জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে আওয়ামী লীগ অবশেষে সংলাপে বসতে রাজি হয়েছে। এই সংলাপকে ঘিরে চলছে নানান গুঞ্জন। আশা-আশঙ্কার শেষ নেই সংলাপ নিয়ে। কেউ কেউ আবার আশার আলোও দেখছেন। কিন্তু এই সংলাপে কে কতটা সিরিয়াস, এবং এই সংলাপকে সফল করতে যে সব বিষয় জরুরিভাবে গুরুত্ব দিতে হবে সংক্ষেপে সেই সব পয়েন্টের উপর নিচে আলোচনা করার চেষ্টা করছি।
১.
কোন সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে বিনা রক্তপাতে উত্তরণের জন্য দুই পক্ষ সংলাপে বসে। এই দুই পক্ষের দাবি দাওয়া সাধারণত পরস্পর বিপরীতমুখি হওয়ায় সংকটের সৃষ্টি হয়।
এক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আর আওয়ামী লীগের দাবি দাওয়া পরস্পর বিপরীতমুখী হলেও ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শরীক বিএনপি এককভাবে সবচেয়ে বেশি সংকটাপন্ন অবস্থানে আছে আর আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত কোন সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে পড়ে নাই বা আওয়ামী লীগকে বিরোধী দলগুলো কোন সংকটে ফেলতে পারে নাই। এটা লীগের নেতারাও ক্রমাগত মিডিয়াতে এতোদিন বলেছেন। আসলে যে অনির্বাচিত শাসন চলছে এটাই দেশের মৌলিক সব কাঠামো নষ্ট করে দিচ্ছে। কাজেই এটাই বড় সংকট। কিন্তু ক্ষমতায় থাকলে নীতির প্রশ্ন নিয়ে আমাদের দেশের দলগুলো চিন্তা করে না। ফলে তাদের চোখে কোন সংকট ধরা পড়ছে না। প্রশাসনকে নিজেদের মতো ব্যবহার করে, একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে, লাখ লাখ মামলা ও অনেক মানুষকে জেলে বন্দি করে যদি ক্ষমতাসীনরা বলে কোন সংকট সৃষ্টি হয়নি তা হলে বুঝতে হবে রাজনৈতিকভাবে আমরা সন্ত্রাসের যুগে বাস করি। যা হোক ক্ষমতাসীনদের চোখে সংলাপের মাধ্যমে সংকট উত্তরণের কোন পরিস্থিতি এখনও সৃষ্টি হয় নাই।
তার পরেও সংলাপের ডাকটা কৌশলগত। মনে রাখতে হবে. ২০১৪ সালেও এই সংলাপের নাটক জাতি দেখেছেন। তখনও সরকারি দল প্রথমে খুব আগ্রহী ছিল কিন্তু পরে ঠিকই একতরফা নির্বাচন করে ১৫৪ জন অনির্বাচিত সাংসদকে নিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেছেন। কাজেই বিষয়টিকে সরকারের কৌশল হিসেবেই দেখতে হবে।
২.
