শিশুর জন্য যেমন পৃথিবী

শিশুর জন্য যেমন পৃথিবী

আমরা যেখানে থাকি সেই এলাকাটা নদীর পাশে থাকা হাউজিং সোসাইটি। পড়াশোনা, চিকিৎসা, শপিংসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজের কারণে আমাদের নদী পার হতেই হয়।

সেদিনও যথারীতি ক্লাস করবার জন্য বের হয়েছি, ট্রলারে উঠেছি। স্বাভাবিকভাবেই চোখ পড়লো ট্রলারে থাকা মানুষজনের দিকে। একটা ২-৩ বছরের বাচ্চাকে দেখলাম, ট্রলারের একেবারে পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। বারবার পানি ছুঁতে চাচ্ছিলো হাত দিয়ে কিন্তু পারছিলোনা। আমি এই দৃশ্য দেখে ভয়ে পেয়ে গেলাম। দেখলাম বাচ্চার সাথে থাকা ভদ্রমহিলাটি, সম্ভবত মা-ই মোবাইলের স্ক্রিনে বেশ মনোযোগী, কী যেন টাইপ করছে, মনে মনে হাসছে। বাচ্চাটার দিকে তার কোনো খেয়াল নেই। অন্য এক ভদ্রলোক দেখলাম বাচ্চাটার মাকে বিষয়টা নিয়ে কনসার্ন করছেন। মহিলা যার পর নাই বিরক্ত হয়ে ঝাক্কি দিয়ে বাচ্চাটাকে চুপ করে বসে থাকতে বলল। ভদ্রমহিলা আবারো ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেদিন আমার একটা পরীক্ষা থাকায় আমি সময় নষ্ট না করে বই খুলে চোখ বোলাতে লাগলাম। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই আল্লাহ বলে চিৎকার শুনলাম। হইচই। বুঝলাম না। এরপর মাঝি নৌকা থামালো। বাচ্চা খালে পড়ে গিয়েছে। ঠিক যেখানে আমাদের ট্রলার  ভেড়াবে তার একটু আগেই বাচ্চাটা পড়ে গিয়েছিল। অন্য নৌকায় থাকা এক লোক বাচ্চাটাকে উঠিয়ে আনল। ভাগ্য ভালো থাকায় তখন ভাটার সময় ছিল, পানি কম ছিল খালে। ভদ্রলা দেখলাম এক হাতে ফোন আর অন্যহাতে ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে চিল্লাচ্ছেন, লাফালাফি করছেন। দেখলাম অই চাচা অই মহিলাকের বকছিলেন। আমারো তাই মনে হয়েছে, ভদ্রমহিলার অসচেতনতার কারণে আজকে শিশুটির জীবন পর্যন্ত চলে যেতে পারত।

এরকম নানা প্রকার উদাহরণ আমরা আমাদের আশেপাশে আরো অনেক দেখতে পাবো। ভেবে দেখুন তো আমাদের অসাবধানতা, অযত্ন, উদাসীনতা, মনযোগ, আন্তরিকতার অভাবে একটা শিশু তার প্রাপ্যটুকুন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেনাতো?

নিজেই বরং উত্তরগুলো খোঁজার চেষ্টা করি

১. শিশুদেরকে মোবাইল গেমসে আসক্ত না করে আমরা বরং তাদেরকে সৃজনশীল কাজেকর্মে উৎসাহ দিতে পারি। কোন সৃজনশীল কাজে আপনার শিশুর আগ্রহ বেশি, সেদিকে ফোকাস করি। মাঝেমাঝে নিজেরাও বসে যেতে বাচ্চাদের সাথে। নিজেই হয়ে যেতে পারেন খেলার সঙ্গী। যেসব খেলা খেললে স্মরণশক্তি বাড়ে অথবা খেলতে খেলতেই পড়া হয়ে যাচ্ছে সেসব কাজও খেলাচ্ছলে করতে পারেন। এছাড়া বাচ্চারা হয়তো নেট ঘাটতে ঘাটতে ভুল কোথাও চলে যাচ্ছে, যা তাদের মস্তিষ্কের জন্য হবে চরম ধাক্কা। এছাড়াও বাচ্চাদের সামনে রোমান্স এভয়েড করুন। বাচ্চাদের সামনে রোমান্স করলে তা তাদের মনকে ভীষণভাবে জেলাসি বা বিব্রতভাব অথবা মন খারাপের কারণ হয়।

২. কিছু কিছু কাজ বাচ্চাদের নিজেদেরই করতে দিন। এতে বাচ্চারা কর্মচঞ্চল থাকবে, শরীরও ফিট থাকবে। কর্তব্যপরায়ণ হবে। খেলাধুলা শেষে নিজের খেলনা নিজেকেই গুছিয়ে রাখতে বলুন। পড়াশোনা শেষে নিজের বই খাতা, টেবিল নিজেকেই সাজিয়ে রাখার অভ্যাস গড়ে তুলুন। নিজেদের জামা জুতা নিজেদেরই পরতে দিন। ভুল হলে সংশোধন করিয়ে আবার কাজটা করতে দিন। আপনি যখন কাজে ব্যস্ত থাকবেন তখন আপনার বাচ্চাকে বলুন এটা ওটা এগিয়ে দিতে। এতে বাচ্চারা কর্ম উদ্যমী হবে। কাজকে ভয় পাবেনা, অলসতা থেকে দূরে থাকবে।

