বাংলাদেশে এখন একধরণের ‘আওয়ামী নারীবাদ’ আমরা দেখছি। সারা দুনিয়াতেই পুঁজিবাদের দাশ হিসেবে একশ্রেণীর নারীরা ভূমিকা পালন করেন এবং রাজনৈতিকভাবে জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকেন। এই ধরণের নারীবাদের ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করা এখন জরুরি কাজ। গত ৬ অক্টোবর ২০১৮ আল জাজিরায় প্রকাশিত হয় নারীবাদী লেখক আয়ান হিরসি আলীর ‘সাম্রাজ্যবাদী নারীবাদ’ প্রসঙ্গে আজিজা কানজির বিশ্লেষণ। এখানে লেখাটি বাংলাদেশের জন্য সমান প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে জবানের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন, উম্মে সালমা।
আমেরিকার সুপ্রিমকোর্ট এবং আদালতে কোনো তদন্ত ছাড়াই বিচারক ব্রেট কাভানোঘের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের একাধিক অভিযোগ উত্থাপিত হয় এবং শুনানির পর তার প্রচণ্ড ক্রোধ এবং অন্যান্য অনুভূতিগুলোরও বহিঃপ্রকাশ ঘটে। প্রচণ্ড দুঃখ, কষ্ট এবং যুক্তিযুক্ত রাগের ব্যাপক আলোড়ন দেখা গেল।
যাই হোক, কাভানোঘ পুরো প্রক্রিয়াটিতে আসল ভুক্তভোগী, যেখানে ‘নারী অধিকারের পক্ষের উকিল’ স্ট্যানফোর্ডের একজন বিশিষ্ট সহকর্মী আয়ান হিরসি আলী।
তিনি এক টুইটে প্রকাশ করেন, সিনেটকে অবশ্যই ‘ব্রেট কাভানোঘকে অনুমোদন দিতে হবে’ এবং বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত নিবন্ধগুলোতে ব্রেটকে সালেম উইচ ট্রায়ালগুলোর সাথে তুলনামূলকভাবে একটি লক্ষ্যবস্তুতে রূপ দেওয়া হয়েছে এবং এটি এমন একটি উপমা যেখানে বিষ্ময়করভাবে প্রাতিষ্ঠানিক পিতৃতন্ত্রের অখ্যাত প্রদর্শনগুলোর মাধ্যমে পিতৃতান্ত্রিক সহিংসতা প্রকাশ পায়।
বিচারক কাভানোঘ এর ‘অধিকার’ নিয়ে আয়ান হিরসি টুইটারে জিহাদ ঘোষণার পাশাপাশি এটাও প্রমাণিত করেছেন, তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের একজন পুরোপুরি সমর্থক এবং নারী অধিকারের বিরুদ্ধে তার সহাবস্থান।
ইসলামে নারীর প্রতিরক্ষার বিষয়ে কথা বলায় এই একই নারী পশ্চিমা বিশ্বে সাহসী নারীবাদী হিসেবে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন। তার কাজের উপর গভীর পর্যবেক্ষণসহ আলোকপাত করলে দেখা যায় নারীর সুরক্ষা এবং সমতার পক্ষে তার ওকালতিতে নিয়মাবলী বা সামঞ্জস্যতার যথেষ্ঠ ঘাটতি রয়েছে। এবং বিকৃত ও মিথ্যা সমাচারের উপর ভিত্তি করে তার ইসলামের উপর ‘সমালোচনামূলক প্রবন্ধ’ রচিত হয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদী নারীবাদী নারীদের প্রতি অ-মুসলিমদের সহিংসতায় হিরসি আলীর প্রবল উদ্যমী সহায়তাপূর্ণ মনোভাব প্রমাণ করে তার রাজনীতি প্রকৃতপক্ষে নির্যাতনের বিরুদ্ধে নয়, বরং ইসলামের বিরুদ্ধে। তিনি কখনোই মুসলিম নারী-পুরুষের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর সংঘটিত অপরাধের বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি। বরং তিনি অ-মুসলিম নারীদের দুর্দশার প্রতি উদ্বেগের যথেষ্ঠ অভাব ব্যক্ত করেছেন।
