আজকের গরমটা খুব বেশি। পানির জন্য কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা খুলে দেব। খুলেই মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় তার। তাড়াহুড়োয় পানির বোতলটা ব্যাগে ভরা হয় নি। এবারই প্রথম না, যখন যেটা প্রয়োজন সেটা ব্যাগে ভরতে সব সময়ই ভুল করে দেব।
খিটমিটে মেজাজ নিয়েই ফুটপাথ ধরে হেটে চলেছে সে। বাতাসে এলোমেলো চুল আর দাড়িগুলো উড়ছে। তা নিয়ে যে দেবের সামান্য ভাবনাও নেই, তা না যে কেউই বলে দিতে পারবে। কার্জনের ফুটপাথের একটি জায়গায় বসে পড়ে দেব। উঠতি লেখক হিসাবে ইদানিং বেশ নাম ডাক হচ্ছে। বিষয়টি সে খুব উপভোগ করে। কিন্তু কবিদের আড্ডা বা লেখকদের আতেল মার্কা কথা শোনার চেয়ে কার্জনের এই ফুটপাথটি দেবকে কেন যেন বেশি টানে। হয়ত, এখানেই সত্যিকারের মানুষের দেখা মিলে বলে।
পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে বেনসনের প্যাকেটটা বের করে আনে সে। শখের বসে ধরা সিগারেটটা এখন যেন দেবের অক্সিজেনের মত। সিগারেটটা ধরিয়েই চোখ বুজে সে। গুণ গুণ করে গাইতে থাকে নজরুলের “আলগা কর হে খোপার বাঁধন…”। এ গানটি গাইবার সময় কেন যেন বারবার রেমির মুখটা ভেসে উঠে চোখের সামনে।
কার্জনের নিত্যকার কোলাহল দেবের পরিচিত। তাই, এখন এগুলো আর নতুন কিছু মনে হয় না। চোখ খোলার তাগিদও অনুভব করে না সে। হঠাৎই একটি গলার স্বর কানে আসে, দেবের ঠিক পাশেই। বিরক্ত হয়ে দেব আড় চোখে দেখে ধুলোয় ধুসর শার্ট-ছেড়া প্যান্ট পড়া তারই সম বয়েসি একটি যুবক এক মনে কথা বলে যাচ্ছে। বহুদিনের অযত্নে জট বাঁধা চুল, অজত্নে বেড়ে উঠা দাড়ি। এমন চরিত্র ঢাকার রাস্তায় অহরহই মিলে, তাই; আলাদা করে আরো কিছুক্ষণ যুবকটিকে লক্ষ্য করবে কি না ভাবছিল দেব। হাতে তার একগুচ্ছ কাগজ। এর বাইরে আকর্ষণ জাগানোর মতন তেমন কিছুই নেই আর। আরো একটা সিগারেট ধরিয়ে উঠে যাবে কি না ভাবছে দেব, ঠিক এমন সময় কানে আসলো কিছু ইংরেজি বাক্য। আর কেউ না, সে যুবকটিই ইংলিশে অনর্গল নিজের সাথে কথা বলে যাচ্ছে।
এবার যুবকটিকে ভালো করে লক্ষ্য করে দেব। এমন চোস্ত ইংলিশ যে বলতে পারে সে আর যাই হোক পাগল না। দেব আরো একটু কাছে ঘেঁষে বসে যুবকের। যুবকটি একমনে বলেই যাচ্ছে, “এই যে হাতের এই ভাউচার… এটা সরকারি অফিসের। আট টাকার পিন কিনছে আঠারো টাকায়। দশ হাজার পিসে কত টাকা পকেটে গেল? এইটা দেখার কেউ নাই!”। আমি একটা চাকরির জন্য আবেদন করলাম, রিটেনে টিকলাম; ভাইভার সময় বলল দশ লাখ টাকা দাও চাকরি হয়া যাবে। আরে, দশ লাখ টাকা থাকলে তো ব্যবসাই করতে পারতাম। আর যদি দশ লাখ টাকা দিয়াই চাকরি পাইতে হয় এত পড়ালেখা কইরা কি লাভ হইল…
নাম নাজানা যুবকটার কথায় আনমনা হয়ে যায় দেব। যুবকটি তখনো বলে যাচ্ছে, “কোথায় সে মৃণাল সেন? যাকে নিয়ে স্যাররা গর্ব করত? মেট্রিক, ইন্টারে গোল্ডেন; কিন্তু কোনো চাকরি জুটলো না.. .অভিমানে আত্মহত্যাই করল। আরে, বেকুব; ডাবল গোল্ডেন না পায়া চুরি শিখতি, তাইলেও তো অকালে জীবনটা যায় না…
দেব দেখে যুবকটির গলা ধরে এসেছে। ভাউচারটা হাতে নিয়ে আপনমনেই বলছে, এদের সবারই কত টাকা…তাও এদের আরো চাই। সরকারও কোনোদিন হিসাব চায় না, যার আছে তারে আরো দাও। আমি, কতদিন পেট ভইরা একটু ভাত খাই না, আমার ভাতের টাকা দেয়নের ক্ষমতা সরকারের নাই! বোনটারো কত শখ ছিল একটা লাল জামা কিন্যা দিব, কত শখ ছিল….বাড়ির রাস্তাই তো আর মনে আসে না…
কান্নার আওয়াজ কানে আসে দেবের। সাহস হয় না যুবকটার দিকে তাকাতে। চোখ বুঝতেই ভাবনার ডালপালা মেলতে শুরু করে। আরো একটি বেনসনের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে থমকে যায় দেব। একটি বেনসনের পিছনে দেবের যে খরচ, তা দিয়ে অনায়াসেই এক বেলা পেট পুরে খাওয়ানো সম্ভব সে যুবকটিকে। চোখ ফিড়িয়ে পাশে তাকায় দেব। না, ততক্ষণে সে অন্য কোথাও চলে গিয়েছে। আশ্চর্য এক অপরাধবোধ ঘিরে ধরে দেবকে। কিছু কেন যেন সব কিছুর জন্য নিজেকেই অপরাধী মনে হতে থাকে…
আর বসে থাকতে পারে না দেব। উঠে হাটতে শুরু করে অজানার উদ্দ্যেশ্যে। কানে বাজতে থাকতে, কত দিন পেট ভইরা একটু ভাত খাই না…
[সত্য ঘটনা অবলম্বনে]