কোথা ব’সে ছিলে? যাবার সময় দেখছি শুধুই
ঝরেছে পাতার শিখর গলানো কার এলোচুল।
অবসাদ আর নামে না আমার সন্ধে থেকে,
ছুটে কে তুলিলে শালবন, ঘনবন্ধন চারিধারে?
ফিরেছি তোমায় দেখবো, তোমায় দেখতে পাচ্ছি
হয়তো তোমায়, স্ফটিক জলের মতো বেকোনো।
কানের পাতার তলে ব’য়ে ওড়ে চলে চুল গুচ্ছ
তোমার আলোই তোমায় মধুর করেছিলো একা
_ শক্তি চট্টোপাধ্যায়
কোন রমনীর রূপে কাতর হয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় এ কাব্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন তা অধমের অজ্ঞাত। তবে, যার স্মরণে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এ কাব্যের সহায়তা নেয়া; ফুটবল জগতে বিচরণ অথচ তার নাম শোনেননি এমনি ব্যক্তি আছে বলে আমি অন্তত বিশ্বাস করি না। শ্রী চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মতোই তার আবেদন, কবিতার মত উত্থান পতনের ছন্দ তার জীবন জুড়ে। কারো কাছে তিনি মোহের অপর নাম তো কারো কাছে ঘৃণিত এক ব্যাক্তিত্ব। বাজুতে বিপ্লবের পুরোধা চে গুয়েভারার চিত্র একে চুরুটের ধোয়ার স্বাদ নিয়ে তিনি যেমন বিপ্লবের প্রাণ পুরুষ ফিদেলের সাথে অলস সময়ের আড় ভাঙতেন আবার কখনো সুদূর আমেরিকার রাজপথে বুশ বিরোধী মিছিলের অগ্রভাগে আগুন জ্বালা স্লোগান দিতেন। বর্ণিল, বিচিত্র এমন চরিত্র ফুটবল বিশ্বে একজনই ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন; তিনি এক এবং অদ্বিতীয় দিয়াগো আর্মান্ডো মারাডোনা।
‘জাদুকর’ শব্দটি যত্রতত্র ব্যাবহারে কিছুটা হলেও জাত হারিয়েছে। এখন তো অনেক স্বাভাবিক মুহূর্তও মিডিয়ার কল্যানে হয়ে যায় জাদুকরী। তবে, আমার চোখে সত্যিকার অর্থে ফুটবল বিশ্বকে কেউ যদি জাদুর জালে অবশ করে রেখে থাকেন তবে তিনি ম্যারাডোনা। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কে সে বিতর্কে আমার আগ্রহ নেই। সে শ্রেষ্ঠত্বে ম্যারাডোনার নাম আছে কি নেই তাও আমার কাছে বিবেচ্য না। আমাকে যেটি মুগ্ধ করে তা হলো, সেই ছিয়াশিতে তার কীর্তির আবেদন আজো অটুট। দেখতে দেখতে কতটা কাল তো চলে গেলো। সাঝবেলায় চা মুড়ি সমেত আড্ডা গত হয়ে তার বদলে স্থান করে নিলো কৃত্রিম নীল জগত। জোনাক পাখিও সোডিয়ামের আলোর সাথে অভিমান করে শহর ছাড়া কতটা কাল। অথচ, ম্যারাডোনা নামটি শুনলে ছিয়াশির যুবা, যে এখন দায়িত্বশীল পিতার বোঝা বইতে গিয়ে কিছুটা কুজো হয়ে পড়েছেন তার চেহারাতেও মুহুর্তেই দেখা দেয় বিদ্যুতের খেল। ম্যারাডোনায় নিজের মুগ্ধতার বয়ান দিয়ে গিয়ে মুহুর্তেই যেনো ভুলে যান কালই ছেলেটার টিউশিন ফি দিতে হবে, বাজারের আগুনে গা বাচিয়ে উদর শান্ত রাখবার জন্য কিছু আনাজের বন্দোবস্ত করতে হবে। ম্যারাডোনা এমনই এক জাদুর নাম।