৩. বাচ্চাদের সাথে শব্দ বা বাক্য ব্যবহারে সচেতন হোন। স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চারা প্রশংসা শুনতে অনেক পছন্দ করে। তাই কোনো কাজে ভুল হলে, শুরুতেই তাদের না বকে বরং বলুন- কাজটা অনেক ভালো হয়েছে কিন্তু এভাবে হলে আরো ভালো হবে। তারা যদি পড়াশোনায় ধীরগতি সম্পন্ন হয়েও থাকে, তাদের উপর বিরক্ত না হয়ে বরং বলা যেতে পারে- তুমি এতো ভালো লিখতে পারো আরেকটু মনযোগী হলেতো আরো ভালো করবে। এতে তারা উৎসাহ পাবে। অনেক বাচ্চারাই আশেপাশের পরিবেশ থেকে হয়তো গালিগালাজ শিখছে। এসব ক্ষেত্রে শুরুতে তাদের ভালো করে বুঝিয়ে বলুন এরপরেও যদি আচরণে সংযত না হয় তবে শুরুতেই কঠোরভাবে এসব থেকে বিরত রাখুন অন্যথায় এসব অভ্যাস থেকেই যাবে। বাচ্চাদের সাথে যথাসম্ভব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলুন। বাচ্চারা কথা বার্তার আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট হলে পরবর্তীতে এগুলো ভালো ক্যারিয়ার গঠনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।

৪. বাচ্চাদেরকে ইউটিউবের মাধ্যমে বা ভিডিও -এর মাধ্যমে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল না দিয়ে বাস্তবে শেখান। এতে করে বাচ্চারা সামাজিক হবে। বাচ্চারা অন্যের সাথে মিশতে ভয় পাবেনা। মোবাইল ফোনে তাদের জীবন আবদ্ধ রাখলে হয়তো তাদের মুখস্থ বিদ্যা বাড়বে কিন্তু বাস্তবিক জ্ঞান বাড়বেনা। তারা ভিতু হবে এবং ভবিষ্যতে কঠোর পরিস্থিতি ফেইস করতে অসফল হবে বা নার্ভাস হয়ে পড়বে। তাই যথাসম্ভব বাচ্চাদের প্রাকটিক্যাল শিক্ষা দিন। ইউটিউবের মাধ্যমে বিভিন্ন ফল ফুল না চিনিয়ে বরং তাদের নিয়ে পার্কে ঘুরতে যান, বোটানিক্যাল গার্ডেনে যান, গ্রাম ভ্রমণ করুন। নিজ হাতে থাকে বাস্তবিক জ্ঞানগুলো দিতে চেষ্টা করুন। নিজে কোনো কাজ করবার সময় বাচ্চাদেরও সাথে রাখুন যাতে আপনাকে দেখে দেখে এসব কাজ সে শেখে বা করতে উৎসাহী হয়। বাচ্চাদের জন্য আদর মমতা অবশ্যই আমাদের থাকবে কিন্তু তা যেন অতিরিক্ত না হয়ে যায় যাতে তা তাদের বিকাশের অন্তরায় হয়।

৫. নিকট আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখুন। এতে করে পারিবারিক বন্ডিংস বাড়বে পাশাপাশি বাচ্চারাও সামাজিক হবে। আত্মীয় স্বজন, পরিবার একটা মানুষের জীবনে কত গুরুত্বপূর্ণ সেই শিক্ষা তারা পাবে। আপনার আত্মীয় যদি গ্রামেও থাকে, তাকেও সমান গুরুত্ব দিন যতটুকু দিচ্ছেন আপনার শহুরে আত্মীয়দের। এতে করে বাচ্চারা হিংসা এবং অহংকার মুক্ত থাকবে। পরিবারের সবার প্রতি দায়িত্ব পালন করুন, ডেডিকেটেড হউন। এতে করে বাচ্চাদের মাঝেও দায়িত্ববোধের তাড়না তৈরি হবে। বাচ্চারা স্বার্থপর হবেনা। নিজেকে অন্যের বিপদে বিলিয়ে দেবার উৎসাহ পাবে। তারা পরোপকারী হবে। সেই সাথে যে যার ধর্মের হয়ে থাকুন না কেন, তাদের যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষা দিতে থাকুন। ধর্ম আমাদের অনেক ভালো শিক্ষা দেয়, তাদেরকে সে শিক্ষাগুলো আহরণের সুযোগ করে দিন। ন্যায়-অন্যায় বোধ তৈরিতে সাহায্য করুন।

পরিশেষে, মনে রাখা জরুরি প্রতিটা শিশুই কিন্তু নিষ্পাপ হয়ে জন্ম নেয়। এরপর তাদের মাঝে ভালো গুণ বা খারাপ গুণগুলো কিন্তু আমরাই আপলোড করি। তাই বাচ্চারা কেমন হবে তা অনেকাংশে নির্ভর করবে আমাদের উপর। বাচ্চাদেরকে বন্ধু নির্বাচনে সাহায্য করুন। বরং নিজেই হয়ে যান বাচ্চাদের সেরা বন্ধু।

একটা কথা মনে রাখা জরুরি, যখন কেউ ঘরে খাবার না পায় তখনই কিন্তু সে ডাস্টবিনে যায় খাবার খুঁজতে। তাই বাচ্চারা খারাপ সঙ্গী নির্বাচন করবার আগেই নিজেই বরং বাচ্চাদের সবটুকু অভাব পুরণ করুন। ওদেরকে একটা সুন্দর পৃথিবী দেবার দায়িত্বতো আমাদেরই।