সংলাপের আগে উভয়দল তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে। প্রকাশ্যে তাদের দাবিদাওয়া পেশ করে। এক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাদের ৭ দফা দাবি পেশ করেছে। এই ৭ দফা দাবির অন্যতম প্রধান দাবি হচ্ছে বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে. বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দিতে হবে।
আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে সংবিধানের দোহাই দিয়ে এসব দাবি প্রত্যাখান করেছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, তারা সংবিধান মেনেই নির্বাচন করবে। একটি পয়েন্ট মনে রাখতে হবে, ক্ষমতাসীনরা যে ভাবে নিজেদের সুবিধামতো সংবিধান সংশোধন করেছেন।
আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে সংবিধানের দোহাই দিয়ে এসব দাবি প্রত্যাখান করেছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, তারা সংবিধান মেনেই নির্বাচন করবে। একটি পয়েন্ট মনে রাখতে হবে, ক্ষমতাসীনরা যে ভাবে নিজেদের সুবিধামতো সংবিধান সংশোধন করেছেন তাতে ঐক্য জোটের বেশ কয়েকটি দফা বর্তমান সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। সরকার সাধারণ জনগনকে বুঝাতে চেষ্টা করছে।
আওয়ামী সরকার সংবিধান মেনে আইনগতভাবে সঠিক অবস্থানে আছে। এক্ষেত্রে সাধারণ জনগণকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচনের সময়ে ক্ষমতায় থেকে নিজ স্বার্থে সরকারের সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে নির্বাচনের ফলাফল ঘরে তোলার লক্ষ্যেই সংবিধান পরিবর্তন করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুবিধি বাতিল করে দিয়েছে। আবার এও মনে করিয়ে দিতে চাই যে নিকট অতীতে আওয়ামী সরকারের সংসদের এক সভাতেই আইন পরিবর্তনের রেকর্ড আছে। সেখানে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আইন পরিবর্তন করে বর্তমান সংসদ ভেঙে দেয়া এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধিনে জাতীয় নির্বাচন করা কোন ব্যাপারই না। অন্যদিকে ড. কামাল তো বলেছেনই, এটা এক মিনিটের ব্যাপার। আর এটা তো মূল সংবিধান না। এটা সংশোধনী। কাজেই আদালত চাইলে এই সংশোধনী স্থগিত করে দেশকে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথে সাহায্য করতে পারে। সেটা অবশ্য নির্ভর করছে শাসকরা ক্ষমতাকে নিজেদের করে রাখতে চায় না জনগনের অধিকারের প্রশ্নে গুরুত্ব দেয় সেই মনোভাবের উপর।
অন্যদিকে ড. কামাল তো বলেছেনই, এটা এক মিনিটের ব্যাপার। আর এটা তো মূল সংবিধান না। এটা সংশোধনী। কাজেই আদালত চাইলে এই সংশোধনী স্থগিত করে দেশকে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথে সাহায্য করতে পারে।
৩.
নেগোসিয়েশান আর সংলাপে সিরিয়াস হলে উভয়পক্ষ থেকে একজন কমন মধ্যস্থতাকারী বা বিশেষ দূত নিয়োগ করা হয়। যার প্রতি উভয় দলের আস্থা থাকে। এই মধ্যস্থতাকারী প্রধান সংলাপের আগে দুই দলের মাঝে দৌড়াদৌড়ি করে, দুই দলের সাথে কথা বলে উভয়কে সংলাপের জন্য তৈরি করে। পরে দিনক্ষণ দেখে একটা নিরপেক্ষ ভেন্যুতে উভয় দল সংলাপে বসে।
কিন্তু বর্তমান পরিস্তিতে এই রকম কোন কিছুই এখনও পর্যন্ত দেখা যায় নাই। দুই পক্ষের অবস্থান আর দাবি পরস্পর বিপরীতমুখি হওয়া স্বত্বেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিজ থেকে সংলাপে বসতে চেয়েছে আর আওয়ামী লীগ বলেছে আমাদের দুয়ার খোলা, আসুন। এখানে কোন মধ্যস্থতাকারী নাই। অথচ দুই দলের মাঝে পারস্পরিক বিশ্বাস আর শ্রদ্ধাবোধও নাই। এই পরিস্থিতিতে কেউ কারো কথা শুনবে বলে বিশ্বাস করা কঠিন। কেবল দুই দল তাদের বক্তব্য পেশ করে যাবে। ফলাফলের ঝুলিতে শুন্যই থেকে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। কাজেই সংলাপ সফল করতে এই বিষয়টি বিবেচনায় দেয়া দরকার।
৪.
