বহুদিন ধরে চীনের ‘উইঘুর’ মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর কমিউনিস্ট চীনা সরকার নিপীড়ন করে আসছে। জিনজিয়ান প্রদেশে নানা নীতি প্রণয়ন করে উইঘুরদের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। সেই নিপীড়নের বিরুদ্ধে উইঘুর সমাজকর্মী এবং আইনজীবী রোকেয়া তুরদুশ কলম ধরেছেন। লেখাটি গত ১৩ অক্টোবর সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা’র মতামত পাতায় প্রকাশিত হয়। এখানে জবানের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করা হয়েছে।
ভাবুন, যদি সশস্ত্র বাহিনী আপনার বাড়ি তছনছ করে ফেলে, আপনার প্রিয়জনদের গ্রেফতার করে, তাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং বাচ্চাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে; তবে কেমন লাগবে। এরকম ঘটনাই ঘটেছে ৪৪ বছর বয়সী তুরঘুনজনের সাথে, যার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল তুরস্কে, যখন উইঘুর শরণার্থীদের সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য আমি ওখানে ছিলাম।
তুরঘুনজনের অলংকারের ব্যাবসা আছে, এবং বিগত চার বছর ধরে তিনি নিয়মিত তুর্কি এবং চীন যাতায়াত করছেন। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি এর রকম এক সফরের সময় তার পরিবারের সদস্যদের কোন কারণ দর্শানো ছাড়াই গ্রেফতার করা হয় এবং তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়।
তিনি বলেন, “আমার কিছুই হারানোর নেই, যেখানে তারা আমার স্ত্রীকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং আমি জানিনা আমার জমজ দু’টি বাচ্চা এবং তরুণ ছেলেটা কোথায় কিভাবে আছে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা শুধু চাই শান্তি, নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা। আমার মতো মানুষেরা— যারা চীনের বাইরে বাস করে এবং যারা এই মুহূর্তে তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে, তারা শান্তির জন্য বিস্ময়কর ত্যাগ স্বীকার করেছে।”
তার গল্প বলার সময় তিনি ভেঙে পড়েন এবং ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। এটা উইঘুরের অসংখ্য পরিবারের পরিণতির একটি, যারা প্রতিনিয়ত জিনজিয়ানের উপর বেইজিংয়ের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।
এ বছরের আগস্ট মাসে, জাতিগত বৈষম্য নির্মূল বিষয়ে কাজ করা জাতিসংঘের কমিটি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে বলা হয়, এক মিলিয়নের মতো উইঘুর চীনের ‘সন্ত্রাস মোকাবেলা’ কেন্দ্রে আটক রয়েছে। এবং দুই মিলিয়নের মতো উইঘুরকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মতদীক্ষা দানের উদ্দেশ্যে জোরপূর্বক ‘রি এডুকেশন’ ক্যাম্পএ পাঠানো হয়েছে।
চীনা সরকার স্পষ্টভাবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং একই সময়ে ওই কমিটিও প্রত্যাখান করে। কিন্তু মাত্র দুই মাস পরে, এই ‘রি এডুকেশন’ বা অন্তরায়ণ ক্যাম্পগুলো বৈধরূপে আবির্ভূত হয়।
তারা জিনজিয়ানের স্থানীয় আইন পরিবর্তন ক’রে রি এডুকেশন ক্যাম্পে ‘চরমপন্থা বিরোধী মতাদর্শিক শিক্ষা’ বাস্তবায়ণের অনুমতি দেয়।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এই ক্যাম্পগুলোতে চাইনিজ মান্দারিন ভাষা শিখতে বাধ্য করা করা হয়, চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির প্রশংসা এবং তার নিয়মানুসারে চলার কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়। এই সময় তারা শারীরিক এবং মানসিক নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যাওয়া একটি রূঢ় পরিস্থিতির শিকার হয়।
