পর্দার পিছনের পেরেজ : দেবদূত নাকি কালপ্রিট? পর্ব- ০২

পর্দার পিছনের পেরেজ : দেবদূত নাকি কালপ্রিট? পর্ব- ০২

[প্রথম পর্বের পর]

এবার পুনরায় পেরেজে ফিরি। প্রথম দফার ব্যর্থতা থেকে তিনি শিক্ষা নিবেন বলেই আশা করা হচ্ছিল। চলতি দায়িত্বে চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগা সহ সকল মেজর শিরোপা জেতায় সাদা দৃষ্টিতে মনে হতে পারে পেরেজ ঠিকই শিক্ষাটা নিয়েছেন। গভীরের চিত্রটা কি একই রকম?

পেরেজ পুনরায় দায়িত্ব নিয়েই আবারো লাগলেন গ্যালাক্টিকোস গড়ার পেছনে। কাকা, রোনালদো, ওজিল, আলোনসো, বেনজেমা, বেল; বড় বড় সব নাম আবার ভীড় করতে শুরু করলো বার্নাব্যুতে। প্রথম দফার চেয়ে এ দফায় সাফল্যের হার বেশি থাকলেও ধারাবাহিকতা আসেনি। বদল আসেনি ট্রান্সফার নীতিতে। বদলায়নি তারকা মোহ। সবচেয়ে বড় কথা, সহজ ভাবেই বোঝা যায় যে তিনি বার্সার সাফল্যের কারণগুলো নিয়ে একবারও ভাবেননি। এটাকে চাইলে একগুয়েমি বলতে পারেন; তবে পেরেজকে খুঁব ভালো করে যারা চিনেন তাদের মতে এটি তার দাম্ভিক চরিত্রেরই একটি প্রতিফলন।

প্রথমে নজর দেয়া যাক ট্রান্সফার পলিসির দিকে। ‘১০ এর বিশ্বকাপ মাতানো মাত্রই ওজিল, ডি মারিয়ায় মুগ্ধ হলেন তিনি। কিন্তু পরের বিশ্বকাপে মজলেন হামেসে। যার ফলে ক্লাব ছাড়লেন ওজিল। অথচ, ততদিনে রোনালদো ওজিল জুটি বেশ জমে উঠেছে। এটি ভাঙ্গবার আগে অন্য কেউ হলে দশবার ভাবতেন। হামেস রিয়ালের জন্য ফিট কি না, সেটিও ভাবলেন না একবারও। ফলাফল? বর্তমানে বায়ার্নে লোনে বেশ ভালো সময় কাটাচ্ছেন তিনি। ঠিক ম্যাকেকেলের ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটলো যেন আলোনসোর সাথে। লা দেসিমা জয়ের অন্যতম মূল কারিগর অবহেলায় ক্ষুদ্ধ হয়ে যোগ দিলেন বায়ার্নে। ততদিনে ডাগ আউটেও বদল হয়ে গিয়েছে একটি মুখ। মোরিনহোর জায়গায় আঞ্চেলোত্তি। দেসিমা জয়ের আরেক কারিগর ডি মারিয়াও ক্লাব ছেড়েছেন পেরেজে ক্ষুদ্ধ হয়েই। বেলকে নিয়ে আসলেন বার্সার সাথে ইগোর লড়াইয়ে জড়িয়ে। নেইমারকে আনতে না পারায়। নেইমার, সুয়ারেজ, মেসির যে ত্রয়ী; যা এমএসএন নামে পরিচিত ছিল তাতে প্রত্যেকেরই মূখ্য অবদান ছিল। হ্যাঁ, মেসিই মুলে ছিলেন, কিন্তু সুয়ারেজ বা নেইমারের ভূমিকাও ছিল দারুণ। কিন্তু; বেল, বেনজেমা এবং রোনালদোকে নিয়ে গড়া যে বিবিসি তা কি অদৌ বিবিসি ছিল? বেনজেমা মূলত রোনালদোকে পজিশন ক্রিয়েট করে দিতেন অন দ্য বল বা অফ দ্য বল মুভমেন্টে। আর বেলের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে নার্সের সেবায়। এখানে ইগোর লড়াইয়ে না জড়িয়ে যদি আরো একটু বিবেচনার সাথে সিদ্ধান্ত নিতেন, ফল অন্যরকম হতেও পারত। পরবর্তী কোচ এ বেলায়ই দেখুন; কার্লোর জায়গায় রাফা তারপর জিদান এবং সবশেষে লোপেতেগি হয়ে সোলারি। কার্লো আঞ্চেলত্তির বিকল্প কি করে রাফা বেনিতেজ হন, এর উত্তর বোধ করি কারো পক্ষেই দেয়া সম্ভব না। রাফায় জায়গায় জিদানকে বসিয়ে দেয়াটা ছিল একটা বিশাল জুয়া। সেটায় জিতেছেন বলে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু, আবারো সেই একই ভুল; জিদানের জায়গায় লোপেতিগে! তার দর্শন, ধরণ কোন দিক দিয়ে রিয়ালের সাথে যায়? যথেষ্ট সময় ছিল জিদানের পর কোচ নিয়োগের। কিন্তু পেরেজ পেরেজীয় ধারা বজায় রেখে হুট করেই লোপেতিগেকে নিয়ে আসলেন। ফলাফল? ১৩৯ টি কালোদিন!

