ল্যান থাকে তো, যে এই অপশনগুলো হতে পারে। আমি একটা করতে চাই, ওটা করতে চাই। প্ল্যান-এ নাহলে প্ল্যান-বি, বা প্ল্যান-সি। তো আমার এটা কোনও প্ল্যানিং-এর মধ্যে ছিল না। কারণ, অবশ্যই একটা যে আমি এরকম কোনও ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ছিলাম না। আমাদের ফ্যামিলিতে সবার একটাই মোটো ছিল যে, মেয়ে পড়াশুনো করবে। এটা নিয়েই ভবিষ্যতে কিছু একটা করবে। তাই অভিনয়ে আসাটা একদম আনএক্সপেক্টেড ছিল আমার কাছে।

ছোটবেলা কোথায় কেটেছে?

পায়েল : আমার জন্ম এবং বেড়ে কলকাতায়। তবে আমার বাবার যেহেতু ট্রান্সফারেল জব ছিল, তাই অনেক জায়গায় ঘুরেছি। দেশের প্রায় বেশ কয়েকটা স্টেট ঘোরা হয়েছে বাবার সূত্রে। কিন্তু কলেজে পড়ার সময় থেকে আবার ব্যাক টু কলকাতা। মোটামুটি বলতে পার বেশির ভাগ সময় আমার কলকাতায় কেটেছে।

ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম ব্রেক-থ্রু পাওয়ার কিছু কথা?

পায়েল : ব্রেক হিসেবেও নয়। আসলে জে ইউতে ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করার সময় ফার্স্ট ইয়ার টেলিভিশনে একটা প্রোগ্রামের জন্য রানা দা, সুদেষ্ণা দি’র কাছ থেকে কল পাই। কারণ আমার কোনও ক্লু ছিল না আর কি। মানে টেলিভিশন অ্যাক্টিং, লাইট ক্যামেরা সম্বন্ধে কোনও ধারণা ছিল না। মনে হয়েছিল খায় না মাথায় দেয় (জেকস আ্যাপার্ট)। তো সুদেষ্ণাদি আমাকে একদিন ফোন করলেন, কোথাও হয়ত আমার ছবি দেখেছিলেন তাই। তিনি টেলিভিশনে একটা কাজ করেছিলেন। আমাকে বললেন, আমি তোমাকে কাস্ট করতে চাই। তুমি কি করবে? আমি ভাবলাম যে ঠিক আছে, এটা ট্রাই করা যেতে পারে। সেটা করতে গিয়ে আমার বেশ পছন্দ হল। লাইট, ক্যামেরা নিয়ে একটা এক্সাইটমেন্ট সবার থাকে। কিন্তু আমারতো সেটা ছিল না। তৈরি হয়ে যায় আরকি। আমার খুব একটা অসুবিধে হয়নি। সেই সময় টেলিভিশনে কয়েকটা টেলিফিল্ম করেছিলাম। দু’একটা সিরিয়ালে কিছুদিন কাজ করেছিলাম। কিছুদিন পরই আমি আই লাভ ইউ-এর অফারটা পাই। আর তারপর থেকে তো ফিল্মটাই প্যাশন হয়ে উঠেছে।

আপনার কি মনে হয় ইন্ডাস্ট্রিতে মামা-কাকা-দাদা থাকাটা খুব জরুরি? নাহলে এগোনো মুশকিল!

পায়েল : না, না। আমাদের এখানে টলিউডে সেটা খুব একটা নেই। কারণ, আমার মনে হয় এই ইন্ড্রাস্ট্রিতে সত্যি যারা ভালো কাজ করছেন, তারা কিন্তু কোনও রকম বাবা-কাকা ছাড়াই কাজ করছেন। যারা ধরো রিলেটেড রয়েছেন । তাদের ভালো খারাপ সবকিছু রেকমেন্ড করতে চাই না আমি। তারা নিজের নিজের ট্যালেন্ট নিয়ে কাজ করছেন। আবার যারা ইনডিভিজুয়ালি কাজ করছেন, যাদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। তারাই বোধহয় বেটার কাজ করছেন। টলিউডে নেপোটিজম সাধারণত নেই । যা বলিউডে খুব দেখা যায়। যতই থাকুক, শেষপর্যন্ত নিজেকেই প্রমাণ করতে হয়। যেমন ধরো, কোয়েল। ওর নিজের যদি পোটেনশিয়ালিটি না থাকত। তবে কি পারত না! অবশ্যই পারত। কারণ, সবকিছুর শেষকথা কিন্তু ট্যালেন্ট। এটা মানতে হবে।

২০০৩-২০১৮ এই জার্নিতে সবচেয়ে ভালো লেগেছে কোন ছবিতে কাজ করে?