সংলাপে দুই দল মুখোমুখি বসে মীমাংসা করে। নেগোসিয়েশানে উভয় দল দুই দিক থেকে কিছু ছাড় দিয়ে একটা কমন উপলব্ধিতে আসে। আর পরিশেষে একসাথে কাজ করে।
আর শেখ হাসিনা ছাড় দেয়ার রাজনীতি করেন না। ড. ইউনুসের বেলায় হিলারি ক্লিনটনকে মানেন নাই, পদ্মা সেতুর ব্যাপারে ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে মানেন নাই, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের তারানকো’র কথা শোনেন নাই। শহিদুল আলমের জন্য ১০০ নোবলে বিজয়ী কথা বললেও তিনি শোনেন নাই। তিনি মুখে যাই বলুক মনে মনে যা ঠিক করেন তাই করেন শেষ পর্যন্ত তাই করেন।
দিন শেষে এই নেগোসিয়েশানই হয় সংলাপের মুল উদ্দেশ্য। কিন্তু এই পর্যায়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আর আওয়ামী লীগের আসতে এখনও অনেক দেরি। আওয়ামী সভানেত্রী শেখ হাসিনার অতীত কার্যক্রম প্রমাণ করে তিনি কোন ছাড় দিবেন না, কোন প্রকার নেগোশিয়েশানে যাবেন না, কোন মধ্যস্থতাকারী মানবেন না। আর সরকারের প্রতি কোন আস্থা জনগণের নাই। কারণ সরকার যতটা ওয়াদা করেছেন সবই ভঙ্গ করেছেন কোন না কোন ভাবে। আর বাংলাদেশের ইতিহাসেও এই ধরণের সংলাপ সফল হয়েছে এমন কোন নজির নাই। সংলাপ হয়েছে কিন্তু পরিস্থিতির কোন পরির্বতন হয়নি। প্রতিটি নির্বাচনের আগে কোন না কোন প্রক্রিয়ায় সংলাপ হয়েছে। অনেক বারই দুই প্রধান দলের মহাসচিবরা বসেছেন কিন্তু কোন ফল আসে নি। আর শেখ হাসিনা ছাড় দেয়ার রাজনীতি করেন না। ড. ইউনুসের বেলায় হিলারি ক্লিনটনকে মানেন নাই, পদ্মা সেতুর ব্যাপারে ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে মানেন নাই, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের তারানকো’র কথা শোনেন নাই। শহিদুল আলমের জন্য ১০০ নোবলে বিজয়ী কথা বললেও তিনি শোনেন নাই। তিনি মুখে যাই বলুক মনে মনে যা ঠিক করেন তাই করেন শেষ পর্যন্ত তাই করেন।
এই সংলাপ থেকে জাতীয় ঐক্যেফ্রন্টের পক্ষে কোন ফলাফল আসার সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। শেখ হাসিনা অতীতে কখনও সমঝোতা করেন নাই, কারো দাবি মানেন নাই, ভবিষ্যতে মানার কোন কারণ নাই। সমঝোতা করার ইচ্ছা থাকলে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবির বিরুদ্ধে গিয়ে বেগম জিয়াকে আজ আদালত ১০ বছরের কারাদণ্ড দিত না, ব্যারিস্টার মইনুলকে গ্রেফতার করত না এবং কারাগারে বিনা ডিভিশানে রাখত না, ডা. জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে মাছ চুরির মামলা হত না, জাতীয় ঐক্যের সমাবেশের ঠিক আগে পরে বিএনপি নেতাদের বিনা অপরাধে গণহারে গ্রেফতার করত না। এই সবই হচ্ছে আওয়ামী সরকারের ইচ্ছায়, আইন এখন প্রহসন। কেউ যদি এই ফ্যাক্ট অস্বীকার করে তবে সে অন্ধ।
তাহলে শেখ হাসিনার সাথে ঐক্যফ্রন্টের জোটের এই মুহূর্তে সংলাপের উদ্দেশ্য কি? উদ্দেশ্য একটাই। সংলাপ নামক চেকবক্সে টিক চিহ্ন দেয়া। সংলাপে আহ্বান করার দরকার করছে। দুই পক্ষই বলবে, আমরা বসেছি। আমরা খুব গণতন্ত্রমনা। কিন্তু কাজের কাজ কি হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে বসার দরকার বসবে। দ্যাটস ইট। এর বাইরে আর কিছু না।