খাশোগির অন্তর্ধান : কেন তুরস্ক সতর্ক পা ফেলছে?

খাশোগির অন্তর্ধান : কেন তুরস্ক সতর্ক পা ফেলছে?

খাশোগির ঘটনা যারা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন তাদের অনেকের মনে তুরস্কের পলিসি নিয়ে সংশয় কাজ করছে। অনেকের মনে অসংখ্য প্রশ্নও জাগছে। পর্দার আড়ালে কোন কিছু চলছে কি না, তুরস্ক কোন আমেরিকান-সৌদি পরিকল্পনার অংশ হতে যাচ্ছে কি না – এ নিয়েও জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। কিন্তু পুরো বিষয়টার উপর গভীর ভাবে দৃষ্টিপাত করলে বিষয়টা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।

তুরস্ক শুরু থেকেই আনঅফিসিয়ালি দাবি করে আসছে যে, খাশোগিকে ইস্তাম্বুলে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটেই হত্যা করা হয়েছে এবং তুর্কি গোয়েন্দাদের হাতে হত্যাকাণ্ডের অডিও রেকর্ড এবং ছবি আছে। তাহলে তুরস্ক ধীরে চলার নীতি অবলম্বন করেছে কেন? প্রমাণগুলো ফাঁস করে দোষীদেরকে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করছে না কেন? কেনই বা তুরস্ক বিষয়টাকে দীর্ঘ করছে? নিম্মোক্ত বিষয়গুলোর উপর দৃষ্টিপাত করলে তুরস্কের কৌশলটা বুঝতে সহজ হবে।

.

তুরস্ক চাইলেই প্রথম দুই দিনের মধ্যে বিষয়টা ফাঁস করে দিতে পারতো এবং সৌদি আরবেকে অভিযুক্ত করে দেশটির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা নিতে পারতো। সেটা আদর্শিক দৃষ্টিকোন থেকে উচিত হলেও বাস্তবতার নিরিখে অসম্ভব। এর বড় কারণ হচ্ছে, তুরস্ক যে অডিও টেপের কথা বলছে সেটা ইন্টেলিজেন্সের দুনিয়ায় গ্রহণযোগ্য হলেও আইনের সামনে গ্রহণযোগ্য হবে না। সিআইএ-সহ দুনিয়ার বড় বড় ইন্টেলিজেন্সগুলোর হাতে রেকর্ডটি ইতোমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে এবং এই কারণে পশ্চিমা সরকারগুলো খাশোগির পরিণতির ব্যাপারে একরকম নিশ্চিত। কিন্তু এই টেপটির মাধ্যমে সৌদি আরবকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইলে আইন প্রথমেই জিজ্ঞেস করবে – এই রেকর্ডের উৎস কি? কিভাবে এটি ধারণ করা হয়? যেকোনো কূটনৈতিক মিশন ডিপ্লোম্যাটিক ইমিউনিটির সুবিধা পেয়ে থাকে। তাহলে এই কোড ভঙ্গ করে কীভাবে রেকর্ডটি করা হল? আদালতের অনুমতি নিয়েই কি আড়িপাতা হয়? এই প্রশ্নে এসে তুরস্ক আটকে যাবে। কারণ, অনুমতি ব্যাতীত ডিপ্লোম্যাটি জোনে আড়িপাতা এবং সেখানের কোন ধরণের ছবি বা রেকর্ড বের করা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। তখন সাথে সাথে সৌদি আরব প্রশ্ন তুলবে আমাদের কনস্যুলেটে আড়িপাতা হয়েছিল কেন? তখন ব্যাপারটা বড় ধরণের কূটনৈতিক কেলেঙ্কারি হয়ে দাঁড়াবে। এর জের ধরে ঘটনা ভিন্ন দিকেও মোড় নিতে পারে। তাই তুরস্ক চাইলেই এই টেপটা সামনে আনতে পারছে না। বরং তুর্কি কর্তৃপক্ষ এখানে একটি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। সেটা হচ্ছে, তারা অফিসিয়ালি রেকর্ডের কথা স্বীকার না করে মিডিয়ার মাধ্যমে আনঅফিসিয়ালিভাবে বিষয়টা ফাঁস করেছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, ঘটনা স্বীকার করে নেয়ার জন্য সৌদি আরবের উপর চাপ সৃষ্টি করা।

২.

তুরস্ক চাচ্ছে ঘটনার তদন্ত বিশ্বস্তভাবে হোক। এমন পদ্ধতিতে হোক, যাতে পশ্চিমাদের বা সৌদি আরবের মিত্রদের কোন ধরণের প্রশ্ন উত্থাপন করার সুযোগ না থাকে। এজন্য তুর্কি ইন্টেলিজেন্স ঘটনার শুরু থেকেই তদন্তে নিয়োজিত থাকলেও তুর্কি সরকার ঘটনা তদন্তের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব দিয়েছে প্রসিকিউটরের তত্ত্বাবধানে ৪ জন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত কমিটিকে। তারাই ঘটনার আনুষ্ঠানিক তদন্ত করছে। তুর্কি গোয়েন্দারা তাদের সামনে অডিও রেকর্ডটি পেশ করতে পারছে না। অথবা পেশ করলেও সেই টেপের উপর ভিত্তি করে কমিটি হত্যাকাণ্ডের জন্য সুনির্দিষ্ট ভাবে কাউকে অভিযুক্ত করবে না। কারণ সেটা ডকুমেন্ট হিসেবে আদালতে পেশযোগ্য নয়।

৩.