পায়েল : দ্যাখো, এতগুলো কাজের মধ্যে থেকে একটা ভালো বলা মুশকিল। প্রত্যেকটাকেই বেস্ট মনে করি। এখন যদি বলি নিজের পাঁচটা আঙুলের মধ্যে কোনটাকে বেস্ট মনে করবে তুমি। প্রত্যেকটারই এক্সপেরিয়েন্স আলাদা। সিনেমা করার এটাই একটা সুবিধা যে সবকিছুরই একটা ভালো খারাপ আছে। আমি অবশ্যই চাই যে নেক্সটা যাতে আরও ভালো করতে পারি। এক একটা সিনেমা আসলে একটা গোটা জার্নি। সিনেমার ক্রিটিকতো দর্শক করবেন। আমরা আমাদের বেস্টটা দিয়ে যাই মাত্র।

এত কাজ করার পর নিজেকে সময় দেন কখন?

পায়েল : নিজের জন্য সময় বেরিয়েই যায়। দ্যাখো, যারা ফিল্ম করে বছরে ৩৬৫ দিনতো শুট করে না, তাদের তো সময় থাকেই। হ্যাঁ বিভিন্ন শো থাকে। কিন্তু সেগুলো বাদ দিয়েও নিজের জন্যে সময় বের করে নেওয়াটা খুব একটা কঠিন নয়। আমি আমার জন্যে সময় বের করে নিউ এসবের মধ্যেও। লাস্ট দু-এক মাস ধরে খুব চাপ ছিল কাজের। ভাবে এখন কিছুটা ফ্রি। কখনও শপিং করতে গেলাম, কখনও মুভি বা স্পা-তে।

কোন ধরণের ছবিতে কাজ করতে বেশি কমফোর্টেবল ফিল করেন? আর্ট ফিল্ম না কমার্শিয়াল। মূলত কমার্শিয়ালে আপনাকে দেখা গেলেও নিজেকে কী দর্শকের কাছে একটু অন্যরকমভাবে তুলে ধরতে চান?

পায়েল : আমি যবে থেকে কাজ করতে শুরু করেছি। আমি সবসময় দুটো দিকই ব্যালেন্স করতে চেয়েছি। খুব কনসাশলি করিনি। অনেস্টলি বলতে গেলে আমার কাছে যেরকম ছবির অফার এসেছে, আমি সেভাবেই  কাজ করেছি। যেমন আই লাভ ইউ করার পর ক্রস কানেকশন করেছি, যা একটা আরবান ফিল্ম ছিল। তারপর প্রেম আমার, লে ছক্কা করেছি। বোঝে না সে বোঝে না, বচ্চন, চতুষ্কোন। আমার কাছে অফারগুলো এভাবেই এসেছে। দু-ধরণের ছবি মিলিয়ে মিশিয়েই এসেছিল, আরকি। আমি নিজেকে লাকি মনে করি, কারণ আমাকে দু’ধরণের অডিয়েন্সই অ্যাকসেপ্ট করেছে। আরও যদি অন্য ধরণের ছবি আসে আমি অভিনয় করতে রাজি আছি। আমার মনে হয় অ্যাজ অ্যান অ্যাক্টর সবার এরকম কাজ করা উচিৎ।

এবার একুট পানসোনাল কোয়েশ্চেন করব, প্রথম প্রেমের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলুন।

পায়েল : প্রথম প্রেমের অভিজ্ঞতা (একটু হেসে) দ্যাখো… প্রত্যেকটা প্রেমের শুরুই আমার কাছে নতুন। আর সবগুলোই অবশ্যই আলাদা অনুভূতি। তাই আলাদা করে স্পেসিফিকালি কিছু বলার নেই। জীবনের জার্নিতে-এটাও একটা পার্ট। অনেক কিছু যাবে, আসবে। অনেক অভিজ্ঞতা হবে। কোথাও গিয়ে নিজের ব্যালান্স জায়গাটা ঠিক রাখতে হয়। তবেই শেষে গিয়ে সেই পারফেক্ট মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া যায়।

ইন্ডাস্ট্রিতে ওঠা নামা থাকেই, খারাপ সময়ে নিজেকে কীভাবে সামলান?

