ধূসর থেকে আরো ধূসর হচ্ছে লোপেতিগের মাদ্রিদ

ধূসর থেকে আরো ধূসর হচ্ছে লোপেতিগের মাদ্রিদ

ক্রমশ ধূসর হতে শুরু করেছে অল হোয়াইটস খ্যাত রিয়াল মাদ্রিদ। মৌসুমের শুরু থেকে খুড়িয়ে চলা রিয়াল আন্তর্জাতিক বিরতির পর ব্যর্থতার শ্রাদ্ধ করে নতুন করে শুরু করবে এটাই ছিল স্বাভাবিক প্রত্যাশা। সেটি তো ঘটেইনি বরং লেভান্তের বিপক্ষে ডুবেছে ২-১ গোলে হারের লজ্জায়। যে দলটি কিছুদিন আগেও ইউরোপের ত্রাস ছিল তারাই কেন যে কারো বিপক্ষে তাসের ঘড়ের মত ভেঙে পড়ছে সেটি নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।

গোড়াতেই গলদ 

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের রেশ থাকাবস্থাতেই জিদান যখন বিদায়ের ঘোষণা দিলেন মাদ্রিদ বোর্ডের উচিত ছিল বিশ্বকাপের নতুন কোচ নিয়োগের ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করা। সেটি না করে, অনেকটা হুট করে লোপেতিগেকে নিয়োগ দিয়ে বসে রিয়াল বোর্ড। ক্লাব পর্যায়ে লোপেতিগে আহামরি কোনো রেকর্ডও নেই। নতুন শুরুর প্রথম সিদ্ধান্তটিই তাই হয়ে যায় প্রশ্নবিদ্ধ।

ব্যবসায়ীক লাভ বিবেচনা; বিদায় রোনালদো 

ত্রিশোর্ধ্ব একজন খেলোয়াড়ের জন্য একশ মিলিওয়নের বেশি অফার যে কোনো অর্থেই লোভনীয়। সুতরাং, এটি সহজেই বলা যায় ব্যবসায়ীক দিক বিবেচনায় লোপেজ এর সিদ্ধান্তটি সঠিক। কিন্তু, এখানে যে প্রশ্নটি আসে, সেটি হলো; ত্রিশোর্ধ্ব একজন খেলোয়াড়ের জন্য যখন কেউ শত মিলিয়ন ব্যয় করতে চায়; তখন তিনি কোন মানের সেটি অনুধাবন করা। যেটিতে ব্যর্থ হয়েছেন লোপেজ। এর দায় বর্তায় লোপেতিগের ওপরও। তিনি লোপেজকে সঠিক পরামর্শটি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। একই সাথে, এমন একজন খেলোয়াড়ের জায়গা কে নেবে সে বিষয়েও বেশ উদাসীন ছিল বোর্ড। ফল হাতেনাতেই আসছে।

ভুল ট্রান্সফার পলিসি 

রোনালদোর বিদায়ের পর তার শূণ্যতা পূরণের নূন্যতম প্রচেষ্টাও দেখা যায়নি। রিয়ালের যে মূল সমস্যা, একজন পিওর নাম্বার নাইন এবং সিবি; সেদিকেও লোপেতিগে ছিলেন উদাসীন। তিনি বরং, কিনে আনলেন কোর্তোয়াকে। আর রিয়ালের সাত নাম্বার জার্সিটি যার হাতে তুলে দিলেন তিনি আদৌও এর যোগ্য কি না প্রশ্ন আছে সেটি নিয়েও। পেপের বিদায়ের পর ভারান তার জায়গা পূরণের দায়ভার নিলেও কখনোই তেমন আস্থার নাম হতে পারেননি। কালকের ম্যাচেও তার পারফর্ম্যান্সই ডুবিয়েছে রিয়ালকে। বহুদিন ধরেই স্পষ্ট এ সমস্যা সমাধানেও লোপেতিগে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

জিদানকে অনুসরণ 

ট্রান্সফার পলিসিতে জিদানকে অনুসরণ ছিল সবচেয়ে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। জিদান মূল দলের দায়িত্ব নেয়ার আগে কার্লোর সহকারি হিসাবে কাজ করেছেন। যার ফলে দলটির সব খেলোয়াড়ই তার চেনা ছিল। লোপেতিগের এ সুবিধাটা ছিল না। স্পেন জাতীয় এবং বয়স ভিত্তিক দলের কিছু খেলোয়াড় বাদে মূল দলের কারো সাথেই তার সে অর্থে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল না। সুতরাং, তার উচিত ছিল জিদানকে অনুসরনের বদলে যাদের সাথে তিনি কাজ করেছেন এবং যাদের তিনি খুব ভালো করে চিনেন তাদের কাউকে দলে টানা। যেটি করে চেলসিতে সারি এবং সিটিতে গার্দিওলা বেশ সফল হয়েছেন।