কোচ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পেরেজ অন্ধ আনুগত্যকে প্রাধান্য দেন বলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। তবে, পুরোটা সময় খেয়াল করলে এটিকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা কঠিন। কেননা, মোরিনহোর বা আঞ্চেলোত্তির ব্যাক্তিত্ব আর যাই হোক অন্ধ আনুগত্য প্রকাশ করার মতন না। আবার রাফা বা লোপেতিগেকে দেখলে এটাও অবিশ্বাস্যও মনে হয় না। মোটামুটি যেটা বলা যেতে পারে সেটা হচ্ছে, তিনি কোচ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কখনোই দূরদর্শিতার প্রমাণ রাখতে পারেননি। যখন যে সফল হয়েছে অন্য ক্লাবে তার ওপর ভরসা করেই সাফল্য পেতে চেয়েছেন, সেটি যখন কাজে আসেনি তখন হাতের সামনের সবচেয়ে সহজ অপশনটিই বেছে নিয়েছেন। যেখানে বার্সা বোর্ড সম্পুর্ণ ব্যতিক্রম। একটি দু’টি বাদ দিলে তাদের প্রত্যেকটা নিয়োগই ছিল সুচিন্তা প্রসূত। পেরেজ যে সেটাকে তোয়াক্কাই করেননি সেটা তো স্পষ্টই।

ট্রান্সফার নীতির সবচেয়ে উদোম চিত্রটি দেখা যাচ্ছে এবার। ব্যবসায়ীক দিক বিবেচনায় রোনালদোকে বিক্রি করার সিদ্ধান্তটি সঠিক মনে হতে পারে। কিন্তু, রিয়ালে রোনালদো যে প্লেয়িং টাইম পেতেন তাতে তার বিকল্প গড়ে তোলা কঠিন ছিল। কেউ নেই বলা যায়। সেক্ষেত্রে অন্য কাউকে এনে শূণ্যস্থান পূরণের সামান্য উদ্যোগও তিনি নেননি। এর পিছনের কারণ হিসাবে যেটি সবচেয়ে কাছাকাছি মনে হয়, সেটি যথারীতি তার তারকাদের প্রতি অবসেশন। নেইমারকে রিয়ালে আনার কল্পনাকে বাস্তবে রুপ দিতে গিয়ে বর্তমান হালত কে করে তুলেছেন বিবর্ণ। রিয়ালের আরো একটি অন্যতম মূল সমস্যা রক্ষণ। আরো স্পষ্ট করে বললে পেপের অভাব। এখানেও তিনি চাইলে বার্সার কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারতেন। পুয়োলের অভাব পূরণে বার্সা প্রায় বিলিয়নের কাছাকাছি খরচ করছে। যতক্ষন পর্যন্ত তারা সঠিক বিকল্প পায়নি বলে মনে করেছে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। এখনো পুরোপুরি পুয়োল মানের কাউকে না পেলেও যার ফলে বার্সার রক্ষণে বড় ফাটল দেখা দেয়নি। পেরেজ পেপের শূণ্যস্থান পূরণের দৃশ্যত কোনো উদ্যোগই নেননি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তার চোখ এখন শুধুই নেইমারের ওপর। যতক্ষণ এর আনুষ্ঠানিক ইতি না ঘটবে বিকল্প কিছু তিনি ভাববেন এমন আভাসও নেই।