পায়েল : আমার মনে হয় খারাপ সময়ে নিজের প্রতি আস্থা রেখে। একটু ধৈর্য্য ধরে থাকা উচিৎ। একা আমার জন্যে নয়, সবার জন্যেই কঠিন সময়টা পার করা খুব চাপের বিষয় হিসেবেই নিই আমরা। আমি লাকি যে আমার প্যারেন্টসরা আমার সঙ্গে আছেন। তাঁরা খুবই সাপোর্টিভ আর কুল। আমি জানি যে আমার পেছনে তাঁরা আছেন। যা আমার কাছে সব থেকে বড় শক্তি। আমি এখন বুঝি যে, যাদের প্যারেন্টস’র সাপোর্ট থাকে না, তাদের পক্ষে ব্যাপারটা আরো অনেক বেশি কঠিন।

ভালো অভিনয় করা সত্ত্বেও পায়েল সরকারকে ইদানিং কম দেখা যাচ্ছে কেন?

পায়েল : না না, সেরকম কিছু নয়। আমি এ বছরই চারটে ছবি শুট করেছি। শাকিব খানের সঙ্গে একটা ছবি রিলিজ করেছে। আর আমি কোনদিনই বছরে দশটা ছবি করি না। যতটুকু কাজ করেছি, আমি খুশি। ভবিষ্যতে আরও অনেক কাজ করার ইচ্ছে আছে।

অভিনয় জীবনের সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতা!

পায়েল : খারাপ অভিজ্ঞতা বলে কিছু হয় না। হ্যাঁ, অবশ্যই আমি কিছু খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। কিছু খারাপ মানুষের সংস্পর্শে আসা। কিন্তু সেগুলো পার্ট অফ লাইফ। জার্নির মধ্যে কিছু দুঃস্বপ্ন। হয় না কিছু জিনিসি, শরীরে একটু টাচ লাগলেই ধুলো ঝেড়ে ফেলি। জামাটাতো খুলে ফেলি না। তাই এটাও সেরকমই। ধুলো ঝেড়ে ফেলার মতো খারাপ অভিজ্ঞতা তুলে ফেলে দেওয়া। এই নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই।

অনেক সময় একই বিষয় নিয়ে কাজ হয়। অভিনেত্রী হিসেবে বোর লাগে না?

পায়েল : সেক্ষেত্রে সত্যি কথা বলতে গেলে আমার কাছে অপশনটা কম। ডেফিনেটলি বোর হই। সেটা ভাবার জন্য অন্য অনেক প্রডিউসার, ডিরেক্টররা রয়েছেন। আমাদের অ্যাক্টরদের পেরিফেরিটা অনেকটাই থাকে। তাই আলাদা করে কিছু ভাববার সময় হয়ে ওঠে না। ডিফারেন্ট স্ক্রিপ্ট আসবে সেই হিসেবেই কাজ হবে। নতুন যারা আসছেন। খুব ভালো কাজ করছেন। আমার মনে হয়, অন্য ধরণের কাজ করলে সেই বোরডোমটা কেটে যায়।

আচ্ছা, থিতু হওয়ার ইচ্ছে হয়নি কখনও?

পায়েল : মানে, বিয়ে করার কথা বলছ (একটু হেসে)। সত্যি কথা বলতে কি, আমার বাড়ি থেকেও এ ব্যাপারে কোন চাপ নেই। আমি আজকে হিরোইন হয়েছি বলে নয়। আমি এভাবেই বড়ো হয়েছি। আমার বাড়িতে আমি আর বোন। ছেলে বা মেয়ে বলে আলাদা করে কখনও এটা বলা হয়নি যে, তুমি এটা কোরো না, ওটা কোরো না। আমার মা বাবা দুজনেই ওয়াকিং কাপল ছিলেন। আমাদের বাড়িতে ব্যাপারটা বেশ নাইস অ্যান্ড ইজি। মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, বিয়ে দিচ্ছ না এই কথাটা শুনতে হয় নি। আসলে বিয়ের প্রেসারটা নেই। বাবা মা বলেই দিয়েছেন। তোমার যদি কাউকে বিয়ে করে তার সঙ্গে থাকতে ভালো লাগে, তবে তুমি তাই করো। আর কিছু হলেই যে সবটা ভাল হবে এমনটা নয়। কাজেই হ্যাপি থাকাটাই সবার আগে। যদি কাউকে ভালো লাগে, তবে অবশ্যই থিতু হব।

চেনা ছকের বাইরে জীবন?

