“আমার কাছে তথ্য আছে”— আমাদের কি মনে আছে সেই অমিয় বাণী চিরন্তনী? না থাক আর ব্যাঙ্গ না করি। বলা হয়, এই যুগটাই তথ্যের যুগ। সবখানেই তথ্যের আনাগোনা। ইন্টারনেট, মোবাইল আর কম্পিউটারে বিপুল ব্যবহারে ডিজিটাল হয়েছে দেশ। পুরো দুনিয়াটা হাতের মুঠোই নয়তো থলেতে বা পকেটে রাখা বাক্সে! বিশ্বের সব খবর, ব্যাবসা, বিক্রি-বাট্টা সবই হচ্ছে “অনলাইন” নামের জাদুর কাঠিতে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে শুরু করে ব্যাংকিং সবখানেই এই জাদুর কাঠির ছোঁয়া। আর এই সব কার্য সম্পাদন হয় তথ্যের মাধ্যমে।
না জনৈক সেই ব্যাক্তির মত আমিও তথ্য-তথ্য বলে জ্ঞান কপচাবো না আজকে। আমি বরং আসি এই তথ্য যুগের কিছু নিপুণ আলাপে। আজকালের এই ডিজিটাল যুগে ( আমাদের দেশে যুগের না রাজনৈতিক ভাবেও প্রতিষ্ঠিত হয়!) সব বিস্ময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিস্ময় ব্যাংকিং। যদি বছর দশের আগের কথাও ভেবে দেখি তবে সে দিন গুলো ছিলো নেহাতই কষ্ট সাধ্য। ব্যাংকে যাও, চেক জমা কর, সিগনেচার মেলাও, বিরাট ঝামেলা। পুরো একটা দিন হাতে নিয়ে ব্যাংকে যেতে হত। কিন্তু এখন এটিএম আছে। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা ব্যাংকগুলোর বুথ সার্ভিস আছে। কত সহজেই চট করে টাকা তোলা যায়, কেনাকাটা করা যায়! মোট কথা লেনদেন হয়েছে অনেক সোজা। কিভাবে হচ্ছে এত কিছু? তাও এত সহজে? এই প্রশ্নের জবাব খুজতে হলে আমাদের সংখ্যা নিয়ে একটু ভাবতে হবে। এত বড় রাজকার্য সবই হচ্ছে সংখ্যার মাধ্যমে। হ্যাঁ ওই ১, ২, ৩, ৪ , …। সংখ্যাতত্ত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবনাটা ভেবেছিলেন আর্য ভট্ট। ভারতীয় একজন আর্য ঋষি। ‘শূন্য’ তারই আবিস্কার। নেহাতই কিছু নেই এমন একটি চিহ্নের আবিষ্কারক তিনি। তবে কে জানতো এই ‘শূন্য’ দিয়েই জাগতিক জ্ঞান অনেকদূর এগোবে, আসবে মহাশূন্যের ভাবনা! এরপর বিখ্যাত গণিতবিদ রামানুজনের একান্ত ভক্ত ক্যামব্রিজের প্রফেসর গডফ্রে হ্যারল্ড (জি এইচ) হার্ডি এর কথাই ধরা যাক। সংখ্যা নিয়ে অনেক কথা বলেছেন তিনি। তার মতে সংখ্যা দুই প্রকার- বিশুদ্ধ আর তুচ্ছ গণিত। আমরা পাঠ্যক্রমে যা শিখি পড়ি, মুদি দোকানের হিসাব থেকে রকেট সাইন্স তার সবই নাকি তুচ্ছ গণিত! বিশুদ্ধ গণিত একটা শিল্পকর্ম। প্রত্যেকটা শিল্প কর্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নাকি এই বিশুদ্ধ গণিতের বাস। এই গণিত বোঝার সাধ্য নাকি মানবের নাই! তবে শতবর্ষ পূর্বে এই হ্যারল্ড জানতেন তার দেয়া নাম্বার থিওরি দিয়েই চলবে বিশ্ববিজ্ঞান? বড় বড় কর্পোরেট পুঁজির আঁধারে ডেবিট ক্রেডিট এর হিসাব