এক জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিরাজি সম্পূর্ণ পাঠ করার জন্য আমাদের এক জীবন যথেষ্ট নয়। অন্যান্য দর্শন, মনস্তত্ত্ব, চিন্তাচেতনা প্রতিবিম্বিত হয়েছে তাঁর সৃজনে। তেমন বাউল-দর্শন ও বাউল গানের শব্দচয়নের আলোছায়া আকৃষ্ট করেছিল কবিকে।
জমিদার ঠাকুর পরিবারের আগ্রহ ছিল বাউল সম্প্রদায়ের প্রতি। লালন শাহের একমাত্র প্রামাণ্য স্কেচ হিসাবে স্বীকৃত যেটা, সেটা ১৮৮৯ সালে অঙ্কন করেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবির জ্যেষ্ঠভ্রাতা। অনুমেয়, দাদার কাছে লালন শাহের পরিচিতি পেয়ে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ। জমিদারি সূত্রে ১৮৯০ সাল থেকে কবি শিলাইদহ যাতায়াত করতেন। ১৮৯১ সাল। ঠাকুর এস্টেট এজমালি কার্যত বড় জমিদারি। পাকাপাকিভাবে কবি জমিদারির ভার নিলেন। এখান থেকে কবি পল্লীবাংলা ও বাউল সংগীতের প্রতি আন্তরিক সান্নিধ্য খুঁজে পাবেন।
১৭ অক্টোবর, ১৮৯০। লালন শাহ দেহরক্ষা করলেন। ‘হিতকরী’ পত্রিকায় ৩১ অক্টোবর সংখ্যায় প্রথম মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হল লালনগীতি। পরবর্তী কয়েক বছরে প্রকাশিত হবে আরও কিছু গান। লালন শাহের প্রতি কবির অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি পাবে ক্রমশ।
তৎকালীন সময়কালে সংগীতচর্চার শীলিত পরিবেশ ছিল, এমন অনুকূল তথ্য নেই। কবি ও তর্জা গান সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করলেন, “উচ্চৈস্বরে চারিজোড়া ঢোল ও চারিখানা কাঁসি সহযোগে সদলে সকলে চীৎকার।” এমনকি, মেয়ে-ঝুমুরের দলে দেবী কালীর উদ্দেশ্যে রচিত গানের ভাষা এত কদর্য ছিল যে সুধী সমাজে তা কহতব্য নয়। তবে শান্তিপুর-হুগলি-চুঁচুড়া এলাকায় প্রচলিত আখড়াই সংগীতে বাদ্য ও গানের মার্জিত ভূমিকা ছিল। ঊনিশ শতকের এহেন প্রতিকূলতায় কবিকে গানের পরিবেশ তৈরি করতে হয়েছিল। তাঁর অনুভব যথার্থ সারবান, “প্রাণহীন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারিধার।” গানের প্রতি আকীর্ণ সংরাগ কবিকে চোদ্দ বছর বয়সে প্রাণিত করেছিল প্রথম গানটি রচনা করতে। সালটা ১৮৭৫। বাউলদের প্রতি কবির আগ্রহ পরিলক্ষিত হবে যুবা বয়সের আরও কিছু রচনায়। ১৮৭৩ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় ‘বাউলের গাথা’ নামক একটি গ্রন্থ নিয়ে লিখলেন ‘বাউলের গান’ শীর্ষক আলোচনা।
বাউল কথাটির উৎস নিয়ে মতভেদ বিদ্যমান। ড. ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের মতে: আউয়াল-আউল-বাউল। বাউল কথাটির শাব্দিক অর্থ সহজিয়া সাধক, দৈবশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। বাউলের সাধনা মূলত গুরুকেন্দ্রীক। চারটি তত্ত্ব নিয়ে গঠিত বাউলচর্যা: আত্মতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, মানুষতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব। সকল তত্ত্ব অঙ্গাঙ্গি