কখনো ড্রাগ নিয়ে দুর্নাম কুড়িয়েছেন তো কখনো ট্যাক্সের তথ্যের গড়মিলের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। কখনো বা চওড়া হয়ে কেড়ে নিয়েছেন পাপারাজ্জির সাধের ক্যামেরা, কখনো বা সোজা মুষ্টিযোদ্ধার ভূমিকায় অবতির্ন হয়ে ভূপতিত করেছেন স্বয়ং সাংবাদিককেই। এহেন বান্দাকে সহ্য করাই যেখানে দুষ্কর ঠাওরানোর কথা সেখানে তিনি দিব্যি বসে আছেন দেবতার আসনে। যে দেবতার হাসপাতালে গমনের খবরে মূহুর্তেই মুষড়ে পড়ে ক্রোড় জনতা, চার্চগুলোতে জ্বালানো হয় প্রার্থনার প্রদীপ। নির্ঘুম রাত কেটে ভোর হয় তার সুস্থতার খবর শোনবার প্রত্যাশায়।
আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সের এক হত দরিদ্র পরিবারে জন্ম ফুটবল জগতের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত এ তারকার। শিক্ষা তো বহুদূর এর আদ্যক্ষর ‘শ’ এর সাথেও তার শতক্রোশ দূরের কোনো রিস্তা ছিলো না। নিত্যকার সঙ্গী ছিলো ফুটবল। এই গোলকচর্মই ছিলো তার দুঃখ ভুলে থাকার উৎস, আনন্দের মাধ্যম। দারিদ্রের এই অসনীয় অবস্থানের আলিঙ্গন থেকে ছুটে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে মাঠে উড়ে বেড়ানো ফুটবলারের সংখ্যাও তো নেহায়েত কম নয়। তাহলে, ম্যারাডোনা আলাদা কোথায়?
ছিয়াশি’র জাদুর রেশ এখনো এমনভাবেই রয়ে গিয়েছে যে কোপার মত নেহায়েত মহাদেশীয় আসরেও বাংলার আকাশে ওড়ে আকাশি সাদা। ম্যারাডোনার পূর্বে কি এমন ছিলো? না। বরং ছিয়াশি’তেও আর্জেন্টিনার সমর্থনে বঙ্গের আকাশ আকাশি সাদায় শোভিত হয়েছিলো এমনটাও বড় শোনা যায় না। পিটার শিলটনের চোখের সামনেই ব্রিটিশরাজরা যেমন করে বিভিন্ন দেশকে ছল চাতুরী দিয়ে শোষনের যাতাকলে পিষ্ঠ করতেন তার ঠিক আশ্চর্য এক জবাব যেনো দিলেন ফুটবলীয় কায়দায়। অবশ্যই ম্যারাডোনা যেটি করেছেন সেটি প্রতারণা ছিলো, কিন্তু, ব্রিটিশ রাজের জাতাকলে পিষ্ঠরা বোধকরি সেদিন বহুকালের প্রতারণার জবাব ম্যারাডোনার হাত দিয়েই দিয়েছিলো। তাই, সে প্রতারণা পরবর্তীতে আখ্যা পায় ‘ঈশ্বরের হাত’ নামে। ফিরিঙ্গিদের বিপক্ষে না হয়ে অন্য কারো বিপক্ষে এমন কিছু করে ম্যারাডোনা আচমকাই নায়ক হয়ে যেতেন কি না আমি ঠিক নিশ্চিত নই। তবে, ম্যারাডোনার ভাবনার স্রোত সেদিন বইছিলো ভিন্ন খাতে। তিনি যে শুধু ছল চাতুরী দিয়ে নয় বরং পায়ের জাদুতেও ব্রিটিশ রাজকে স্তব্ধ করে দিতে পারেন সেটি দেখিয়েছিলেন তার কিছুক্ষণ পরই। একজন-দু’জন করে একের পর এক বাধা অতিক্রম করে শিলটনকে যখন ফাঁকি দিলেন পুরো বিশ্ব যেনো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এমন কিছুও সম্ভব? গোলটা কতটা অসাধারণ ছিলো তার বিভিন্ন বয়ান হয়েছে, বহু জায়গায়, বহুভাবে। অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে এই