জীবন ও ধর্মের দৃষ্টিতে ‘অভিশাপ’ চর্চার কুফল

জীবন ও ধর্মের দৃষ্টিতে ‘অভিশাপ’ চর্চার কুফল

যুগ বা সময়ের চাহিদার কারণে দিন দিন আমাদের ব্যস্ততা বেড়েই চলছে। সেই সাথে বেড়ে চলছে আমাদের কাজের পরিধি এবং প্রেশার দুটোই। আমরা সব কিছুর সাথে তাল মিলাতে গিয়ে অনেক সময় হারিয়ে ফেলি আমাদের মেজাজ। ঘটে যায় অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। যার জন্য পরে আফসোস করতে থাকি বা সরি ফিল হতে থাকে কিন্তু ততক্ষণে আর কিছুই করবার থাকেনা। অথচ কিছু সূত্র মেনে চললেই কিন্তু আমরা আমাদের জীবনকে সুন্দর একটা ছকে নিয়ে আসতে পারি। তখন দেখা যাবে নিজেকে শান্ত রাখার চাবিকাঠি নিজের কাছেই আছে। কিন্তু ক’জন পারি আমরা ছকে বাধা সুন্দর নিয়ম মেনে চলতে? ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নানা রকম ভুলতো হয়েই যায়। এরকম একটি বাজে গুণ হলো: অভিসম্পাত দেয়া।

অস্থির এই সময়ে অভিশাপ দেয়া যেন আমাদের জীবনের এক অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা যে শুধু গ্রামাঞ্চলে হয় তা কিন্তু নয়। আগে হয়তো আমরা ছোট বেলায় যখন গ্রামে বড় হয়েছি তখন দেখেছি, কারো মাঝে কোনো ঝগড়া বিবাদ হলেই তারা একে অপরকে অভিশাপ দিচ্ছে, এমনকি খুব তুচ্ছ কারণেও। “আল্লাহ তোমার বিচার করবে।” অথবা “জাহান্নামেও তোমার ঠাই হবেনা” অথবা “আল্লাহ যেন কোনোদিনই তোমাকে বাচ্চা না দেন।” এরকম নানা ধরনের অভিশাপের বিনিময়ই একে অন্যের সাথে করে থাকেন। কিন্তু আমরা যখন পড়াশোনা বা পেশাগত কারনে শহুরে জীবনে প্রবেশ করেছি, তখনও দেখতে পেয়েছি যে, এসব অভিশাপ দেয়া নেয়ার চল গ্রামে নয় বরং শহরেও আছে। যেমন: “আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস দিক।” “তুমি জীবনেও সুখী হবেনা।” “মৃত্যুর সময় যেন মুখে পানি দেয়ারও কেউ না থাকে তোমার জন্য।” এরকম অহরহ নানা ছোট বড় অভিশাপ আমরা দিয়েই থাকি। অথচ ইসলাম আমাদের এ ব্যাপারে কী বলে?

ইসলাম সব সময় আমাদেরকে অভিশাপ দেবার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করেছে। তবে এটাও ঠিক, এমন আচরণও আমাদের করতে মানা করেছে যাতে করে অন্যজন মনে কষ্ট পায় এবং মনের ক্ষোভে অভিশাপ দিয়ে বসেন। এগুলো আসলে কিছু মানবিক গুণাবলীর সমন্বয়। যেগুলো জন্ম থেকে মানুষ অর্জন করে আসেনা। এগুলো চর্চার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। কারো চেহারা, উচ্চতা, গায়ের রঙ- এসবেতো আমাদের আসলে কোনো হাত নেই কিন্তু আমাদের লাইফস্টাইল, আচার-আচরণ, চিন্তাধারার উপরেতো আমাদের হাত বা কন্ট্রোল রয়েছে। আমরা বরং সেগুলোতেই ফোকাস করি। আমাদের সবসময়ই নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষ বা তার কাছাকাছি হিসাবে গড়ে তোলার জন্য নির্দেশিত ভালো গুণ গুলোকেই চর্চার মাধ্যমে অর্জন করতে হবে।

আসুন জেনে নেই অভিশাপ দেবার পর আসলে কী হয়:-

রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন কোন বান্দা কোন ব্যক্তিকে অভিশাপ তখন অভিশাপ আকাশে চলে যায়, আকাশের দরজাগুলো তার জন্য বন্ধ হয়ে যায়, অতপর তা জমিনের দিকে নেমে আসে, তখন জমিনের দরজাগুলোও তার থেকে বন্ধ করে দয়ো হয়, অতঃপর তা ডানে বাঁয়ে ঘুরতে থাকে, যখন কোন উপায় না পায়, তখন যাকে অভিসম্পাত করা হয়েছে, সে যদি এর যোগ্য হয় তাহলে তার প্রতি পতিত হয়, অন্যথায় অভিশাপকারীর দিকেই ধাবিত হয়।
(সুনানে আবু দাউদ-৪৯০৭ নং হাদীস।)