রোনালদোর মতন একজন কে ছাড়ার জুয়া খেলার মতন কেউ যদি থেকে থাকেন সেটি পেরেজই। তার এই জুয়ার খেসারত শুধু তিনিই না রিয়ালও দিচ্ছে সমান তালে। ভবিষ্যত নিয়ে তার পরিকল্পনাও কখনো স্পষ্ট না। এবার যেমন বড় অঙ্ক খরচ করে ভিনিসিয়াস জুনিয়রকে দলে ভেড়ালেন, অথচ তাকে মূল দলে খেলানোর খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না! একই ঘটনা দেখা যায় ইয়ারামেন্দি, সাবেয়োস, ক্যালেহো বা আদ্রিওজোলাদের বেলায়ও।

দুটো সময়কে পাশাপাশি রাখলে পরস্পর বিরোধী একটি চিত্র ফুটে ওঠে। প্রথমবার যেমন, একই পজিশনে একাধিক বিশ্বমানের খেলোয়াড় কিনেছেন পরের দফায় শূণ্যস্থান পূরণেও আগ্রহী বলে মনে হয়নি। অন্তত এখনো হচ্ছে না।

সব মিলিয়ে বলা যায়, পেরেজ পরিকল্পনার বদলে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেকটা জুয়া খেলতেই ভালোবাসেন। যার ফলে কখনো সিদ্ধান্ত তার পক্ষে যায়, কখনো বিপক্ষে। কিন্তু তা থেকে তিনি কিছু শিখেছেন এমনটা অন্তত দেখা যায় না। যার ফলে তাকে দাম্ভিক মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক না। রাউল কিছুটা রাখঢাক রেখে নব্বইয়ের শেষের দিকে দুর্দান্ত রিয়ালকে ভাঙ্গার দায় পেরেজের ওপর চাপিয়েছেন। মরিয়েন্তেস সোজা সাপ্টাই বলে দিয়েছিল গ্যালাক্টিকোসের চিন্তা রিয়ালের ক্ষতি বৈ কোনো লাভ করে নি। এটা যেমন একদিকে নির্মোহ সত্য। তেমনি রিয়ালের জন্য অর্থ ঢালতে কখনোই কার্পন্য না করে যেভাবেই হোক সফলও তিনি হয়েছেন।

পুরো লেখার শেষ পর্যায়ে এসেও উপসংহারে আসাটা প্রায় অসম্ভবই ঠেকছে। পেরেজকে বর্তমানে যেমন ভিলেন রুপে চিত্রায়িত করা হচ্ছে সেটি এক ধরণের অন্যায়ই তার প্রতি। আবার এর বিপরীতে গিয়ে তাকে সমস্ত কৃতিত্ব দিতে যাওয়াও হবে বোকামি। অতীত বিবেচনায়ই বোঝা যায় যে, বার্সা থেকে তো দুর, নিজের অতীত থেকেও তিনি শিক্ষা নিবেন বলে মনে হয় না। এখন দেখার বিষয় তার নতুন জুয়ার চাল রিয়ালকে কোন পথে নিয়ে যায়।

এটা নির্মোহ সত্য যে, চরম বিপদের সময় সে রকম সাহসীকতা নিয়ে পেরেজ এগিয়ে না আসলে রিয়াল রিয়াল থাকত কি না সন্দেহ। সে ক্ষেত্রে তাকে দেবদূত মনে করা যায়। আবার ইতিহাসই বলে তার সময়ে রিয়ালের যে ব্যার্থতা তার দায় বহুলাংশে তার ওপরই বর্তায়। সে হিসাবে তাকে কালপ্রিট মনে করাটাও অস্বাভাবিক না। তবে, আমার মতে পেরেজ একজন নিখাঁদ মাদ্রিদিস্তা। যিনি প্রচণ্ড রকমের দাম্ভিক। আর এই দাম্ভিকতাই শুধু তার না, রিয়ালের সাফল্যের পেছনের অন্যতম অন্তরায় হয়ে রয়েছে।

পর্দার পিছনের পেরেজ : দেবদূত নাকি কালপ্রিট? পর্ব- ০১