থেকে গ্রহের দূরত্ব নির্ধারণ সব কিছুই হবে ওই ১, ২, ৩, ৪ দিয়ে! হ্যারল্ড এর তুচ্ছ গণিতকে এতটা তুচ্ছ ভাবা সহ্য হয়নি আধুনিক গণিতজ্ঞদের। হ্যারল্ড এর ধারণা ছিলো তার এই নাম্বার থিওরি কারোর কাজে আসবে না! তবে বলি কি ওই রকেট সায়েন্স ফায়েন্স সব ঐ ‘নাম্বার থিওরি’ দিয়ে চললেও আমি হ্যারল্ড’র থিওরি আর তথ্য নিয়ে একটুখানি খিচুড়ি পাকাই! এই যে ই-কমার্স, ই-বিজনেস, ই-শপিং, ই-ব্যাংকিং সবই হচ্ছে ঐ হ্যারল্ডের নাম্বার তথা তুচ্ছ গণিতের সাহায্যেই! ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড মানে ১৬ অংক বিশিষ্ট সংখ্যা যা এটিএমএ সোয়াইপ করলে যন্ত্র তা রেকর্ড করে নেয়। তারপরেই আইডেন্টিফিকেশনের জন্য পিন নাম্বার চায়। তারপর জটিল অংক কষে এটিএম পৌছে যায় আপনার একাউন্টে! আপনি নিজের মত টাকা তুলে নেন। সবই অংকের জোরেই হয়। অনেকে পিনের এই পদ্ধতিতেও বিরক্ত! কার্ডতো একাউন্টে সংযুক্তই সুয়াইপ করলেই তো হয় এতে পিনের দরকার টা কি? এই পিন সুরক্ষার জন্য। যেকোন মুহুর্তে আপনার কার্ড হারিয়ে যেতে পারে, হাইজাকার আপনার কার্ড ছিনতাই করতে পারে। যেনো সহজেই আপনার কার্ড থেকে টাকা আত্মসাৎ বা চুরি না হয় তার জন্যই এই পিন কোড। আর কেউ যদি আপনার এই কার্ড নিয়ে একের পর এক নাম্বার দিয়ে আন্দাজ করতে চায়। পারমুটেশন কম্বিনেশনের হিসেবে তাও লাখ দেড়েক বছর পার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়!
এই অংক, এই সহজ ব্যাবস্থা তারপরেও কতটা নিরাপদ সব কিছু? এমন প্রশ্ন খুব অপ্রাসঙ্গিক না। এটিএম জালিয়াতির কথা প্রায় শোনা যায় আজকাল। এই জালিয়াতিও হয় অংকের জোরে। মোট কথায় সিঁধেল চুরি! মোটা দাগের জালিয়াতিগুলো সাধারণত হয় টাইপ করা পিনের কপি করে বা খুব উচ্চপ্রযুক্তির সাহায্যে। এভাবে শুধু টাকা না, ইমেইল বা কোন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হ্যাক করে গোপণ তথ্য চুরি করা হরহামেশাই হচ্ছে। তবে এমন চুরি করা সহজ হয়ে পড়ে সহজ পাসওয়ার্ডের কারণে। আমরা অনেকেই ভুলে যাই, পাসওয়ার্ড হয় নিজের একাউন্টের সুরক্ষার কারণে। তবে অনেকেই আমরা ভুলে যাওয়ার ভয়ে খুব সহজ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করি। অনেক সমীক্ষায় দেখা গেছে ১২৩৪ এই রকমের সহজ পাসওয়ার্ডই আজকাল ব্যবহৃত হচ্ছে বেশি। এরকম কাজ হ্যাকারদের কাজ অনেকটাই সহজ করে দেয়।
