ঢাকা থেকে দিল্লির দূরত্ব ১৭৫০ কিলোমিটারের বেশি। বাসে, ট্রেনে ঢাকা থেক দিল্লি পৌছাতে যেখানে দুই দিনের কাছাকাছি সময় লেগে যায় সেখানে আকাশ পথে দিল্লীর দূরত্ব মাত্র ২ ঘন্টার পথ। ফলে ভূখন্ড দিয়ে দিল্লি ঢাকা থেকে যতটা না দূরে আকাশ পথে অনেক কাছে। তাই বহুকাল ধরে প্রচলিত “দিল্লি অনেক দূর” বহুকাল আগেই সেই পার্থক্য ঘুছে গিয়েছে। উন্নত আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে শুধু দিল্লি কেন সারা পৃথিবীটাই এখন মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে। দেশ বিদেশের সকল তথ্য পেতে মানুষকে এখন আর আগের মত দিনের পর দিন বসে থাকতে হয় না।
আসল কথায় আসি। নতুন দিল্লি হল প্রজাতান্ত্রিক ভারতের রাজধানী ও ভারত সরকারের প্রশাসনিক, আইন ও বিচারবিভাগীয় কেন্দ্র। এটি কেজিরওয়ালের দিল্লি সরকারেরও কেন্দ্র। নতুন দিল্লি মহানগরীয় অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত এবং এটি দিল্লি জাতীয় রাজধানী অঞ্চলের ১১টি জেলার মধ্যে অন্যতম জেলা। ইতিহাস থেকে জানা যায় ১৯১১ সালে দিল্লি দরবারে ভারত-সম্রাট পঞ্চম জর্জ নতুন দিল্লি শহরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। ব্রিটিশ স্থপতি স্যার এডউইন লুটিয়েনস ও স্যার হারবার্ট বেকার এই শহরের নকশা প্রস্তুত করেছিলেন। ১৯৩১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নতুন রাজধানী উদ্বোধন করেন তদনীন্তন ভাইসরয় লর্ড আরউইন।
নতুন দিল্লিতে জনসংখ্যার পরিমাণ ২৯৪,৯৯৮ জন। এই জেলার জনঘনত্ব ৫,৮৫৪.৭ জন প্রতি বর্গকিলোমিটারে। ফলে মোটা দাগে নতুন দিল্লীকে ৪২.৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের মধ্যে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে জায়গা দিতে হয়েছে। এবং বিভিন্ন রাজ্য থেকে দিল্লীগামী মানুষের আগ্রহও সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দিল্লীতে যানবাহন হিসেবে সবচে বেশি ব্যবহৃত হয় ব্যক্তিগত গাড়ী। আর মেট্রোরেলের উপর নির্ভর করে চলতে হয় লাখ যাত্রীকে। সরকারিভাবে বড় আকৃতির বাসের সংখ্যা পৃথিবীর অন্য অনেক বড় শহর থেকে কম। এমন অবস্থা বিদ্যমান সত্ত্বেও দিল্লীতে বায়ুদূষণের পরিমাণ অত্যধিক এবং বায়ুদূষণের কারণ প্রধানত যানবাহনের কাল ধোঁয়া। এর সাথে এখন যুক্ত হয়েছে একটি বড় ধর্মীয় উৎসবের নাম। যদিও উৎসবটি দুই তিন দিন সময় ধরে থাকে তারপরেও পরিবেশবিদেরা আঙুল তুলছেন এর দিকেই সবচে বেশি।
নয়া দিল্লীর সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রীলঙ্কান অধ্যাপক শশাঙ্ক পেরেরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন যে “দিল্লি একটি আত্নঘাতী পরিবেশ দূষণকে উসকে দিচ্ছে যার দায়ভার বহন করতে হবে সাধারণ জনগণকেই”। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক রেডিও ভাষণে দীপাবলির ঐতিহ্য তুলে ধরে বক্তব্য দিয়েছেন, পরিবেশ দূষণ বিশেষ করে বায়ু দূষণ নিয়ে কোন কথা বলেননি। এটা থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠানের মূল্য জনস্বাস্থের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ
বিবিসি বাংলা তাদের ৩১ অক্টোবরের খবর দিল্লীর আকাশ সম্পর্কে লিখেছে “ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ‘দিওয়ালি’ বা ‘দীপাবলী’ উৎসবের একদিন পর সেখানকার ধোয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশের ছবি স্থানীয় বাসিন্দারা শেয়ার করছে এবং সাথে সাথে নিজেদের ক্ষোভও প্রকাশ করছে”। তার প্রধান কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন যে দিওয়ালি উৎসবের অন্যতম অংশ হলো বাসাবাড়িতে আলো প্রজ্বলন ও আতশবাজি পোড়ানো। কিন্তু এই আতবাজি পোড়ানোর জন্য বাতাস অনেক বেশি দূষিত হয়ে যায়।
