ঠোঁটের কোণে মন্ত্রমুগ্ধ হাসি আর লাজুক চাহনিতেই জায়গা করে নিয়েছেন হাজারও ফুটবল ফ্যানের হৃদয়ে। আর যারা তার হাসি, চাহনি কিংবা তার নম্র আচরণের প্রেমে পড়েনি তাদেরকে ঘায়েল করেছে তার ফুটবল জাদুতে।
মেসুত ওজিল। এতক্ষণ ২০১৪ বিশ্বকাপ জয়ী এই জার্মান ফুটবলারের কথাই বলছিলাম। বর্তমান বিশ্বের সেরা মিড ফিল্ডারদের মাঝে ওজিল অন্যতম। তার দৃষ্টি-নন্দন পাস কিংবা দুর্দান্ত এ্যাসিস্ট বরাবরই প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করেছে । তার ক্ষুর ধারালো পারফর্মেন্স দেখে তার সাবেক ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের তৎকালীন কোচ জোসে মরিনহো তাকে বিশ্বের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার জিনেদিন জিদানের সাথে তুলনা করেছিলেন। যদিও আজকের মেসুত ওজিলকে সবাই এক নামে চিনছে তবে তার জীবনের শুরুটা ছিলো বেশ কষ্টসাধ্য।
মূলত মেসুত ওজিলের বাবা মোস্তফা ওজিল ও মা গুলজার ওজিল তুরস্কের নাগরিক ছিল। তবে মেসুত ওজিলের পিতামহ ( দাদা) আর্থিক সচ্ছলতার উদ্দেশ্যে পরিবার নিয়ে জার্মানিতে পাড়ি জমান। জার্মানির জেলসেনকির্সেন শহরে তারা বসবাস শুরু করেন। ১৯৮৮ সালের ১৫ অক্টোবর মোস্তফা ওজিল চতুর্থ সন্তানের বাবা হন। এবং পুত্র সন্তানের নাম রাখেন মেসুত মোস্তফা ওজিল। ওজিল বেড়ে উঠছিলো জার্মানের একটি অনুন্নত ও দরিদ্র এলাকায়। কারন তার পরিবার আর্থিক সচ্ছলতা লাভের আশায় জার্মান পাড়ি জমালেও তখনও তারা দারিদ্রতার বেড়াজাল থেকে বেরুতে পারেনি।
তবে পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা মাঝেও ছোট বয়স থেকেই ফুটবলের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন মেসুত ওজিল। বাড়ির পাশের ছোট্ট জায়গায় সব সময় ফুটবল নিয়েই মেতে থাকতেন তিনি। সে সময় তার ফুটবলের প্রতি এতটাই আসক্তি ছিল যে রাতে ফুটবল বিছানায় নিয়েই ঘুমাতো।
ছোট বেলা থেকেই ভালো ফুটবল খেলার কারনে ১৪০০ স্টুডেন্টের মাঝে তিনি স্কুলের ফুটবল দলে জায়গা করে নিয়েছিলো এবং সেই বয়সেই দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়।
তখন ওজিলের ফুটবল প্রতিভা দেখে তার স্কুলের প্রধান জোয়াকেন হেরম্যান তাকে ফুটবল ক্লাবে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। ওজিল প্রথম দিকে জেলসেনকির্সেনের বিভিন্ন যুবক্লাবের হয়ে খেলেন।
তবে স্কুল জীবনের ইতি টেনে যখন কলেজে পা রাখেন, তার কলেজের পাশেই ছিলো শালকে জিরো ফোর এর হোম স্টেডিয়াম ভেল্টিন্স এরিনা। তখন থেকেই তার স্বপ্ন ছিলো শালকে-র মত দলের হয়ে খেলার। সুযোগটাও পেয়ে গিয়েছিলেন খুব সহজেই।
২০০৬ সালে শালকে-র যুব দলের হয়ে খেলা শুরু করেন মেসুত ওজিল। তবে এক সিজন পরেই ক্লাবের সাথে ওজিলের বনিবনা না হওয়ায় শালকে ছেড়ে পাড়ি জমায় আরেক জার্মান ক্লাব ভের্ডার ব্রেমেনে। সেখানে এসেই একের পর এক দৃষ্টিনন্দন পারফর্ম করে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয় এই জার্মান ফুটবলার।
