বারুদ-পোষা আঙুল

বারুদ-পোষা আঙুল

মুনিরা অপেক্ষা করে দরজা বন্ধ হওয়ার। তারপর তার সেই পুরনো ফোঁস- ‘একটা নতুন মোবাইল কিনতে পারো না? ছিচকে চোরও এই ফোন মাগনা দিলে নেবে না।’ ব্যাকস্পেস, সবুজ বাটন গেছে সেই কবেই। দেখে আর বোঝার জো নেই। অন্ধ যেমন আন্দাজ আর অভিজ্ঞতার উপরই জীবন গড়িয়ে দেয়, এজাজুলও তেমনি ফোনের কাজ সারে। সাতটা অক্ষর ছুটে গেছে আঙুলের চাপে। যে আঙুলের চাপে বাসর রাতে ভেঙেছিল মুনিরার সোনার আংটি। ভোররাতে গোলাপ-জারবেরা- গ্লাডিওলাস তোলপাড় করে আংটি খুঁজতে হয়েছিল এজাজুলকে। বৌভাতের রাতে গেল কানের ঝুমকো। এখনো বরকে যাচ্ছেতাই রকম কাছে পেতে ইচ্ছে করলে মুনিরা একটা দৃশ্য উলোটপালট করে- গুড়িয়ে যাচ্ছে কাঁচের চুড়ি। ‘মিস করছি’ দিনগুলোতে মুনিরা দু’হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি পড়ে, তড়পায়। এর বেশি গভীরে মুনিরা যেতে পারে না। অথবা এভাবেই তার গভীর থেকে গভীরতর হওয়া।

অথচ বৃহস্পতিবার এলেই কেমন ফিকে হয়ে আসে আবেগ। ট্রেনে চাপা পড়ার মতো। মাঝের না পাওয়াগুলো একটা শূন্যতা, রুক্ষতা রেখে যায়। তাই বৃহস্পতি এলে ভালো ফোন না থাকাটা হয়ে দাঁড়ায় এজাজুলের একটা অযোগ্যতা, ব্যর্থতা। ব্যর্থতা হয়ে দাঁড়ায় বউকে এখনও আলাদা বাসায় তুলতে না পারাটা। যে হাত কিংবা আঙুলের ভাবনায় রোমান্সে তড়পায় মুনিরা আর সব রাত, সেগুলোই তখন চিলের বর্বর থাবা। আর এজাজুলের ডান হাতের শখ করে বড়ো রাখা ছোট আঙুলের নখটা অসহ্য আদিখ্যেতা।

এক রাতে এজাজুল ঘুমিয়ে গেলে কেটেও দেয় আদুরে পোষা নখ। বেদম মন খারাপ হয় এজাজুলের তবু উটের কুঁজের মতো জমে উঠা দাম্পত্যের অভিমানকে হাতের স্পর্শ দিয়েই ফিকে করতে চায়। অবশ্য কোন ছুটিতে স্পর্শ ছাড়াও আরও কিছু থাকে। এই যেমন প্রত্যেক মাসে ওদের বিয়ের তারিখ উপলক্ষ্যে হয়তো একটা আয়না, একটা খোঁপার কাঁটা, বেলী ফুলের মালা, এক জোড়া শাঁখা, ঢাকাই শাড়ি, আঠারোটা সিঙারা কিংবা একটা গোলাপি ব্র্যাসিয়ার। জানে বৌ প্রথমে ফোঁস করবে- কী বাজে পছন্দ! কী সস্তা! আর একটু দামি কিছু হয়ে গেলে- ‘পয়সা কামড়ায় তোমারে?’ অথচ এজাজুলের না থাকার দিনে এগুলো আঁকড়েই থাকবে।

প্রায়ই মুনিরা ভাবে এই আঁকড়ে থাকাটা টের পেয়েই বুঝি এতটা নির্বিকার এজাজুল! ভাঙাচোরা ফোন দিয়ে দিব্যি চালিয়ে নিচ্ছে দিন। অফিসে যাওয়া কিংবা ফেরার পথে ছবিও তুলে বউয়ের জন্য- রাস্তার পাশে ফুটে থাকা ঝিঙে ফুল, একটা ফুলে আবার মাছি বসা, হাতির ঝিলের রাধাচূড়ার গাছ, সাদা ভাতের উপর ঝোল মাখানো ফোটকা কৈ, অফিসের পেছনের বাঁশের সাঁকো কিংবা সিগারেটের প্যাক আর কোকের জঞ্জালে ফুটে থাকা গোলাপি শাপলা। কোনদিন ভ্রু কুচকায় বৌ, কোনদিন ফেইসবুকে শেয়ার করে। তিন কুড়ি লাইকস পেলে আপ্লুত হয়ে ভাবে মানুষটার বুঝি বড়ো কিছু হওয়ার কথা ছিল।

