প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্দেশ্যে রাহুল গাঁধী বলছেন, “ছেড়ে দেব না!” তবে কি হৃদমাঝারে রাখবেন? বিলকুল না! আগামী ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচন। উনিশে বিজেপি ফিনিশ- এই লক্ষ্যে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী উপর্যুপরি শানিত কথাবার্তায় জেরবার করে তুলছেন নরেন্দ্র মোদিকে। গত ২৩ অক্টোবর মঙ্গলবার রাতে দেশের শীর্ষ তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের প্রধান অধিকর্তা অলোককুমার বর্মা এবং বিশেষ অধিকর্তা রাকেশ আস্থানাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটিতে যাওয়ার নির্দেশ সম্বলিত পত্র ধরায় কেন্দ্রীয় সরকার। অলোক বর্মা এক আর্জিতে জানিয়েছেন, কিছু তদন্তের ক্ষেত্রে তিনি সরকারের মর্জিমতো চলেননি, তাই তাঁর বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ। অলোক বর্মার ঘনিষ্ঠ মহলের মতে, রাফাল দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত শুরু করতে চাইছিলেন ‘সদ্য প্রাক্তন’ সিবিআই প্রধান, ফেঁসে যাওয়ার ভয়েই তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।
বিষয়টা লুফে নিয়েছে বিরোধী শিবির। কংগ্রেস সুপ্রিমো রাহুল গাঁধী কোনও রাখঢাক না করেই বলছেন, “রাত দু’টো নাগাদ সরিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রধান সিবিআই অধিকর্তাকে, এটা অনৈতিক এবং বেআইনি। তিনি রাফাল দুর্নীতির তদন্ত করতে চেয়েছিলেন, তাই রাতেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল। এভাবে প্রধানমন্ত্রী একা সিবিআই প্রধানকে অপসারণ করতে পারেন না। আইন মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা এবং প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত কলেজিয়াম যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রধান সিবিআই অধিকর্তার নিয়োগ এবং অপসারণ করতে পারেন। দুই শীর্ষ অধিকর্তার সঙ্গে কোনও আলোচনা না-করেই এভাবে হঠাৎ ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য, রাফাল দুর্নীতির তথ্য লোপাট করা।” একই কথা বলেন বর্মার আইনজীবী গোপাল শঙ্করনারায়ণ। তাঁর মতে, এভাবে শীর্ষ আদালতের নির্দেশ এবং কেন্দ্রের হলফনামা অগ্রাহ্য করে সিবিআই শীর্ষকর্তাদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর নির্দেশিকা প্রকারান্তরে সিবিআইয়ের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা।
বিগত এক বছর ধরে মল্লযুদ্ধে মত্ত ছিলেন দুই সিবিআই শীর্ষকর্তা অলোক বর্মা এবং রাকেশ আস্থানা। পদাধিকারে অলোক এক নম্বর এবং রাকেশ দুই নম্বর। কিছুদিন আগে সিবিআইয়ের স্পেশ্যাল ডিরেক্টর রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে ঘুষ ও তোলা আদায়ের অভিযোগ ওঠে, শুরু হয় তদন্ত। কড়া সমালোচনা করেন অলোক বর্মা। তদন্তে নিযুক্ত ১৩ জন সিবিআই অফিসার নাকি অলোক বর্মার ঘনিষ্ঠ, তাঁদের বদলির নির্দেশ দেওয়া হয়। এমনকী, পদস্থ তদন্তকারী অফিসার এ কে বাসসিকে সুদূর আন্দামান যাওয়ার নির্দেশিকা আসে। এটাও যেন এক দ্বীপান্তর সাজা! বাকিদের জব্বলপুর ও নাগপুরে পাঠানোর হুকুম আসে। কিছু রাজনীতিজ্ঞ বলছেন, অলোক বর্মার বিবাদ যাঁর সঙ্গে, সেই রাকেশ আস্থানা প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন। তাঁর