এটা চীনা সরকার কর্তৃক গৃহীত অ্যাসাইমিলেশোনিস্ট পদক্ষেপগুলোর সর্বশেষ পুনরাবৃত্তি যা চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির এথোনসেন্ট্রিক মতাদর্শ দ্বারা অনুপ্রানিত। এথোনসেন্ট্রিক হলো নিজেদের সংস্কৃতির মানদণ্ড দ্বারা অন্য সংস্কৃতির মূল্যায়ণ। অবশ্যই অবমূল্যায়ণ। এই মতাদর্শে চীনের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী ‘হান’ সম্প্রদায়ের প্রাধান্য রয়েছে, যা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের জাতির পিতা মাও জেডং’র লেখাগুলোতে বিধৃত হয়েছে এবং বিগত সাত দশক ধরে বিভিন্ন কাঠামোতে তার চর্চা হয়ে আসছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে তারা ইসলামকে ‘আদর্শগতভাবে দূর্বল’ ঘোষণা করেছে। তারা বহু মসজিদ ধ্বংস করেছে, ধর্মীয় পোশাক নিষিদ্ধ করেছে, এমনকি পবিত্র গ্রন্থ কোরআন শরীফও নিষিদ্ধ করেছে। তারা মুসলমানদের কবর দেয়ার রীতিকে ত্যাগ করে চীনের ঐতিহ্যানুসারে শবদাহের জন্য বল প্রয়োগ করছে। এই সকল ঘটনা দ্রুত জিনজিয়ান জুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে।
এই চর্চার অংশ হিসেবে, চীনা সরকার পর্যায়ক্রমে জিনজিয়ানের উইঘুর সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি এবং জাতিসত্ত্বা মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। প্রাপ্ত বয়স্কদের ‘রি এডুকেশন’ ক্যাম্প ছাড়াও সেখানে বাচ্চাদের স্কুল রয়েছে। এই স্কুলগুলোতে উইঘুর শিশু-কিশোরদের তাদের পরিবার, ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো নিয়মিত এই সম্বন্ধীয় ছবি এবং সংবাদ প্রচার করে যেখানে উইঘুরের বাচ্চারা হান’দের মতো পোষাক পরিধান করে আছে, মান্দারিন ভাষা এবং হানদের সংস্কৃতি আয়ত্ত করছে।
চীনা সরকার তাদের এই অ্যাসাইলেশোনিস্ট নীতির বদৌলতে উইঘুরের বাড়িগুলোর গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছে। ২০১৬ সালে, তারা ‘বিকামিং ফ্যামিলি’ প্রকল্প প্রবর্তন করে, যেখানে সিসিপি’র একজন পদধারীকে বা কর্মীকে প্রতি দুই মাস অন্তর ৫ দিন করে নিজ বাড়িতে আতিথেয়তা দেয়ার জন্য উইঘুরদের বাধ্য করা হয়।
চীনা সরকার সক্রিয়ভাবে উইঘুরদের ধর্মীয় পরিচয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আনুষ্ঠানিকভাবে তারা ইসলামকে ‘আদর্শগতভাবে দূর্বল’ ঘোষণা করেছে। তারা বহু মসজিদ ধ্বংস করেছে, ধর্মীয় পোশাক নিষিদ্ধ করেছে, এমনকি পবিত্র গ্রন্থ কোরআন শরীফও নিষিদ্ধ করেছে। তারা মুসলমানদের কবর দেয়ার রীতিকে ত্যাগ করে চীনের ঐতিহ্যানুসারে শবদাহের জন্য বল প্রয়োগ করছে। এই সকল ঘটনা দ্রুত জিনজিয়ান জুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে।
চীনা সরকার ধর্মীয় আচরণকে কেন্দ্র করে আইনি নির্দেশিকাও জারি করেছে। তারা জিনজিয়ানের উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে নিয়ন্ত্রণের অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে। এবং ‘কম্প্রেহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অব সোশ্যাল অর্ডার’ নীতির আওতায় স্থানীয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের অধিনে নিয়ে নিয়েছে, যার মধ্যে ‘ধর্মীয় বিষয়গুলোর ব্যবস্থাপনা’ ও ‘ধর্ম-বিরোধী শিক্ষা পরিচালনা’ও অন্তর্ভূক্ত।
এই নীতিমালা বাস্তবায়ণের ফলে মুসলমানদের দৈনন্দিন কার্যক্রমকে উগ্রপন্থা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন, হালাল খাওয়া, ‘হান’ চীনাদের বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানানো এবং ইসলামিক অভিবাদন রীতি ব্যবহার করা।