তার পারফর্মেন্সের ওপর ভর করেই তার দল ভের্ডার পোকাল কাপের ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। সে সময় তার ফুটবলের জাদু নজরকাড়ে জায়ান্ট ফুটবল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার ম্যানেজমেন্টের। তবে শেষ পর্যন্ত ২০১০ সালে ১৫ মিলিয়নের বিনিময়ে জার্মান থেকে স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমান মেসুত ওজিল। সেখানে যাওয়ার এক সিজন পরেই রেকর্ডের পাতায় নাম লেখান এই জার্মান। ইউরোপিয়ান প্রথম সারির লিগ গুলোর মাঝে প্রথম ফুটবলার হিসেবে এক সিজনে ২৫ টি এ্যাসিস্ট করার কৃতিত্ব অর্জন করেন মেসুত ওজিল।
মাদ্রিদে ধারাবাহিক পারফর্মেন্স করার পরও হঠাৎ করেই ২০১৩/১৪ মৌসুমে ওজিলকে আর্সেনালের কাছে বিক্রি করে দেয় মাদ্রিদ। এভাবে ওজিলকে ছেড়ে দেরাটা মাদ্রিদ ভক্তদেরকে প্রচণ্ড কষ্ট দিয়েছে এবং সে সময় অনেক মাদ্রিদ সমর্থক ওজিলকে বিক্রি করায় ম্যানেজমেন্টের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
মাদ্রিদ থেকে ঠিক কত দরে ওজিলকে দলে ভেড়ানো হয়েছে তার সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও ধারনা করা হয় ৪২.৫ মিলিয়ন ইউরোতে তাকে দলে ভেড়ায় ইংলিশ ক্লাবটি। আর্সেনালে যোগ দেয়ার পরই আর্সেনালের ৯ বছরের শিরোপাখড়া কাটে ওজিলের দূর্দান্ত পারফর্মে। ক্লাবে দূর্দান্ত পারফর্ম করার পাশাপাশি জাতীয় দলের হয়েও ওজিল ছিল অপ্রতিরোধ্য। ২০০৬ সালে জার্মান অনুর্ধ -১৯ ও দুই বছর পর অনুর্ধ -২১ দলে খেলেন ওজিল। ২০০৯ সালে জার্মান জাতীয় দলে জায়গা পায় ওজিল। তিনি জার্মানের হয়ে খেলেছেন ৩ টি বিশ্বকাপ এবং এর মাঝে ২০১৪ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।
কিন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি, জাতীয় দলে খেলা অবস্থায় তাকে বহুবার বর্ণবাদের শিকার হতে হয়েছে। অনেক সময় সংবাদ সম্মেলনেও সাংবাদিকরাও তাকে তার জাতীয়তা নিয়ে প্রশ্ন করে বসত। ওজিল বেশ শান্তভাবে হেসে উত্তর করতো- “তুরস্ক আমার কাছে বিশেষ কিছু, তবে আমি আমাকে জার্মান বলে পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।” সর্বশেষ ২০১৮ বিশ্বকাপে সবাইকে অবাক করে জার্মানি গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিলে অনেকে ওজিলের সমালোচনা শুরু করেন। তখন খানিকটা অভিমান ও কষ্ট নিয়েই জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষনা দেন মেসুত ওজিল।
জার্মান জাতীয় দল থেকে অবসর নিলেও এখনও আর্সেনালের হয়ে মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ওজিল। এখনও আর্সেনালের জার্সি গায়ে ঠোঁটের কোণে হাসি আর লাজুক চাহনির পাশাপাশি পায়ের জাদুতে পুরো ফুটবল বিশ্বকে মাতিয়ে রেখেছেন মেসুত ওজিল।