সুতরাং এ থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে, আমরা যদি হিংসা, ক্ষোভ, ক্রোধ বা রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অন্যকে অভিশাপ দিয়েও বসি, প্রকারান্তে আমাদের নিজেদেরই কিন্তু ক্ষতি হবার আশংকা থেকে যায়। এর থেকে বরং ভালো মন্দের জন্য সর্বদা নিজের কর্ম এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তের উপর ভরসা করি। এতে করে অনেক কিছুই কিন্তু সহজ হয়ে যাবে।

অন্যথায় যাকে অভিশাপ দিলাম, সে যদি সেটার যোগ্য না হন তবে নিজের দিকেই তা ফিরে আসবার সম্ভাবনা থেকে যায়।

এছাড়াও অভিশাপ চর্চা করা একটা বাজে ব্যক্তিত্বের পরিচয় বহন করে। দেখা গেলো একটা সময় পরে আপনার আশেপাশের মানুষও কিন্তু আপনার বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে শুরু করবে। তাছাড়া আপনার আচার আচরণগুলো কিন্তু আপনার ঘরে বসবাসরত শিশুদেরও কুশিক্ষায় শিক্ষিত করবে। নিজেদের সুন্দর মননের বিকাশের জন্যই আমাদের এসব অভ্যাস ত্যাগ করা উচিৎ।

আসুন জেনে নেই এসব ব্যাপারে আমাদের রসুল (সাঃ) কি বলেছেন:-

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুসলমান তো সেই ব্যক্তি ব্যক্তি যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্যান্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। (সুনানে তিরমিজী- ২৬২৭নং হাদীস, সুনানে আবু দাউদ- ২৪৮১নং হাদীস)

এখানেই আমাদের নবী করীম কিন্তু আমাদের জন্য খুব সুন্দর একটি দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।

আরো একটি হাদীসে রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুমিন কখনো অভিসম্পাদকারী হয় না। (সুনানে তিরমিযি-২০৮৮ নং হাদীস।)

এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আল্লাহর নিকটতম বান্দা হবার ক্ষেত্রে অভিশাপ দেয়ার গুণাবলি একটি অন্তরায় হিসাবে কাজ করে। আমরা নিশ্চয়ই এমনটি হোক তা চাইবোনা।

অপর একটি হাদীসে এসেছে:-

অভিশাপকারী আখেরাতেও মর্যাদা পাবে না। এ ব্যাপারে রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন অভিশাপকারীরা সুপারিশ করতে পারবে না। এবং সাক্ষ্যপ্রদানও করতে পারবে না। (সহীহ মুসলিম-২৫৯৮ নং হাদীস।)

অভিশাপ দেয়া যেমন আমাদের ইহকালীন শান্তি নষ্ট করে তেমনি পরকালীন শান্তির জন্যও এটা একটি অন্তরায়। পরকালেও তারা মর্যাদাশালী হবেনা। কিন্তু আমরা কে না চাই মর্যাদাশালী হতে? সেজন্যতো আমাদের নির্দেশিত পথ অনুসরণ করেই আগাতে হবে।

এছাড়াও:- যে বিদ্রূপ করে, লানত করে ও অশ্লীল কথা বলে, সে মুমিন নয়। (তিরমিজি)

যার যার কর্ম ফলের জন্য সে নিজেই দায়ী থাকবে। প্রকৃতি প্রদত্তভাবেই প্রত্যেক ব্যাক্তিই আজ অথবা কাল নিজের কর্মফল ভোগ করবে। নিজের অন্যায়ের শাস্তি পাবে। শুধু শুধু অভিশাপ দিয়ে আমাদের নিজেদের পাপের পাল্লা ভারি করার কোনো অর্থই হয়না। আমরা বরং ক্ষমা করে দেই। ক্ষমাই বরং মনে একটা প্রশান্তির শীতল পরশ বইয়ে দিবে। আল্লাহ ক্ষমাকারীর দিকেই সুনজরে তাকাবে, রহমত দিবে। যে জুলুম করবে, আল্লাহতো তার জন্য শাস্তি নির্ধারণ করেই রেখেছেন। আমরা আমাদের প্রতিটি কাজে কর্মে আমাদের স্রষ্টার উপরেই বরং নির্ভর করি। তার উপরেই ছেড়ে দেই যার যার কর্ম ফলের ভার। সেই সাথে সচেতন থাকি নিজেও যাতে করি আমি বা আমরা অন্যের অভিশাপ বা কষ্টের কারণ না হই। এতে করে আর কিছু না হোক মানসিক শান্তিতো অর্জিত হবে। আত্মার শান্তি-ই যে বড় শান্তি।