মদতেই নাকি গুজরাত ক্যাডারের ওই আমলাকে সিবিআই প্রধান করার জন্যই আনা হয়েছে। বর্মা পিটিশনে লিখেছেন, আস্থানার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ এযাবৎ নিষ্পত্তি হয়নি, তাই তিনি ওই নিয়োগে আপত্তি করেছেন। বর্মার অভিযোগ, তাঁর হাতে থাকা ব্যপম, অগুস্তা ওয়েস্টল্যান্ড, লালুপ্রসাদ যাদবের দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্ত আস্থানার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। একাধিক সংবেদনশীল তদন্তে বাধা সৃষ্টি করেছিলেন আস্থানা। পিটিশনে বর্মা দাবি করেছেন, তদন্তকারী অফিসার, যুগ্ম অধিকর্তা-সহ বাকি অফিসার কোনও বিষয়ে একমত হলেও আস্থানা সহমত হতেন না। সরকারের সঙ্গে আস্থানার সুসম্পর্ক পিটিশনে এভাবে বর্মা ফাঁস করে দেওয়ায় বেকায়দায় শাসক শিবির।
বদলির নির্দেশিকায় কেন্দ্র সাফাই দিয়েছে, জনগণের স্বার্থে এই অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এক সিবিআই কর্তার মতে, “এটা হচ্ছে নজিরবিহীন পরিস্থিতি অনুযায়ী নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত।” বিবদমান দুই কর্তার বিবাদ ২৩ অক্টোবর আদালত পর্যন্ত পৌঁছয়। কেন্দ্র সক্রিয় হয় তারপরই। দুর্নীতি-সংক্রান্ত বিষয়ে সিবিআইয়ের উপরেও শেষকথা বলার এক্তিয়ার আছে সিভিসি-র (সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশন)। সেই সিভিসি-র সুপারিশ হাতিয়ার করে চলতি সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে নরেন্দ্র মোদির সরকার, বলছে বিরোধী শিবির। এক বিবৃতি মারফত সিভিসি জানিয়েছে, দুই কর্তার লড়াইয়ের ফলে সিবিআইয়ের কাজের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, ক্ষুণ্ন হচ্ছিল সুনাম এবং ভাবমূর্তি, এই সিদ্ধান্ত সেই কারণেই।
রাজধানী নয়াদিল্লিতে জোর গুঞ্জন, অধিকর্তা বদলির সিদ্ধান্ত থেকে সিভিসির বৈঠক, সব দায়িত্ব সামলেছেন প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অতিরিক্ত প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি পি কে মিশ্র। মঙ্গলবার রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ক্যাবিনেট সচিব এবং পি কি মিশ্রের সঙ্গে বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই বৈঠকে অলোক বর্মার জায়গায় এম নাগেশ্বর রাও এবং রাকেশ আস্থানার জায়গায় এ কে শর্মার নামে চূড়ান্ত শিলমোহর পড়ে। রাত্রি এগারোটা নাগাদ দিল্লির অফিসপাড়া সিজিও কমপ্লেক্সের পার্শ্ববর্তী সিবিআই সদর দফতরে লাল-নীল ফ্ল্যাশ বাল্বের ঝলকানি হতচকিত করে দেয় তন্দ্রাচ্ছন্ন পাহারাদারদের। অফিসের সামনে এসে দাঁড়ায় দিল্লি পুলিশের গাড়ি-সহ একটি কনভয়। সিবিআইয়ের দুই নয়া যুগ্ম অধিকর্তা এম নাগেশ্বর রাও এবং এ কে শর্মা কনভয় থেকে নেমে সিবিআই অফিসের সোজা এগারো তলে চলে যান। সিল করা হয় অলোক বর্মার ঘর। তারপর বর্মাকে ফোন করে নতুন সিদ্ধান্তের কথা জানান কর্মিবর্গ দফতরের এক পদস্থ আমলা। গভীর রাতে ২ নম্বর জনপথ রোডে বর্মার বাড়িতে কড়া নাড়ে ক্যাবিনেট সচিবের প্রতিনিধি। আগামী জানুয়ারি মাসে অলোক বর্মার অবসর নেওয়ার কথা। তার আগেই এভাবে সরিয়ে দেওয়ার খবরে সরগরম হয়ে ওঠে রাজধানীর রঙ্গমঞ্চ।