সাম্রাজ্যবাদী নারীবাদী নারীদের প্রতি অ-মুসলিমদের সহিংসতায় হিরসি আলীর প্রবল উদ্যমী সহায়তাপূর্ণ মনোভাব প্রমাণ করে তার রাজনীতি প্রকৃতপক্ষে নির্যাতনের বিরুদ্ধে নয়, বরং ইসলামের বিরুদ্ধে। তিনি কখনোই মুসলিম নারী-পুরুষের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর সংঘটিত অপরাধের বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি। বরং তিনি অ-মুসলিম নারীদের দুর্দশার প্রতি উদ্বেগের যথেষ্ঠ অভাব ব্যক্ত করেছেন।
আনুষ্ঠানিকভাবে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর থেকেই হিরসি তার একজন উৎসাহী সমর্থক। নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পর্কে বা হাজার হাজার অভিবাসী শিশুদের তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে আলাদা করার বিষয়ে তিনি কখনোই সমালোচনা করেন নি; তবে তিনি উল্লেখ করেন ট্রাম্পের ‘মৌলবাদী ইসলাম’ এই বিষয়ের উপর মনোযোগ হারিয়ে গেছে।
তিনি মুসলমানদের নিষেধাজ্ঞা প্রসারিত করতে এবং মুসলিম অভিবাসীদের ‘চরম প্রতিবন্ধকতা’ ত্বরান্বিত করতে ট্রাম্পকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছেন: অসহায় ক্ষতিগ্রস্থদের মতো একযোগে মুসলমান নারী এবং পুরুষের উপর যৌথ শাস্তি আরোপ করা।
মুসলিম নারী শরণার্থীদের রক্ষা করতে ব্যর্থতার পাশাপাশি (পশ্চিমে শরণার্থীদের অবস্থা অনুসরণ করা সত্ত্বেও) হিরসি আলী আমেরিকান নারী বা সহকর্মী নারীবাদীদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করতেও ব্যর্থ হন। তিনি ‘এন্টি-ট্রাম্প ক্রুসেড’ হিসেবে নারীদের মার্চ বাতিল করে দেন এবং সেই সাথে তিনি উত্তর আমেরিকার নারীবাদীদের ‘নির্বোধ নারী’ বলে দাবি করেন যারা গৃহের কাজের মতো ‘তুচ্ছ’ ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
সাম্রাজ্যবাদী নারীবাদের ইতিহাসে হিরসি আলীর একতরফা যুক্তি ও দ্বৈত মান খুবই সাধারণ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে যেমন ভূস্বামী ক্রোমার এবং কার্জন যারা আন্দোলনকারী নারীদের ভোটাধিকারের জন্য সংগঠন করে নিজেদের ঔপনিবেশিক এলাকায় বসবাসকারী নারীদের উদ্ধারকর্তা হিসেবে জাহির করেছিলেন, ঠিক তেমনি বুশ মুসলমান নারীদের উদ্ধারপ্রকল্পে বিশ্বব্যাপী ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করেছিলেন যেখানে আমেরিকায় নারীর প্রজনন অধিকারকে অবমাননা করা এবং নারী স্বাধীনতার প্রতি বিদ্রুপাত্মক কঠোর মনোভাব দীর্ঘদিন যাবৎ সাম্রাজ্যবাদী ক্রুসেডারদের বিশেষত্ব ছিল।
