পাঁচ টাকার একটি কয়েন, কতটুকুই বা ক্ষমতা তার? ক্রয়ের ক্ষমতা বাদই দি, জীবনের গল্প একটি পাঁচ টাকার কয়েনে বদলে যাবে; এমনটি বললে পাগলেও বিশ্বাস করবে না। অথচ, এই পাঁচ টাকার কয়েনটিই বদলে দিয়েছে দু’টি জীবনের গল্প। এটা শুধু নিছক বলার জন্যই বা বলা না; সত্যিই পাঁচ টাকার কয়েন জন্ম দিয়েছে আশ্চর্য এক বিরহের গল্পের।
দেবের বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা। বদলির চাকরি হবার ফলে কোনো জায়গায়ই দেবের সেভাবে কারো সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেনি। ঘটনার সূত্রপাত ঘটে দেবের বাবা যখন কক্সবাজার জেলার এক প্রত্যন্ত উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে যোগ দেন তখন। নতুন জায়গা, নতুন স্কুল; দেবের কাছে মাঝে মধ্যে বিরক্তিকরই মনে হত বিষয়টি। কিন্তু, নতুন এই জায়গায় বদলে যায় সবকিছু।
স্কুলে ভর্তি হবার কিছুদিনের মধ্যেই দেব রেমির নাম শুনতে পায়। রুপেগুণে অনন্যা এই কিশোরীর নাকি তুলনা নেই। দেব কথাটা তেমন গায়ে মাখেনি। নিতান্তই অজ পাড়া গাঁয়ের এক মেয়ে, কতটুকুই বা আকর্ষণ করার ক্ষমতা তার? আর যে সময়কালটার কথা বলছি তখন স্কুল পড়ুয়াদের মাঝে ভালোবাসা বিষয়টি এত সহজবোধ্যও ছিল না। কট্টর ধর্মান্ধদের এলাকা। যারা ফলে কম্বাইন্ড স্কুল হবার পরেও ক্লাস সেভেন পর্যন্ত ছেলে-মেয়েদের ক্লাস হত আলাদা। এইট থেকে এক সাথে হলেও মেয়েরা স্যারদের সাথে ক্লাসে ঢুকত, ক্লাস শেষে স্যারদের সাথেই বের হয়ে যেত। ফলে, কতা বলা তো দুর, দেখা হওয়াটাও ছিল দুরহতম বিষয়। কারণ, ক্লাস এইট থেকে নেকাব ছিল বাধ্যতামূলক।
সেভেনে থাকতেই দেব বহুবার রেমির নাম শুনলেও কোনোদিন দেখার আগ্রহ দেখায়নি। দেবের মেয়েদের প্রতি অনাসক্তিও এর অন্যতম একটি কারণ ছিল। রেমির সাথে দেবের দেখাটা হয় হঠাৎই। একদিন পথিমধ্যে দেব তার দুজন বন্ধুসহ বাড়ি ফিরছিল। রেমিও সেদিন বাড়ির পথের বদলে এক বান্ধবীর বাসায় গিয়ে ফিরছিল। সে সময়ই দুজনের প্রথম দেখা। আর সে দেখাটাই বদলে দেয় দেবকে। বলতে নেই, রেমি সত্যিই ছিল আশ্চর্য্য সুন্দর। শান্ত, সৌম্য শ্বেত শুভ্র এক প্রতীমা যেন। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল রেমির চোখ। ঐরকম শান্ত টলটলে চোখ খুব কমই দেখা যায়। এদিনের পরেই বদলে গেল দেবের জীবন।
দেব নিয়মিত স্কুল কখনোই করত না। কিন্তু রেমিকে দেখার এক অবিশ্বাস্য টানে দেব নিয়মিত স্কুলে হাজিরা দিতে শুরু করল। এটাকে ভালোবাসা বলা কঠিন, কারণ ভালোবাসা বোঝার মতন মানসিকতা তখনও দেবের হয়নি। বিপত্তি বাঁধলো ক্লাস এইটে। তখন তো বৃত্তির প্রচলন ছিল। স্কুলে সিদ্ধান্ত হল যারা বৃত্তি দিবে তাদের জন্য একটি ক্লাস আর যারা দিবে না, তাদের জন্য আরো একটি। দেবের নূন্যতম ইচ্ছা ছিল বৃত্তি দেবার। কিন্তু সে জানত রেমি বৃত্তি দিবেই। ছাত্রী হিসাবে স্কুলে তো বটেই পুরো উপজেলাতেই রেমির বেশ নামডাক ছিল। যা হবার তাই হলো। রেমি বৃত্তি দিবে ঠিক করলো। অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে পথই অনুসরণ করল দেবও।