শুধু হ্যাকারদের কথাই বা বলি কি! সরকার বা প্রশাসনও আমাদের উপর কড়া নজর রাখছে এই তথ্য দুনিয়াতে। প্রসাশন এখন চায় আমাদের সব তথ্য তাদের কবজায় রাখতে। সরকার চাচ্ছে আমাদের ডিজিটাল ভোটার আইডি নাম্বারটা ফোনের সিম থেকে শুরু করে সবখানে রাখতে যেনো আমাদের ব্যাক্তি জীবনেও কড়া নজর রাখা যায়। নজর রাখা হচ্ছে আমাদের ব্যাংক একাউন্ট থেকে শুরু করে ব্যাক্তিগত ইমেইল, ফেসবুক সবখানেই। আমরা অনলাইনে কি কিনি না কিনি তার উপর নজর রাখে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। অনেকে মনে করে এতে ক্ষতি কি? শুল্ক ঠিক ঠাক নেওয়ার জন্য এই কাজ করাই যায়। হ্যাঁ তা ঠিক শুল্ক ঠিক ঠাক না নিলে দেশ চলবে কিভাবে? কিন্তু আমরা একটিবার কি চিন্তা করে দেখেছি এই যে সরকারের বিরোধিতা করার পর পরেই হঠাৎ কোন নেতার ফোনালাপ ফাঁস হচ্ছে? এই ফোনালাপতো একান্ত ব্যাক্তিগত বিষয়। তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম যে দেশ বিরোধী কথাবার্তা হওয়ায় কল রেকর্ড হয়েছে। তাহলে এই রেকর্ড করা তথ্য থাকবে শুধু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জাতির সামনে আসবে কেনো? জাতির সামনে এই সব কল রেকর্ড আনা হয় শুধুই রাজনৈতিকভাবে হেনস্থা করার কারণে। যাতে সরকারের বিরোধিতা আর নজরে না পড়ে। আচ্ছা বাদ দিলাম এই সব রাজনৈতিক কথাবার্তা। একটি বার কি আমরা এটা চিন্তা করেছি যে আমাদের কল রেকর্ডগুলো কি এভাবেই জমিয়ে রাখা হচ্ছে? উত্তর, হ্যাঁ হচ্ছে! আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য আজ সম্পুর্ণ নাঙ্গা! সরকার শুধুই দয়ার বসত উম্মোচন করছে না আর কি! আচ্ছা কল রেকর্ড বাদ দিলাম। আমরা কখনো কি অনলাইনে শপিং করার পর এটা খেয়াল করেছি যে, কোম্পানির পণ্য আমরা কিনছি সেটা কেনার পরপরেই অন্য কোম্পানির ঠিক একই পন্যের বিজ্ঞাপনে সয়লাব হচ্ছে আমাদের ইমেইল? এটা কিভাবে হয়? খুব সোজা ইমেইল-মার্কেটিং এর মাধ্যমে। রাইভাল কোম্পানি কাড়ি কাড়ি ডলার খরচ করে কিনেছে আপনার তথ্য। আপনি কোন ব্র্যান্ডের সাবান মাখেন থেকে শুরু করে কোন ব্র্যান্ডের জাঙ্গিয়া আপনার পছন্দ সবই জানে বিশ্বপুঁজির সম্রাটেরা। এত সহজ এই ডিজিটাল জীবনযাপনে আমরা ভুলেই যাই, বড় বড় দানব সাইজের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে আমাদের সব তথ্য জিম্মি করা আছে। তারা টাকা ঢালছে শুধু আমাদের ব্যাক্তিগত এইসব তথ্য কেনার জন্য। বিজ্ঞান হয়তো আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে যাচ্ছে তবে আমাদের প্রাইভেসি যে বিসর্জন যাচ্ছে তা বলায় বাহুল্য।তথ্যের মহাসড়কে ঘোরাঘুরি হয়তো মজাদার বিষয় আর এখন জীবনের সাথে একান্তভাবে জড়িতও বটে। তবে আমরা যেন ভুলে না যাই, যত ঘুরাঘুরি তত পদচিহ্ন বা ফুটপ্রিন্ট। আর ওই ফুটপ্রিন্ট দেখে আমাদের খবর খুঁজে বের করা খুবই সোজা। তাই তো বললাম তথ্যবাজারে আমাদের ব্যাক্তিজীবন আজ নাঙ্গা! নগ্ন!