পজিশনাল ফুটবলে নিজেরাই বোকা বনা 

রিয়াল কখনোই পায়ে বল রেখে পাসের পসরা সাজিয়ে আক্রমণে যাবার মতন দল না। রিয়ালের সহজাত ধরণটাই হচ্ছে দ্রুতগতিতে পাল্টা আক্রমণ করে প্রতিপক্ষকে কাঁপিয়ে দেয়া। লোপেতিগে সেখানে রিয়ালকে খেলাচ্ছেন পাসিং ফুটবল। যার সাথে দলের কেউই অভ্যস্ত নয়। যার ফলে ম্যাচ শেষে পজিশন প্রতিপক্ষের চেয়ে ঢের বেশি থাকলেও ফলাফল পক্ষে আসছে না।

অতিমাত্রায় বেল নির্ভরতা এবং ভোতা আক্রমণভাগ

রোনালদোর বিদায়ের পর রিয়াল যখন কাউকেই দলে টানেনি তখনই বোঝা যাচ্ছিল রিয়াল আক্রমণ সাজাতে চাচ্ছে বেলকে সামনে রেখে। এখানে যেটি বিবেচনায় আনা হয় নি, সেটি হচ্ছে বেল ইনজুরি প্রবণ একজন খেলোয়াড়। তিনি ইনজুরিতে পড়লে দলকে টানবে কে? রোনালদোর জায়গায় যাকে খেলানো হচ্ছে সে অ্যাসেন্সিও হাবে ভাবে বড় তারকা হলেও এখনো সে অর্থে পরিপক্ব নন। আর দীর্ঘদিন ফলস নাইন হিসাবে খেলার ফলে বেনজেমার ফিনিশিংয়ে সে ধার নেই। এ বিষয়গুলো নিয়ে লোপেতিগে ভেবেছেন বলে মনে হয় না। পিওর নাই হিসাবে মারিয়ানোর চেয়ে অনেক ভালো অপশন ছিল যারা রিয়ালে আসতে আগ্রহী। আর অ্যাসেন্সিও যে রোনালদোর বিকল্প হতে পারে না সেটি তো সাদা চোখেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

ভুল পরিকল্পনায়ই নির্ভরতা 

খেলোয়াড় অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজাতেও ব্যর্থ লোপেতিগে। জিদান যেমন এক ক্যাসেমিরোকে দিয়েই বাজিমাত করেছিলেন তেমন কিছুই করতে পারছেন না লোপেতিগে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছিলো ইস্কো অথবা সাবেওস হতে পারে তার ট্রাম্প কার্ড। কিন্তু, তিনি নিজেই যেন এ পরিকল্পনায় আস্থা রাখতে পারছেন না। স্পেনে লোপেতিগের অধিনে বেশ আলো ছড়িয়েছিলেন সাউল। সেক্ষেত্রে সাউলকে দলে টেনে তাকে সামনে রেখে মধ্যমাঠ সাজানোটা লোপেতিগের জন্য ইতিবাচক হলেও হতে পারত। তার বদলে তিনি ক্রুস এবং মদ্রিচেই আস্থা রাখলেও তার ধরণের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারায় দু’জনই অনেকটাই নিষ্প্রভ হয়ে বসে রয়েছেন।

দুর্বল বেঞ্চ 

মূল একাদশ তো বটেই বেঞ্চের শক্তি বাড়ানোর কোনো উদ্যোগও দেখা যায়নি। মূল একাদশের কেউ কোনো কারণে ছিটকে গেলেই প্রভাব পড়ছে দলে।

ভুল যে শুধু লোপেতিগে বা পেরেজের তেমন না, ভুলটা সব জায়গায়ই হচ্ছে। বোর্ডের যেমন তড়িঘড়ি করে লোপেতিগেকে নিয়োগ দেয়াটা ছিল ভুল, তেমনি লোপেতিগের ভুল পরিকল্পনাও রিয়ালকে নিয়ে যাচ্ছে আরো খারাপের দিকে। এখন, ক্লাসিকো পর্যন্ত তাকে কর্তারা সুযোগ দিবেন নাকি তার আগেই বিদায় ঘটবে সেটি সময়ই বলে দেবে। তবে, জিদানের ঔজ্জ্বল্য ছাড়ানো রিয়াল যে দিনকে দিন ধুসর হচ্ছে তা চোখ বুজেই বলে দেয়া যায়। আর সেটি যদি লোপেতিগের ওপরই আস্থা রেখে করতে চায় রিয়াল, সে ক্ষেত্রে লোপেতিগের উচিত পুরো পরিকল্পনা ঢেলে সাঁজানো এবং জানুয়ারিতেই দুর্বলতাগুলো ঢাকার জন্য প্রয়োজনীয় খেলোয়াড় টানা।