রেমির ক্লাসে ঢুকা থেকে শুরু করে স্কুল ছাড়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত দেবের চোখ খুঁজে ফিরত রেমিকেই। পরীক্ষার সময় কেন্দ্র থাকত আলাদা। যতক্ষণ রেমি পরীক্ষার হলে না ঢুকত ততক্ষণ পর্যন্ত দেব ঠাই বারান্দায় দাড়িয়ে থাকত রেমিকে এক নজর দেখার জন্য। এইট শেষে হয়ে ক্লাস নাইন। সেখানেও বিপত্তি। দেব চোখ বন্ধ করে মানবিকে যেতে চাইলেও জানত রেমি বেছে নিবে বিজ্ঞান বিভাগ। দেবের অনুমানই সত্য হল। রেমিকে দেখার লোভে রাষ্ট্র বিজ্ঞান পড়ার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেবও বিজ্ঞানকেই বেছে নিলো। ততদিনে রেমির প্রতি দেবের আকর্ষণ এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে ১০৩° জ্বর গায়েও দেব ক্লাসে হাজির রেমিকে দেখার লোভে। তার কতটা রেমি বুঝেছে বা আদৌ বোঝার চেষ্টা করেছে কি না দেব কখনো জানার চেষ্টা করেনি।
ক্লাস নাইনের মধ্যপথেই দেবের বাবার বদলির আদেশ হলো। আর দেবের মধ্যে অহর্নিশ এক যন্ত্রণার। রেমিকে না দেখে থাকার কল্পনাও যে তখন পাপ। কিন্তু জীবন মোড় নেয়। তাই দেবকেও বাবার সাথে চলে যেতে হলো পার্বত্য এক জেলায়। তখন মোবাইলের যুগও না, যার ফলে রেমির সাথে যোগাযোগের কোনো পথও আর রইলো না। ততদিনে দেব এটুকু বুঝেছে যে রেমিকে না দেখে থাকাটা তার কাছে চরম শাস্তির ন্যায়। বহু ভাবনার পর একটি বুদ্ধি বের করলো দেব, যেটি পরবর্তিতে হয়ে রইলো সারা জীবনের আক্ষেপ।
নিজের সমস্ত অনুভূতির কথা চিঠিতে লিখে রেমিকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল দেব। কিন্তু, প্রত্যাখ্যানের ভয়ে শব্দ বাছাই করল খুব সতর্কতার সাথে। দেবের বরাবরই মনে হতো রেমি তাকে প্রত্যাখ্যান করবে। কারণটা দেব নিজেও জানে না। রেমি দেখতে সুন্দর, দেবের চেয়ে ভালো ছাত্রী এটাই বোধহয় সব সময় কাজ করত মাথায়। চিন্তামতন একটি চিঠি লিখেও ফেলল দেব। কিন্তু ততদিনে দেবকে নিয়ে রেমির ভাবনাটা জানার তীব্র ইচ্ছাও যোগ হয়েছে মনে। তাই, চিঠির শেষে একটি বাক্য লিখে দেব। যেখানে বলে, যদি রেমির পত্রযোগে যোগাযোগে আপত্তি না থাকে তাহলে যেন চিঠির সাথে একটি পাঁচ টাকার কয়েন দিয়ে দেয়। বদলের গল্প শুরু এখানেই।
দেব চিঠিটি পাঠিয়েছিলো এক বন্ধুর ঠিকানায়। দু’জনের মধ্যে সেতু হিসাবে কাজ করছিল সেই বন্ধুই, রিদুয়ান। দেবের খেয়ালি আচরণ, প্রাণোচ্ছল চলাফেরা রেমির মনেও যে তখন হালকা দাগ কেটেছে। তাই, চিঠির সাথে ঠিকই পাঁচ টাকার একটি কয়েন দেয় সে রিদুয়ানের কাছে। কিন্তু, রিদুয়ান সেটিকে নেহায়েত একটি কয়েন ভেবে নিজের কাছেই রেখে দেয়। ঐদিকে চিঠির জন্য অস্থির দেব।
চিঠি আসে ঠিকই কিন্তু কয়েন আর আসে না। ঐদিকে রেমি অপেক্ষায়। কারণ, দেবের কথামত কয়েন দেয়ায় পরের চিঠিতে আরো কিছু জানার প্রত্যাশায় অপেক্ষা করছে সে। কিন্তু, রিদুয়ানের অনিচ্ছাকৃত ভুলে কয়েনটি না পেয়ে প্রত্যাখান ভেবে ভেঙ্গে পড়ে দেব। আর দেবের চিঠি না পেয়ে পুরো বিষয়টিকেই দেবের আরেকটি খামখেয়ালি ভেবে নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে যায় রেমি।
দশ বছর পর….
