১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর ভারতের গুজরাটে জন্মগ্রহণ করেন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। ‘সর্দার প্যাটেল’ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। ইস্পাতকঠিন মানসিক দৃঢ়তা এবং অসীম মনোবলের জন্য তাকে ‘লৌহ মানব’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। আজ, বুধবার সর্দার প্যাটেলের ১৪৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তার একটি মূর্তি উন্মোচন করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং প্রশাসনিক কর্তাগণ।
গুজরাটের কেওড়িয়া অঞ্চলে নর্মদা বাঁধ থেকে সোওয়া তিন কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত সাধুবেট নামক একটি দ্বীপে নির্মিত হয়েছে বর্তমান বিশ্বের উচ্চতম এই মূর্তি। ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’ নামকরণ করা হয়েছে সর্দার প্যাটেলের এই মূর্তিটির। এতদিন পর্যন্ত চীন দেশের লুশান প্রদেশে অবস্থিত সর্বোচ্চ ইমারত ছিল স্প্রিং টেম্পলের বুদ্ধ মূর্তি, সেটির উচ্চতা ছিল ১২৮ মিটার অর্থাৎ ৪২০ ফিট। ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর উন্মোচিত হয়েছিল সেই বুদ্ধ মূর্তি। টানা দশ বছর সর্বোচ্চ মূর্তির রেকর্ড রেখে এবার দ্বিতীয় উচ্চতম হল সেটি।
‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’র উচ্চতা ১৮২ মিটার, অর্থাৎ ৫৯৭ ফিট। নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ অপেক্ষা দ্বিগুণ উঁচু এই স্থাপত্য। প্যারিসে অবস্থিত দু’টি আইফেল টাওয়ারের মিলিত উচ্চতা ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’ অপেক্ষা কম। এই অসাধারণ স্থাপত্য তৈরি করেছেন পদ্মভূষণ পুরস্কার-প্রাপ্ত স্থপতি রাম ভি সূতর। সর্দার প্যাটেলের হাজারদুয়েক ছবি দেখে তিনি এই মূর্তির নকশা তৈরি করেছেন। প্রায় ৭০ হাজার গ্রামের কৃষকদের থেকে কৃষিকার্যে ব্যবহৃত লোহা ক্রয় করা হয়েছে এই মূর্তি তৈরি করার জন্য। ২৫০ জন ইঞ্জিনিয়ার, ৩৪০০ জন শ্রমিক ৩৩ মাসব্যাপী অক্লান্ত পরিশ্রম করে বানিয়েছে এই স্থাপত্য। ৫৭০০ মেট্রিক টন স্টিল, ২২,৫০০ মেট্রিক টন সিমেন্ট, ১৮,৫০০ টন স্টিল রড এবং ১৮.৫ লক্ষ কেজি ব্রোঞ্জ ক্ল্যাডিং ব্যবহৃত হয়েছে বিশ্বের উচ্চতম এই স্থাপত্য তৈরি করতে। খরচ হয়েছে ২৯৮৯ কোটি টাকা। এই মূর্তির ১৫৩ মিটার উচ্চতায় রয়েছে গ্যালারি, সেখানে একসঙ্গে উচ্চগতিসম্পন্ন লিফ্ট দ্বারা ২০০ জন যেতে পারবেন। ১৮০ কিলোমিটার বেগের ঝড় এবং রিখটার স্কেলে ৬.৫ মাত্রার ভূমিকম্প ক্ষতি করতে পারবে না এই স্থাপত্যের।
এই মূর্তি তৈরিকে কেন্দ্র করে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। অন্যান্য রাজনৈতিক শিবির প্রশ্ন তুলেছে, ঐক্যের জিগির তুলে উচ্চতার দৌড় কেন? মোদি সরকার এই স্থাপত্য ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগান তুললেও বিরোধী মহলের দাবি, এটি ‘মেড ইন চায়না’। কারণ, মূর্তির একটি বড় অংশ চীন থেকে বানিয়ে আনা হয়েছে এবং তিনশোর বেশি চীনা কর্মী মূর্তি তৈরিতে কাজ করেছেন। গুজরাটের স্থানীয় মানুষজনও মূর্তি তৈরিতে বিরোধিতা করেছেন। ওই এলাকায় আদিবাসী মানুষের বসবাস। তাদের বাসস্থান এবং পরিবেশ সংক্রান্ত প্রশ্ন তুলে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়েছে। উন্মোচনের দিন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কড়া নিরাপত্তায় পরিবেষ্টিত ছিল এলাকা।
উন্মোচনের সময় আকাশপথে পুষ্পবর্ষণ করে সম্মান জ্ঞাপন করেন বিমান বাহিনীর সদস্যরা। নরেন্দ্র মোদি বলেন, “আমার সৌভাগ্য যে সর্দার প্যাটেলের মতো মহান নেতার মূর্তি উন্মোচনের সুযোগ পেলাম। নিজেকে ধন্য মনে করছি। আমার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকবে আজ। এই দিনটি ভারতের ইতিহাসেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সর্দার পটেলের মধ্যে ছিল কৌটিল্যের কূটনীতি এবং শিবাজীর শৌর্যের সমন্বয়। বিশ্বের উচ্চতম এই মূর্তি ভবিষ্যত প্রজন্মকে মহান মানুষটির আত্মত্যাগ, সংকল্প স্মরণ করাবে এবং অখণ্ডতা বজায় রেখে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বার্তা বহন করবে।”
অন্যান্য সংবাদমাধ্যম কর্তৃক ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’ স্থাপত্য উন্মোচনের অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। লাখো দর্শক কমেন্ট দ্বারা বলছে, এটা স্ট্যাচু অব পাবলিসিটি। অনেকে প্রশ্ন তুলেছে, যে-দেশে সীমাহীন বেকারত্ব, যুব-সমাজ দিশাহীন, অগণিত ঋণগ্রস্ত কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়, সেখানে ২৯৮৯ কোটি ব্যায়ে স্থাপত্য নির্মাণ চূড়ান্ত অন্যায়!