সিবিআই সদর দফতরের তরফে মুখপাত্র ২৫ অক্টোবর স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, “অলোককুমার বর্মা প্রধান অধিকর্তা এবং রাকেশ আস্থানা বিশেষ অধিকর্তা পদেই আছেন। বিবাদ মেটাতে তাঁদের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে এবং যতক্ষণ না মুখ্য ভিজিল্যান্স কমিশনার কে ভি চৌধুরির নজরদারিতে ওই দুই আধিকারিকের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এম নাগেশ্বর রাও অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব সামলাবেন।” মুখপাত্র আরও জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীকে সিভিসি পরামর্শ দিয়েছিল, দুই সিবিআই কর্তাকে ছুটিতে পাঠানোর জন্য।সেই পরামর্শ অনুযায়ী জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে ময়দানে নামানো হয়। মাঝরাতে সিবিআই দফতরে তল্লাশি চালানো এবং ব্যাপক রদবদলের সিদ্ধান্ত দোভালই নিয়েছেন।
সিভিসি কর্তৃক অনির্দিষ্টকালীন এবং বাধ্যতামূলক ছুটির পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দেশের শীর্ষ ন্যায়ালয়ের দ্বারস্থ হন অলোক বর্মা। ২৬ অক্টোবর শুক্রবার প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ এই মামলার শুনানিতে জানিয়ে দিয়েছে, রুটিন কাজে ফিরতে পারবেন অলোক বর্মা। তবে তিনি কিংবা এম নাগেশ্বর রাও কোনও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। গত ২৩ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব পাওয়ার পরেই ১৩ জন অফিসারকে বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নাগেশ্বর, সেটাও খারিজ করে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। অর্থাৎ, পরিস্থিতি যথাপূর্বম। অন্য দিকে, অলোক বর্মার বিরুদ্ধে সিভিসি যে তদন্ত শুরু করেছে, তা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে শেষ করতে হবে। প্রাক্তন বিচারপতি এ কে পট্টনায়কের তত্ত্বাবধানে হবে সমগ্র তদন্ত। আগামী ১২ নভেম্বর মামলার পরবর্তী শুনানি।
রাহুল গাঁধী একের পর এক বাক্যবাণে বিদ্ধ করছেন মোদিকে। তার দাবি, “রাফাল ইস্যু নিয়ে তদন্ত চান না মোদি। তাই রাতারাতি শীর্ষ সিবিআই অধিকর্তাকে সরানো হল। ইতিমধ্যে নরেন্দ্র মোদি ৩০ হাজার কোটি টাকা অনিল অম্বানির পকেটে ঢেলেছেন, যা জনসাধারণের টাকা। সত্য একদিন সামনে আসবেই।” দিল্লিতে লোধি রোড থানায় বিক্ষোভ সমাবেশে রাহুল গাঁধীকে প্রতীকি গ্রেফতার করে পুলিশ, অবশ্য কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেওয়া হয়। রাহুল গাঁধী শ্লোগান দিয়েছেন, “চৌকিদার চোর হ্যায়!” কংগ্রেসের নেতৃত্বে লখনউতে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে এবং চন্ডিগড়ে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ জলকামান ছুঁড়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে দয়াল সিংহ রোড থেকে লোদি রোড পর্যন্ত ওই মিছিলে যোগ দেয় তৃণমূল কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, সিপিআই, সিপিআই(এম) এবং লোকতান্ত্রিক জনতা দলের নেতাকর্মীগণ। রাফাল বিমানের পোস্টার নিয়ে সমাবেশের সামনে ছিলেন রাহুল। হাবেভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, যে-রাহুল গাঁধীকে ‘বাবুলোগ’ বলে তাচ্ছিল্য করতেন নরেন্দ্র মোদি, সেই রাহুল গাঁধি আজ সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে সদা প্রস্তুত!