অবস্মরনীয় মুহূর্তের সাক্ষী হওয়া ব্রিটিশ কিংবদন্তি গ্যারি লিনেকার প্রতিদ্বন্দিতা ভুলে আরেকটু হলেই তালি বাজিয়ে অভিবাদন জানাতে যাচ্ছিলেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ককে। সেখানেই থামেননি। বরং বেলজিয়ামের বিপক্ষে যেনো হয়ে উঠলেন আরো দুর্দান্ত। অনেকেই বলেন ইংল্যান্ডের ম্যাচটি আলোচিত বটে, তবে আসল ম্যারাডোনার জাদু দেখা গিয়েছিলো বেলজিয়ামের বিপক্ষেই। স্বপ্নপূরণ থেকে মাত্র একধাপ দুরে ম্যারাডোনার বাধা ছিলো জার্মান ব্রিগেড। অতীতে যারা বহুবার দুঃস্বপ্ন হয়ে হানা দিয়েছে স্বপ্নশ্রষ্ঠাদের কাছে। ম্যারাডোনা কি পারবেন? তার পাশে তেমন রসদই বা কোথায়? এখানেই ম্যারাডোনা অনন্য। তিনি নিজেই বারুদ হয়ে প্রতিপক্ষের দুর্গ ধসিয়ে দিয়ে আসতে পারতেন। অপর কারো পায়ে দিকে তার তাকাতে হতো না। তিনি পারলেন, বিশ্বসেরার সোনালি ট্রফিতে চুম্বন চিহ্ন একে দিতে।
ম্যারাডোনার আগে যারা পেরেছেন বা পারেননি তাদের প্রায় সবার পাশেই ছিলো প্রায় সমমানের একগাদা তারকা। আপনি ‘১০ এর স্পেন বলুন বা ‘৯৮ এর ফ্রান্স; ইনিয়েস্তা জিদানদের সঙ্গ দেবার জন্য তারা পাশে পেয়েছিলেন জাভি ভিয়েরাদের মতো তারকাদের। ইয়োহান ক্রুইফ বা জিকোরা তো পারেনইনি। এখানে ম্যারাডোনা আলাদা। বাজি ধরেই বলতে পারি লেখাটি পড়া মাত্তর বিনা গুগলের সহায়তায় ম্যারাডোনা ব্যাতিত ছয়জন ফুটবলারের নামও ঠিকভাবে কেউ বলতে পারবেন না যারা ‘৮৬ তে ম্যারাডোনার পাশে ছিলো।
এতেও ঠিক ম্যারাডোনায় এতকালের মুগ্ধতার বয়ান সঠিকভাবে করা হয়? আমার তো মনে হয় না। ধরনীর দ্বিতীয় ব্যাক্তিটির নাম বলুন যার নিষিদ্ধ হবার খবরের সাধের জীবন ত্যাগ করতে কেউ দ্বিতীয়বার ভাবেননি। ভালোবাসা তো অনেক ফুটবলারই পেয়েছেন, কিন্তু কারো জন্য জীবনোৎসর্গ? না মশাই, গুগল থেকে শুরু করে ধরনীর শেষ কোনটুকু খুজে আসুন; ও নজীর দ্বিতীয়টি নেই। কতটা মোহাচ্ছন করতে পারলে কারো জন্য; যখন সে অপরাধের অকাট্ট প্রমাণসহ নিষিদ্ধ হয় তার জন্য কেউ জীবন দেয়? আমার কাছে ব্যাক্তিগতভাবে যেটি মনে হয়, ম্যারাডোনা নামক এই যে মায়াজাল তার পেছনের মুল কারণ তার ব্যাক্তিত্ব। ভ্রু কুচকে উঠলো? ড্রাগ নেয়ার দায়ে যিনি নিষিদ্ধ সময় পার করেন তার ব্যাক্তিত্বের জয়গান গাইছি বলে? আমরা ‘তারকা’ নামের এক শ্রেণির খেলোয়ারদের সাথে পরিচিত। যাদের আচরণ, কথা, আবেগ বা উচ্ছাস সবই মাপা, মেকি। ম্যারাডোনা এখানেই আলাদা। ‘তারকা’ হবার পরেও তিনি মনের কথা মুখে প্রকাশে কালক্ষেপন করেন না। প্রকাশ্যে চিৎকার করে কাঁদবার সময় তাকে ভাবতে দেখা যায় না যে এতে তার তারকা ইমেজের কি হবে। নতুবা, কোন ফুটবলার আছে যে নিজের দেশ রেখে শুধু মাত্তর নিপীড়িত মানুষের পক্ষে গলা ফাটাবার জন্য সুদুর আমেরিকায় গিয়ে