হিরসি আলীর মতো ব্যক্তিরা সমাজকে কিছু দিয়ে থাকেন যা ক্রোমার, কার্জন, এবং বুশেরা করতে পারেন না। আপাতদৃষ্টিতে আধিপত্যবাদীদের অভ্যন্তরীণ নির্ভেজাল অনুমোদিত আলোচনাগুলোই একটি সীলমোহর। এবং তারপরেও, তার বিবৃতিতে বিকল্প গুণগত মান এবং তার রাজনীতি তুলনামূলক ট্রাম্প প্রকৃতির হওয়া সত্ত্বেও, হিরসি আলী ধারাবাহিকভাবে আইভিলিগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মর্যাদাপূর্ণ পদে অবতীর্ণ হন এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, নিউইয়র্ক টাইমস, এবং ওয়াশিংটন পোস্ট সহ বিখ্যাত সংবাদপত্রিকাগুলোতে বিশিষ্ট পদে অভিষিক্ত হয়েছেন।
গত বছরের একটি সাক্ষাৎকারে নারী মার্চের আয়োজকদের অবজ্ঞা করে হিরসি আলী বলেন, যে সকল সচেতন নারীবাদীগণ নারী এবং পুরুষের সমতার ব্যাপারে যত্নবান তাদের অবশ্যই এ সকল কপট নারীবাদীদের সাথে দেখা করা উচিত না। তবে তার ওকালতির নথিপত্র পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, তার নিজস্ব নারীবাদীর পক্ষে প্রমাণপত্রাদি অনেক বড় লজ্জারই শামিল।
ইসলামকে ভুল হিসেবে উপস্থাপন করা হিরসি আলী ইসলাম ধর্মের শুধু একজন সমালোচকই নন; বরং মুসলিম নির্মূলের একজন চিয়ারলিডারও। তিনি এক সাক্ষাৎকারে ইসলামকে ‘ধংসাত্মক, নৈরাশ্যবাদী মৃত্যু’ বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং তিনি আরও বলেন, এর অবশ্যই নিষ্পিষ্ট হওয়া প্রয়োজন ধ্বংস এবং মৃত্যুর কঠিন এবং বিদ্বেষপূর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে। তবে তিনি একই সাথে মুসলিম নারীদের অধিকারকেও সমর্থন করেন।
ইসলাম এবং মুসলিমদের সম্পর্কে হিরসি আলীর চিত্রায়ণের সাথে তার রচিত জীবনীর সাথে একটি সূক্ষ্ম সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে তিনি নেদারল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার জন্য অযৌক্তিক কাল্পনিক গল্প উপস্থাপন করেন। ২০০৭ সালে আত্মজীবনী ‘ইনফিডেল’এ তিনি পাঠকদের অনুরোধ করেন, “একজন দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি হিসেবে নয়, বরং যথার্থতার উপর ভিত্তি করে তার যুক্তিগুলোকে বিচার করতে।” তবে যেভাবেই তার যুক্তিগুলোকে বিচার করা হোক না কেন তার ভয়ংকর মিথ্যা বর্ণনা উপস্থাপনার ফলশ্রুতিতে তার চিত্তাকর্ষক প্রতিভাই প্রকাশ পায়।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, হিরসি আলী তার সম্প্রতি প্রকাশিত ‘হেরেটিক’ বইয়ে উল্লেখ করেন, কেন বর্তমানে ইসলামের সংশোধন প্রয়োজন? এবং বিশ্বাসের পাঁচটি মূল স্তম্ভের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এগুলোর দ্রুত সংশোধনের প্রয়োজন: নবী ‘মোহাম্মদের আংশিক ঐশ্বরিক অবস্থান’, ‘মৃত্যুর পর জীবনের আধিপত্য বিস্তার’, ‘শরিয়াহ, ধর্মীয় বিধিবিধানের বিশাল সংস্থা’ ‘প্রত্যেক মুসলিমের আইন প্রয়োগের অধিকার’ এবং ‘জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক।’