চীন সরকার তাদের এই দমন-পীড়নকে বৈধতা দিতে উইঘুরদের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ ব্যবহার করছে: চরমপন্থা, সন্ত্রাসবাদ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ।
প্রথম অভিযোগ, চরমপন্থা; যারাই গর্বের সাথে তাদের উইঘুর পরিচয় ব্যবহার করেছে তাদের গায়ে লেগেছে এই চরমপন্থার অভিযোগ । লাখ লাখ মানুষকে ‘রি এডুকেশন’ ক্যাম্পে পাঠানো ছাড়াও গত কয়েক বছর ধরে, বেশ কিছু বিশিষ্ট উইঘুর ব্যক্তিত্ব আটক ও নিখোঁজ হয়েছে। যার মধ্যে ইসলামিক স্কলার মোহাম্মদ সালিহ হাজিম, অর্থনীতিবিদ ইলহাম তোক্সতি, নৃবিজ্ঞানী রাহিল দাউদ, পপ গায়ক আব্দুরহিম হেয়ত এবং আবলাজান আউত, এবং ফুটবলার ইরফান হেজিম অন্যতম।
উইঘুর হওয়ার মধ্যে বা তার জন্য গর্বিত হওয়ার মধ্যে ‘চরম’ কিছুই নেই। হানদের মতো তাদেরও নিজেদের ঐতিহ্য পালন এবং পরিচয় উদযাপন করা উচিত। সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অধিকার দাবি করা কিছুতেই চরমপন্থা হতে পারে না।
যখন জনগণ নিপীড়িত হয়, মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে, যখন তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চর্চায় বাধা দেয়া হয়, যখন শুধু পরিচয়ের কারণে তাদের পরিবারের সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়; তখন জনরোষ, হতাশা এবং অনাস্থা অনিবার্য হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয়ত, সেখানে ‘সন্ত্রাসবাদ’র অভিযোগ। জিনজিয়ানে প্রকৃতপক্ষে নৃশংস ঘটনা ঘটছে, কিন্তু জনসাধারণের তার প্রতিবাদ করা সন্ত্রাসবাদ নয়। এটা নির্ণয় করা খুব কঠিন না, যখন জনগণ নিপীড়িত হয়, মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে, যখন তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চর্চায় বাধা দেয়া হয়, যখন শুধু পরিচয়ের কারণে তাদের পরিবারের সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়; তখন জনরোষ, হতাশা এবং অনাস্থা অনিবার্য হয়ে ওঠে।
এছাড়াও পুলিশি পাহারা সত্ত্বেও আমাদের মাতৃভূমিতে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সহিংসতা ঘটেছে এবং কিছু উইঘুর বিদেশি জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছে।
কিন্তু এটাও অনিবার্য সত্য যে, ক্রমবর্ধমান সহিংসতার শিকার হওয়া সত্ত্বেও উইঘুর জনগোষ্ঠীর প্রায় সবাই অহিংস পথ বেছে নিয়েছে। এবং যখন প্রাদেশিক নিরাপত্তা যে কোন দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তখন এই অভিযোগ কার সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য এবং হাস্যকর যে, সন্ত্রাসবাদ একটি জাতিসত্ত্বা বা একটি ধর্মের মধ্যে নিহিত।
উইঘুররা ‘বিচ্ছিনতাবাদ’র অভিযোগেও অভিযুক্ত, কিন্তু তাদের মধ্যে চীন থেকে পৃথক হওয়ার কোন চিন্তা নেই। ঐতিহাসিকভাবে তারা চীনের অংশ নয়, তারা তাদের জন্মভূমিকে ঔপনিবেশিক অঞ্চল হিসেবে দেখে। তারা ওই অঞ্চলে শান্তি, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য চীনা উপনিবেশবাদ ও চীনের হান-সম্প্রদায়ের মতাদর্শ উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে।
আমিসহ প্রত্যেক উইঘুরই পশ্চিম তুর্কিস্তানে শান্তি, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র চাই। কিন্তু আমি শঙ্কিত কারণ, চীনা সরকার যতক্ষণ পশ্চিম তুর্কিস্তানে তাদের এই সাংস্কৃতিক গণহত্যা ও দমন নীতির সাথে চলবে ততক্ষণ এসবের কিছুই সম্ভব হবে না।