শুধু বিবিসি নয়, নয়া দিল্লি কেন্দ্রিক অনেক বড় খবরের কাগজেও দীপাবলি উৎসবকে কেন্দ্র করে বায়ু দূষণের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দি হিন্দুস্থান টাইম তাদের খবরে লিখেছে যে দিল্লীর বায়ু সহন মাত্রার চেয়ে ৪২ গুণ বেশি দূষিত হয়ে পড়েছে। যা পরিণত হয়েছে রীতিমত একটি গ্যাস চেম্বারে। এই দূষণের ফলে জনস্বাস্থ্য মারাত্নক হুমকির মুখে পড়েছে। বাতাসে ধুলিকণার মাত্রার নিরাপদ সীমা ধরা হয় প্রতি কিউবেক মিটারে ১০০ মাইক্রোগ্রাম, কিন্তু এবার দিল্লিতে ধুলিকণার মাত্রা প্রতি কিউবেক মিটারে ৯৯৯ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছেছে যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর- জানিয়েছে বিবিসি।
গতকাল নয়া দিল্লীর সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রীলঙ্কান অধ্যাপক শশাঙ্ক পেরেরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন যে “দিল্লি একটি আত্নঘাতী পরিবেশ দূষণকে উসকে দিচ্ছে যার দায়ভার বহন করতে হবে সাধারণ জনগণকেই”। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর দেয়া রেডিও ভাষণে দীপাবলির ঐতিহ্য তুলে ধরে বক্তব্য দিয়েছেন, পরিবেশ দূষণ বিশেষ করে বায়ু দূষণ নিয়ে কোন কথা বলেননি। এটা থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মূল্য জনস্বাস্থের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং এর সাথে ভোটের রাজনীতি অনেকটাই জড়িত।
অন্যদিকে নানা স্থান থেকে পরিবেশ দূষণের বিপক্ষে ক্ষোপ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। বিবিসি শেখ হারুন নামে একজনের পোস্ট দেখে উল্লেখ করেছে যে “সম্ভবত আমরা ভারতীয়রাই একমাত্র জাতি যারা এরকম পরিবেশ তৈরির জন্য টাকা দেই আর প্রার্থনা করি। ছবি দেখে মনে হচ্ছে রাত, অথচ এখন দিনের উজ্জ্বল আলো থাকার কথা”।
এখন আরকেটু বাস্তববতায় ফিরে আসি। এই বছর দীপাবলির উৎসব শুরু হয়েছে ২৮ অক্টোবর থেকে। সেই দিন সন্ধ্যা রাত থেকেই আতশবাজি পোড়ানো শুরু হয়েছে। আমরা যে এলাকায় থাকি সেই চাণক্যপুরিতে যেখানে সাধারণ মানুষের জন্য আবাসিক ভবনের সংখ্যা খুবই কম, সেখানেই ২৯ আর ৩০ অক্টোবর রাতে যে পরিমাণ আতশবাজি পোড়ানো হয়েছে তাতে ৩১ তারিখ সকালে দিল্লির আকাশ পুরোপুরি ঢাকা ছিল। লেখার সাথে যুক্ত সকাল ৯ টা ৪৫ মিনিটে ছবি উঠানো দুটি তার বড় প্রমাণ।
তার আগের রাতে আতশবাজির বিকট শব্দে পুরো এলাকা থেকে থেকে প্রকম্পিত হয়েছে। শুধু মানুষ নয়, প্রচণ্ড শব্দে দিল্লির হাজার হাজার পাখিরা ছিল সব চেয়ে বেশি আতঙ্কিত। প্রতিটি শক্তিশালী আতশবাজির মুহুর্মুহু শব্দে পক্ষিকূলকে বার বার আকাশে উড়ে যেতে দেখা গেছে। মনে হয়েছে যেন দিল্লিতে যুদ্ধের পরিবেশ বিরাজ করছে।
একটি অভিজ্ঞতার কথা বলে দিল্লির বায়ু দূষণ সম্পর্কে বয়ান শেষ করছি। গত বছর ডিসেম্বর মাসে হিমাচল প্রদেশে গিয়েছিলাম একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশগ্রহণ করতে। সেখানে আমাদের ১২ দিন থাকতে হয়েছে। সেখানের পালামপুর, ধর্মশালা, ম্যাকলর্ডগঞ্জ ঘুরে প্রচণ্ড শীতের এলাকা হিমাচল থেকে ফিরে এসেছিলাম ২ জানুয়ারিতে। দিল্লি ফিরে আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে চার পাঁচ দিন লেগে গেল। হিমাচলের বিশুদ্ধ বায়ুর সাথে দিল্লির দূষিত বায়ুর আকাশ পাতাল প্রভেদ। রাস্তা দিয়ে চলাচলের সময় আমার মত অনেকেরই মনে হয় নাক-মুখ দিয়ে বাতাসের সাথে আবর্জনা দেহে প্রবেশ করছে। আর দীপাবলি উত্তসবের এই সময়ে দিল্লির অবস্থা আরো খারাপ।
লেখা শুরু করেছিলাম ঢাকা থেকে দিল্লি অনেক দূর শিরোনাম দিয়ে। মূল কারণ ছিল ঢাকার সাথে দিল্লীর পরিবেশ দূষণ নিয়ে ঢাকাবাসীকে তাদের অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া। ভৌগলিক ভাবে দিল্লি ঢাকা থেকে অনেক দূরে হলেও আকাশ পথে অনেক কাছে। ঢাকার আকাশ দিয়ে দিল্লি আর দিল্লির আকাশ দিয়ে ঢাকা একই সূত্রে গাঁথা। ঢাকার বাতাসে শুনেছি মিথেন গ্যাসের পরিমাণ অনেক বেশি। অন্যদিকে ঢাকা পৃবিথীর অন্যতম বসবাসের অযোগ্য শহর। ফলে পরিবেশগত কারণেও দিল্লি আর ঢাকার মধ্যে মিল রয়েছে। দুই মহানগরের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে এখনই বসবাস উপযোগী নগর নীতিমালা বাস্তাবয়ন জরুরি।