যাইহোক, পাঁচটির একটিও ইসলামে যথাযথভাবে বর্ণিত মূল নীতি নয়, বর্ণিত এগুলোর তর্জমা অস্পষ্ট রূপে উপস্থাপন করা এবং তাদের সংস্কারের আহ্বান (এখন!) অযৌক্তিক।
হিরসি আলীর কিছু নীতি মূলধারার ব্যাখ্যার সম্পূর্ণ বিপরীত। নবী মোহাম্মদকে কখনোই আধ্যাত্মিক বলে বিবেচনা করা হয় না বরং কুরআনে ‘শুধুমাত্র মানুষ’ হিসেবেই বারবার বর্ণিত আছে এবং স্রষ্টার কাছাকাছি অমরত্বের সঙ্গী হিসেবে আখ্যা দেওয়া মূলত পাপ বা আইনত লংঘন। ব্যক্তিগতভাবে কেউই ইসলামের আইন নিজে প্রয়োগ করার অধিকারই রাখে না, মুসলিম আইন কর্তৃক এটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
হিরসির বাকি ধারণাগুলোও ভুল। পার্থিব জীবনের গুরুত্বের অবমূল্যায়ন না করে, কুরআন এই জীবনে কর্মের পরকালের পুরস্কার বা শাস্তির উপর ভিত্তি করে প্রতিনিধিত্ব করে। শরিয়াহ বিধিসম্মত আইনের একটি বই নয় বরং উইসকন্সিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপিকা আসিফা কুরাইশ-ল্যান্ডেসের ভাষায়, “ইসলামিক জীবনযাপন করার জন্য মুসলিমদের উদ্দ্যেশ্যে কুরআন ভিত্তিক নির্দেশনা। ” এবং জিহাদ কোনো ধর্ম যুদ্ধ নয় -এই পবিত্র যুদ্ধের ধারণাটি হলো ইউসিএলএ’র আইনের অধ্যাপক খালেদ আবু ইল ফাদল উল্লেখ করেন, ইউরোপিয়ান খ্রিস্টান সংস্কৃতির একটি স্বতন্ত্র পণ্য… ইসলামি ধর্মতত্ত্বে এই বিশুদ্ধ বা পবিত্র যুদ্ধের ধারণা সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই।
হিরসি আলীর ইসলামের মৌলিক তথ্য সম্পর্কে উপলব্ধি বিরক্তিকর পর্যায়ের, বিশেষ করে হার্ভার্ড এবং স্ট্যানফোর্ড ওয়েবসাইটে ‘বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে কাউকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং ইসলামি রাজনৈতিক তত্ত্বের বিষয়ে সেমিনারে শিক্ষাদান করার জন্য নিযুক্ত করা।
যেখানে অন্য বর্ণের অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন নারীরা সবসময় সংগ্রাম করে আমেরিকান একাডেমী থেকে তাদের বহিষ্কারের বিরুদ্ধে, হিরসি আলীকে অভিজাত সমাজের কাছে উন্মুক্ত অস্ত্রের সাথে স্বাগত জানানো হয়েছে। স্পষ্টতই, এই অভিজাতদের পাণ্ডিত্যপূর্ণ দূর্বোধ্যতা বা নির্ভুল বাস্তবিকতা কোন কিছুতেই হিরসি আলীর হস্তক্ষেপের উপযোগিতা নিহিত নয়। বরং উভয় ক্ষেত্রে ব্যাপক ঔদাসীন্য লক্ষণীয়। তবে মুসলিম নারীদের পক্ষে দাঁড়ানোর অন্তরালে কিছু মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার ব্যঙ্গচিত্র সম্পর্কে তাদের সমর্থন প্রকাশ পায়।
তার সাম্রাজ্যবাদী ভ্রান্ত নারীবাদীকে অস্বীকার করে অন্তত আমরা বিশ্বজুড়ে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত মুসলিম কর্মী ও সংগঠনগুলোকে সমর্থন করতে পারি; যাদের সাহসী এবং অপরিহার্য কাজ কেবল চরম ইসলামপন্থী এবং আয়ান হিরসি আলীর মতো ভাববাদীদের সুরক্ষিত চিন্তাভাবনার প্রসারের জন্য আরো কঠিন আকার ধারণ করেছে।