মাত্রারিক্ত সিগারেটের আসক্তিতে দেবের লাঙ্গসে সমস্যা দেখা দেয়। মৃত্যুর সাথে শুরু হয় এক অলিখিত লড়াই। রেমির কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অন্য একজনের সাথে সম্পর্কে জড়ায় দেব। জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে সে দেবকে ছেড়ে চলে যায়। মরিয়া দেব তখন পাগলের মত খুঁজতে থাকে রেমির সাথে যোগাযোগের পথ। শেষে ফেসবুকে জানায় রেমির প্রতি নিজের ভালোবাসার কথা। ততদিনে রেমির অভিমান জমাট বাঁধা পাথর। এটিকেও দেবের আরেকটি হেয়ালি ভেবে কড়া ভাষায় প্রত্যাক্ষাণ করে রেমি। জানতে চায় দশটা বছর পর ভালোবাসা জানানোর কারণ?
দেবও নাছোড়ের মত একের পর এক মেসেজ দিতে থাকে রেমিকে। কখনো উত্তর আসে, কখনো আসে না। কথায় কথায় একদিন রেমি জানতে চায়, দেব তাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি মত আর চিঠি দেয় নি কেন? তখন দেব জানায় রেমিও তো কোনো কয়েন পাঠায় নি। রেমি সাথে সাথে জানায় কয়েন সে পাঠিয়েছিল, এবং অপেক্ষায় ছিল পরের চিঠিটার। প্রথম চিঠিটি যে তার তখনো মুখস্ত সেটিও জানাতে ভুলে না রেমি। শুনে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে দেবের। সাথে সাথেই ফোন দেয় রিদুয়ানকে। রিদুয়ান জানায় ঐ কয়েনটিকে নেহায়েত একটি কয়েন ভেবে পাঠায়নি সে! উত্তরটা শোনা মাত্রই দু গাল বেয়ে অবাধে অশ্রু নামে দেবের।
দশ বছরে বদলে গিয়েছে বহু কিছু। রেমিকে বহুবার বলেও আর মন গলাতে পারে না দেব। দূর থেকে দেবকে থেকে নিঃশব্দেই চলে যায় রেমি। যেমনি নিঃশব্দে ইতি ঘটে গিয়েছিল প্রণয় সম্ভাবনার। রেমিকে আর রেমি না, মেঘ বলে ডাকে দেব। রেমি না করে না, কিন্তু নিজের অনুভূতিটাও কখনো বুঝতে দেয় না। জীবনে বহু ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে দেব এখন লেখক। রেমিকে নিয়ে একের পর কবিতা লিখে চলেছে সে। কিন্তু, সে পাঁচ টাকার কয়েনটা বদলে দিয়েছে দু’টি জীবন।
যেখান থেকে হতে পারত একটি গল্পের শুরু, সেখানেই একজনের খাম খেয়ালিতে শেষ হয়ে গিয়েছে গল্পটা। জীবনটাই যে মাঝে মাঝে হয়ে উঠে গল্পের মতন…
তাই দেব আর রেমিরও এক হওয়া হয়না। অভিমানের কাছে হার মানে ভালোবাসা। রেমিকে না পেয়ে অন্য কারো সাথে জড়ানো, মরণযুদ্ধের সময় রেমিকে ভালোবাসার কথা জানানোকে রেমি নিয়েছে দেবের মোহ হিসাবে। আর দেব এক তরফাই নিজের ভুল শিকার করে দিন গুণে যাচ্ছে রেমির ভাবনার বদলের জন্য। জীবনটাই যখন গল্প, তখন তার পরিণতিও গল্পের মতন হলেই মন্দ কি?