একজন অন্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

একজন অন্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

বাংলাদেশের রাজনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে যে ক’জন রাজনীতিবিদের নাম উচ্চারণ করা হয় তার মধ্যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অন্যতম। বর্তমান সময়ে শারীরিকভাবে তিনি খুব একটা সুস্থ নন। সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস’র উপর নির্ভর করে এক রকম বেঁচে আছেন। কিন্তু রাজনীতি যার মন ও মগজে, জনগণের অধিকার আদায়ের তাড়ণা যার হৃদয়ে তাকে কি আদৌ ডায়ালাইসিস দমাতে পারে? পারে নি! আর তাইতো শরীরের এই অবস্থার মধ্যেই তিনি ছুটে বেড়াচ্ছেন— শহর থেকে শহরে, দেশ থেকে দেশে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীরর অফুরন্ত শক্তি, উৎসাহ, আবেগ কাজ করে এই ছুটে চলার পিছনে।

‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ ছিল এদেশের মধ্যবিত্তের মৌলিক একটি প্রকাশনা। সর্বোচ্চ প্রচারণা ছিল বিচিত্রার প্রধান হাতিয়ার। সত্তরের দশকের বিচিত্রার প্রচ্ছদে শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, মাওলানা ভাসানী প্রমুখ ব্যতিত যে হাতে গোনা ক’জন ব্যক্তির ছবি স্থান পেয়েছিল তাদের একজন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সোনালি ধানক্ষেতের সামনে ঝাকড়া চুলে দাঁড়িয়ে থাকা সেই তরুণের নাম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসমারিক পদক ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রাপ্ত ব্যাক্তিত্ব। আজ থেকে আরও ৪১ বছর আগেই তার এই অর্জন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠনের প্রথম বৈঠকের সভাপতি ছিলেন তিনি। বহুবছর এই সংসদের প্রধানের দায়িত্বও পালন করেছেন।

ডা. জাফরুল্লাহর জন্ম ২৭ ডিসেম্বর ১৯৪১। চট্টগ্রামে। বেড়ে ওঠা ও শিক্ষাজীবন কাটে ঢাকায়। বকশীবাজার স্কুল, ঢাকা কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজই তার শিক্ষালয়। ১৯৬৪ সালে তিনি ইউরোপ পাড়ি জমান। জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস ডিগ্রি নেন। এর মধ্যে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তিনি ফিরে আসেন তার জন্মভূমিতে। সাধারণ সৈনিক হিসেবে অস্ত্রহাতে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেই সময় প্রয়োজন পড়ে ফিল্ড হাসপাতালের। তিনিই গড়ে তোলেন প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল। নাম, ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। ডা. জাফরুল্লাহ এবং অ্যাকসিডেন্ট ইমারজেন্সি চিকিৎসক ডা. মবিন মিলে মুক্তিযুদ্ধাকালীন সময়ে চিকিৎসা খাতে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন।

মাঝবয়েসী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

মুক্তিযুদ্ধ’র পরপরই তিনি ইচ্ছে করলে ঢাকার প্রধানতম সার্জন হতে পারতেন। নব্য স্বাধীন একটি দেশে রাতারাতি বিত্তশালী হওয়ার জাদুর কাঠি ছিল তার হাতে কিন্তু না করে ফিরে যান গ্রামে— আরেক যুক্তক্ষেত্রে। গড়ে তোলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।

ডা. জাফরুল্লাহর পাইলট প্রজেক্ট গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র: প্রাইমারি কেয়ার কনসেপ্ট তার গুরুত্ব প্রমান করতে সক্ষম হয় এবং এই মডেলের ভিত্তিতে WHO এবং UNO ‘গ্লোবাল ইউনিভার্সাল প্রাইমারি কেয়ার’ প্রকল্পের ঘোষণা দেয়। গ্লোবারল প্যারামেডিক’ ধারণার উদ্ভাবকও তিনি। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অর্জনও রয়েছে জনবান্ধব। চিকিৎসা ক্ষেত্রে তিনি অগ্রগণ্য নাম। ট্রেইন্ড প্যারামেডিক দিয়ে মিনি ল্যাপারোটমির মাধ্যমে লাইগেশন সার্জারির উদ্ভাবক তিনি। এ সংক্রান্ত তার গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ‘ল্যানসেট’এ। যুক্তরাষ্ট্রের পেডিয়াটিক্স টেক্সট বইয়ের চ্যাপ্টারও লিখতেন তিনি।

এছাড়াও জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৭৯ সাল থেকে জাতীয় শিক্ষা কমিটির ও নারী কমিটির সদস্য। গণস্বাস্থ্যের উপর লেখা তার ‘ম্যাগনাম ওপাস’ই হচ্ছে ১৯৭২ সালের জাতীয় ঔষধ নীতি!

বর্তমান সময়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী শিকার হচ্ছেন রাজনৈতিক হয়রানি। হেনস্থা করা হচ্ছে পদে পদে। উঠছে চাঁদাবাজির মিথ্যা অভিযোগ। করতে পারছেন না স্বাভাবিক কাজকর্ম। বারবার আদালতে দৌড়াতে হচ্ছে আইনি জটিলতা ছাড়াতে। অথচ কে বলবে, এই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীই বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছিলেন ‘র‌্যামন ম্যাগসেসে’।