তাদেরই রাষ্ট্রপ্রধানের বিপক্ষে মিছিল করে আসবেন? ম্যারাডোনাকে ঠিক পাশের মানুষটির মতো মনে হয়। যার সাধারণ মানুষের মত আবেগ আছে, ক্ষোভ আছে, রাগ আছে, আছে ভালোবাসা। বিশ্বের তাবৎ তারকারা যখন কর্তা রুষ্ঠ হতে পারেন এই ভয়ে ফিফার দুর্নীতি নিয়ে নিরব ভূমিকা পালন করেছেন; সেখানেও ম্যারাডোনা ছিলেন উচ্চকন্ঠ। প্রকাশ্যে ব্ল্যাটারকে লষ্কর বলে উপেক্ষিত ছিলেন ফিফার অন্দরে। তবু, তিনি দমে জাননি। অটল থেকেছেন নিজের অবস্থানে।
লেখার শুরুতেই বলেছি ম্যারাডোনা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কি না তাতে আমার সামান্য আগ্রহ নেই। তাই, তার পরিসংখ্যানের জিকর করবার কোনো প্রয়োজন বোধ করছি না। আমার কাছে যেটি অবাক লাগে, ইদানিংকার প্রজন্ম যারা নিজেদের আর্জেন্টাইন সমর্থক বলে পরিচয় দেয় তারাই যখন ম্যারাডোনাকে গালমন্দ করে তখন। যাকে ম্যারাডোনার চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের প্রয়াশে এই চেষ্টা তিনি নিজেই বলেছেন সহস্রবার জনম নিলেও ম্যারাডোনার সমকক্ষ হওয়া তারপক্ষে সম্ভব না। এখনো যে বিশ্বকাপ আসলেই আকাশি সাদায় আকাশ ঢেকে যায় তা এই ম্যারাডোনার জন্যই। আর্জেন্টিনা বললেই চোখের সামনে ভেসে উঠে সোনালি ট্রফিতে চুম্বনরত ম্যারাডোনার অশ্রুসজল মুখটি। কতজন পেরেছেন এভাবে জাতীয় প্রতীকে পরিণত হতে? আমি আর্জেন্টিনার সমর্থক না। কিন্তু, একজন মানুষ এতটাকাল ধরে এতগুলো মানুষকে মোহাচ্ছন করে রেখেছেন; এটি আমাকেও মুগ্ধ করে। নিন্দা করবার মতো বহু কিছুই রয়েছে। তাকে আপনি প্রতারক বলতে পারেন, নেশাগ্রস্থ বলতে পারেন বা আরো দু’কদম এগিয়ে দু চারটা গালিও শুনিয়ে দিতে পারেন। আপনার অভিযোগগুলো সত্য; সাথে এও সত্য যে এ সকল দোষগুলো থাকবার পরেও ভালোবাসা আদায় করে নেবার আশ্চর্য ক্ষমতা মানুষটির রয়েছে। ওই যে বললাম, ম্যারাডোনাকে তারকা না, পাশের পরিচিত মানুষটির মতো লাগে।
ফুটবলে ম্যারাডোনার সমকক্ষ বা তার চেয়ে বেহতার অনেককেই হয়তো পাবেন। চাইলে শ্রেষ্ঠত্বের তালিকা থেকে প্রতারক বলে ছুড়েও ফেলে দিতে পারেন। কিন্তু, ম্যারাডোনা যে একটি জাদুর নাম এটি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। এমন একজনই ছিলেন, আছেন এবং একজনই থাকবেন। আমি আমার বাবাকে আদর্শ মেনে গড়ে উঠা মানুষ। বদন থেকে শুরু করে বসবার ধরণে বিচিত্র এক মিল থাকলেও একটি জায়গায় আমাদের অবস্থান বিপরীত মেরুতে। পিতা আমার আকাশি সাদার অন্ধভক্ত হলেও আমি সে পথে হাটিনি। ফুটবলে আমার ভালোবাসার পুরোটাই ক্লাব কেন্দ্রিক। কিন্তু, আমিও ম্যারাডোনায় মুগ্ধ। ওই যে বললাম, এত বিতর্ক এত সমালোচনা তবু এক আশ্চর্য ক্ষমতা নিয়ে তিনি বসে আছেন দেবতার আসনে, এতেও যদি মুগ্ধ না হই; তবে কিসে হবো ঠিক নিশ্চিত নই।