বিজড়িত প্রকৃত বাউলের জীবনে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মানুষতত্ত্বের গুণগ্রাহী। বাউলের মতে, “মানুষের করণ কর।” কবিও সমর্থক। বাউল পূজার্চনা, নামাজ-রোজায় বিশ্বাসী নয়। মন্দির-মসজিদ-গির্জায় তাঁদের উৎসাহ নেই। একতারা হাতেই তাঁদের আরাধনা, “মুর্শিদ আমার পথ ঢাইকাছে মন্দিরে মসজিদে।” মানুষতত্ত্বের সমান্তরাল কবির ‘ধর্ম্ম’ সম্বন্ধে নিজস্ব উপলব্ধি, তাই কি আন্তরিক মেলবন্ধন? বাউলচর্যার বাকি তিন তত্ত্ব সম্বন্ধে কবির অনাগ্রহ সাক্ষ্য দেয়, কবি বাউল নন।
বাউল সংগীতে নিহিত মিস্টিসিজম আকৃষ্ট করেছিল কবিকে। জীবন দেবতা, জীবনস্বামী, মানস সুন্দরী, খেয়ার নেয়ে- কবির গানে এমনতর শব্দ ব্যবহার প্রমাণ করে সেটা। ‘গোরা’ উপন্যাসে তিনি উদ্ধৃত করলেন এক চিরন্তন লালনগীতি, “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়/ ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতাম পাখির পায়।”
বাউল সংগীতে নিহিত মিস্টিসিজম আকৃষ্ট করেছিল কবিকে। জীবন দেবতা, জীবনস্বামী, মানস সুন্দরী, খেয়ার নেয়ে- কবির গানে এমনতর শব্দ ব্যবহার প্রমাণ করে সেটা। ‘গোরা’ উপন্যাসে তিনি উদ্ধৃত করলেন এক চিরন্তন লালনগীতি, “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়/ ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতাম পাখির পায়।”
লালনের মতে আত্মতত্ত্ব সম্পূর্ণ অন্তরস্থ করতে পারলে দিব্যজ্ঞানী হওয়া সম্ভব। এবং দিব্যজ্ঞানী মানুষই সক্ষম অধরা ‘মনের মানুষ’ ধরতে। বাউল কথিত এই ‘মনের মানুষ’ কবির রচনায় বারবার উল্লেখিত হয়। গীতবিতানের ৫৮৪ নম্বর গানে আছে, “সে যে মনের মানুষ, কেন তারে বসিয়ে রাখিস নয়ন দ্বারে?/ ডাকনারে তোর বুকের ভিতর, নয়ন ভাসুক নয়ন ধারে।।” গীতবিতানের ৫৫০ নম্বর গানে আছে, “আমার মন যখন জাগলিনারে/ ও তোর মনের মানুষ এল দ্বারে।”
অক্সফোর্ডে বক্তৃতায় কবি “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি” গানটির ইংরেজি অনুবাদ উল্লেখ করেন। সেই বক্তৃতায় উপনিষদের ঋষির সহিত তুলিতব্য লালন শাহের ‘মনের মানুষ’ কবির ভাষায় ‘আননোন বিয়িং’।
অনস্বীকার্য, রবীন্দ্রনাথ প্রথম সদর্থক আলোচনার আলোকে আনেন বাউল সম্প্রদায়কে। তাঁর গানের শরীরে একীভূত হয়েছিল ভারতীয় রাগ সংগীত-প্রতীচি গান এবং দেশজ কীর্তন-লোকগান। তিনি ১৯১৫-১৬ সময়কালে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘হারামণি’ বিভাগে কুড়িটি লালনগীতি প্রকাশ করে মেধাজীবী সমাজের সঙ্গে লালনের সৃষ্টির পরিচয় করিয়ে দেন।
রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিকোণে লালনগীতি ‘ভারতের সভ্যতার পরিচয়।’ কবির আরও সংযোজন, “এ গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু মুসলমানের কন্ঠ মিলেছে, কোরানে পুরাণে ঝগড়া বাধেনি।” তাঁর মতে, সমন্বয়ী সাধনা তথা মানবধর্মের প্রকৃত ধারক-বাহক এই বাউল সম্প্রদায়।