হয়তো এজাজুলের কালো চামড়া আর ঐ নির্বিকার হয়ে থাকার মধ্যে কোন ফারাক নেই। ম্যানেজার তোহরা বেগম বেলা এগারোটায় সব্জি-মুরগি কিনে এনে আয়াকে কাটাকাটির কাজে বসিয়ে দিয়ে এজাজুলকে যখন ডাকে হম্ভিতম্ভি করার জন্য, ল্যাবটেকনিশিয়ান শেখর প্রায়ই বলে- ‘বলিহারি আপনের সহ্যশক্তি এজাজুল ভাই। যেই আচরণ করে, মনে হয় আমরা ঐ মহিলার কেনা চাকর। কাজ জানে না, গলাবাজি করে পজিশন ঠিক রাখে। ঘেন্না ধরে গেছে। এই যে টিকে আছি আপনাকে দেখেই।’ অথচ অতীত জানে কখন ফুরিয়ে যায় মানুষ। বড়ো পানি ভালোবাসতো এজাজুল। সেই ষোল মাস বয়স থেকেই। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতো বালতির পানিতে শরীর ডুবিয়ে। বালতির পানিতে জীবন ছোট হয়ে গেলে জেনেছিল- সাঁতার, ফুফুবাড়ির এক বিকেলের ধলেশ্বরী। ধলেশ্বরীতে তখন সেই উত্তাল স্রোত। দিশেহারা এজাজুল বারবার তীরে ফেরার চেষ্টা করছে, দম ফুরিয়ে আসছে, অসার হয়ে যাচ্ছে শরীর। ভেবেছিল এই বুঝি শেষ। হঠাৎ করুণার মতো ধলেশ্বরী ছেড়ে দেয় তাকে। সেদিন থেকে এজাজুল শিখে গেছে ঝুঁঝে থাকা।

একদিন অবশ্য ক্ষেপে যায় নির্বিকার এজাজুল। সকাল থেকেই মুখোমুখি হওয়া কথাগুলো গতানুগতিক বলে এড়াতে পারে না। ‘দুটো তিনটে টিউশনিতেও এর থেকে বেশি বেতন বাপ.. বউ পালারই মুরোদ নাই আবার বাবু, পুরুষ নাকি তুমি, তোমাদের ক্লিনিকে না ভ্যাসেকটমি করালে তিন হাজার টাকা দেয়, করায় নাও, কিছু টাকা জুটবে… ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রায় ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস… এজাজুল এক্ষণ হেড অফিসে চলে যাও… বুঝলেন এজাজুল ভাই ফিনান্সের কিচ্ছুটি শেখাবে না অথচ ভুল করলে ঠিকই লাগাবে, তুরুপের তাস নিজের কাছে রাখবে এই আর কি, চেয়ারে বসে কত গুণে জানেন পয়তাল্লিশ হাজার আর সমস্ত করে আমি হেড অফিসের এডমিন পাই সাড়ে নয় হাজার।’

ঠিক কোন কথা বা ঘটনায় বারুদ ছিল কে জানে!  ঘুরেফিরে একটা অভিমানই তোলপাড় করে- না পাওয়াগুলো শুধুই কি তোমাদের? তারপর সব কেমন এলেবেলে। কোথায় ওর এক পয়সা ঘুষ না নেয়ার, এক টাকা এদিক-ওদিক না করার বিরল অহংকার! এখনও বউকে লজ্জায় বলতে পারেনি কতো বেতন পায়। এই দুর্মূল্যের শহরে মোটামুটি মানের বাসা ভাড়া করার সার্মথ্যও তার নেই। ওর বাড়ির লোকেরাও বলে- ছেলে তো ধরতে গেলে বেকার। মুনিরার সাথে এই বিয়ে হওয়ারই কি কথা ছিল? বিয়ে করবে না, ছোট ভাইরা আগে বিয়ে করবে এইতো ঠিক ছিল। অথচ মুনিরার আব্বার এত ভালো লেগে গেল শান্ত সৌম্য এজাজুলকে- ও ছেলে খাঁটি সোনা। এজাজুলের অবশ্য নিজেকে নিয়ে অমন ভাবনার বিলাসিতা হয় না। খাঁটি হওয়ারও দাম দিতে হয়। যে যত খাঁটি, তাকে ঠিক ততটাই পুড়তে হয়। বরং মুনিরার এইসব অযাচিত কষ্টের জন্য নিজেকেই অপরাধী মনে হয়। মেয়েটার কতো কিছু পাওয়ার ছিল জীবনে। শুধুমাত্র ওকে বিয়ে করেছে বলেই বড়ো অবেলায় শুকিয়ে যাবে বউটার জীবন।

বারুদ জমা দিনে এজাজুলের কেবল ঘুরেফিরে পেট্রোল বোমার আগুন ধরে যাওয়া বাসের জানালায় একটা ডান হাত মনে পড়ে। কাঁচ ভেঙে বেরুনোর কী বিমর্ষ ব্যর্থ চেষ্টা! উহ, একটা ঢেউয়ের মতো হাতটাকে খেয়ে নিলো আগুন। যেন সেই উত্তাল ধলেশ্বরী। পুড়ে যাওয়া ইকবালই তো একদিন বলেছিল- মরে যাওয়া নদী পরের জন্মে আগুন হয়রে এজাজুল। এজাজুল বুঝি সেই আগুনে ঝলসে যাওয়া, গলে যাওয়া বাঁকা হাত যার কিছুই আর করার নেই, করার থাকে না।

আচমকা খসে যাওয়া বারুদের মতো এজাজুলের আঙুল দুম করে ঠেলে ফেলে টেবিলের উপর পড়ে থাকা সাতটা পেটফোলা ফাইল। সব সয়ে যাওয়াকে কাঁপিয়ে দিয়ে তেড়ে উঠে এক রোখ- যাহ শালা, করলাম না তোদের এই বালের চাকরি!  ঠিক তখনই পকেটে কেঁপে কেঁপে ওঠে ফোন। ওপাশে ধলেশ্বরীর পাড়, কেউ থাকে বলার অপেক্ষায়- এজাজুল ছুটি নিয়া চলে এস। সাথে কিন্তু মিষ্টান্ন। ভীষণ সুখবর আছে…