পায়েল : আমি জীবনে অনেক কিছুই করতে চাই। আমি পুরো পৃথিবী দেখতে চাই। এখন যেমন অ্যাক্টিং করছি। আরও কিছু বছর পর অন্য কিছু করব। এরকম অনেক প্লানই আছে। ঈশ্বর আছেন পাশে। লাইফ হ্যাস টু গো অন। বাড়িতে বসে থাকাটা আমার কাছে পসিবল নয়। অবশ্যই ফিনানসিয়ালভাবে সবাইকে স্ট্যাবল হতে হয়। খুব জরুরিও। অর্থাৎ লাইফে কিছু করাটাই আসল। ফ্যামিলির জন্যে সময় রেখে বাকিটা শুধু কাজ। পৃথিবীর সঙ্গে কানেকশনটা বজায় রাখতে হবে তো। ভালো মন্দ মিলিয়ে জীবনের রসদ খুঁজে নেওয়া।

এই যে চারপাশে এত ঘটনা ঘটছে নারীদের সঙ্গে বা কোথাও পুরুষদের সঙ্গেও। সমাজের একজন বিচক্ষণ নাগরিক হিসেবে আপনার কি মনে হয়?

পায়েল : আমরা একটা সোসাইটির মধ্যে থাকি। সিস্টেম তো চেঞ্জ হচ্ছে ক্রমাগত। কিন্তু একটা চেঞ্জ যখন হবে। শুরুটা একটা প্রবল ধাক্কার মধ্য দিয়েই শুরু হয় সবসময়। কারণ বিভিন্ন ধরণের মানুষের বাস এখানে। কিছু ঘটনা ঘটে আনফরচুনেটলি। অনেকটাই আমরা জানতে পারি। আবার এমন অনেক ঘটনা যা সবার সামনে আসে না। আসলে যখনই কিছু হয়, আঙুলটা ওঠে মেয়েদের দিকে। বদনামের ভাগীদার তাকেই হতে হয়। এটা কেন হবে। একটা অদ্ভুত সোসাইটিতে আমরা বাস করি তো। এসব ভাবা হয় কেন। একটা মেয়ে যখন অন্য কোনও সম্প্রদায়ের ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করছে। সেখানে অনার কিলিং এর মাধ্যমে মেয়টাকে মেরে দেয়া হচ্ছে। এটা কেন? উত্তর সত্যি জানি না। আর এদিকে ভাবতে গেলে- মেয়েটার হাতে কিন্তু কোনও পাওয়ার নেই। পাওয়ারলেস একটা মানুষ সে পরিবারের সুনাম বা দুর্নামের দায়িত্ব নেবে কেন? এটা একটা বড়ো প্রশ্ন।

এগুলো অবশ্যই একটা ফ্যামিলি থেকে ছোটোবেলাতেই ছেলে বা মেয়ের মাথায় ভরে দেওয়া উচিৎ যে। কোনটা ভালো। কোনটা মন্দ। একটা মেয়েকেই কেন ভাগীদার হতে হবে শুধু। কোনটা মন্দ। একটা মেয়েকেই কেন এর ভাগীদার হতে হবে শুধু। আমাদের নিজের বাড়ি থেকে শুরু হোক শিক্ষাটা।

র‌্যাপিড ফায়ার

হবি- অনেক কিছুই আছে। বই পড়া, গান শোনা, শপিং

ভয়- অনেস্টলি এখন কোনও কিছুতে ভয় পাই না

রাগ- রাগ হয় যখন কেউ পেছনে কথা বলে

পছন্দের খাবার- ইটালিয়ান

পছন্দের আউটিং প্যারিস, সুইটজারল্যান্ড

নিজেকে দশের মধ্যে কত দেবেন- এটা না হয় অডিয়েন্সের জন্য ছেড়ে দিলাম