তদন্তের সবচেয়ে দূর্বল দিক হচ্ছে, এখনো পর্যন্ত মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায় নি। আইনের দৃষ্টিতে খাশোগি এখনো নিখোঁজ একজন ব্যাক্তি, যার মৃত্যুর ব্যাপারে কোন গ্রহণযোগ্য প্রমান নেই। হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করতে হলে হয়তো ভিকটিমের মৃতদেহ সংগ্রহ করে সেটার উপর ফরেন্সিক টেস্ট করতে হবে, অথবা সাক্ষীর মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে, অথবা অভিযুক্ত ব্যাক্তির স্বীকারোক্তি লাগবে। কোনটাই এখনো পর্যন্ত হস্তগত করা সম্ভব হয় নি। তদন্ত কাজে সবচেয়ে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কনস্যুলেটের কূটনৈতিক নিরাপত্তার বিষয়টি। কারণ সৌদি আরব তুরস্কের তদন্তকারী দলকে কোনভাবেই কনস্যুলেটে প্রবেশ করার অনুমতি দিচ্ছিল না। দীর্ঘ ১৪ দিন পরে অনুমতি দিলে তুরস্ক এবং সৌদি আরবের যৌথ তদন্তকারী দল সেখানে প্রবেশ করে। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা হচ্ছে, এই লম্বা সময়ের মধ্যে হত্যার প্রমাণ মুছে ফেলা খুবই সম্ভব। তবুও তদন্তকারী দল সেখানে হত্যার পক্ষে মজবুত দলিল পেয়েছে বলে বেসরকারিভাবে সংবাদ পাওয়া গিয়েছে।  কিন্তু এসব দলিল শক্তিশালী তখনই হবে যখন ভিক্টিমের মৃতদেহ পাওয়া যাবে। এই উদ্দেশ্যে তুর্কি কর্তৃপক্ষ কাউন্সিলরের বাসভবন সার্চ করার অনুমতি তলব করে। অনেক গড়িমসি করার পরে শেষ পর্যন্ত অনুমতি দিলেও তদন্তের মাঝখানে সৌদি কর্তৃপক্ষ হঠাৎ বেঁকে বসে। পরে অনেক প্রচেষ্টার পরে আবারও তদন্তকারী দল প্রবেশ করতে পেরেছে। মৃতদেহের কোন সন্ধান পাওয়া গিয়েছে কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়। তাহলে, যেখানে ঘটনার পরিপূর্ণ তদন্তই শেষ হয়নি সেখানে কিভাবে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে যাবে তুরস্ক?

তারা সংকটকে দীর্ঘ করে বিষয়টাকে ধীরে ধীরে তুর্কি-সৌদি সংকট থেকে বের করে এনে এটাকে বৈশ্বিক সংকটে রুপ দিতে চেষ্টা করে এবং এতে তারা শতভাগ সফল হয়েছে। যদি আবেগের বশীভূত হয়ে ঘটনার পরের দিনই অবিবেচনাপ্রসূত কিছু একটা করে বসতো তখন সৌদিআরবও রিয়াকশন দেখাতো। শুরু হতো দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক যুদ্ধ।

 

৪.

তুরস্ক এবং সৌদি আরব প্রায় সমশক্তির দু’টি দেশ। তাই তুরস্কের এমন সক্ষমতা নেই যে, একা সৌদি আরবের বিরুদ্ধে অবরোধ বা এ ধরণের কোন শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা নিতে পারবে। বড়জোর কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবে। এটা করতে গেলে সবগুলো আরব রাষ্ট্র মিলে কাতারের মত তুরস্ককে বয়কট করার ডাক দিতে পারে। তখন সৌদি আরবের কোন সমস্যা তো হবেই না, উল্টো তুরস্কই বেকায়দায় পড়বে। রাজনীতি বাস্তবতা এবং সম্ভাব্যতার নাম, আবেগ আর প্রত্যাশার নাম নয়। তাই এই ক্ষেত্রে তুর্কি সরকার একটি অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল অবলম্বন করে। তারা সংকটকে দীর্ঘ করে বিষয়টাকে ধীরে ধীরে তুর্কি-সৌদি সংকট থেকে বের করে এনে এটাকে বৈশ্বিক সংকটে রুপ দিতে চেষ্টা করে এবং এতে তারা শতভাগ সফল হয়েছে। যদি আবেগের বশীভূত হয়ে ঘটনার পরের দিনই অবিবেচনাপ্রসূত কিছু একটা করে বসতো তখন সৌদিআরবও রিয়াকশন দেখাতো। শুরু হতো দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফলাফল যেটাই হোক, সবচেয়ে বড় ক্ষতি হতো এটাই যে, দু’দেশের কূটনৈতিক যুদ্ধের ডামাডোলের নিচে খাশোগি ইস্যুটিই সম্পূর্ণ চাপা পড়ে যেতো। এখন তুরস্ক কৌশলে এই ঘটনায় পুরো বিশ্বকে জড়াতে সক্ষম হয়েছে। বলটা বিশ্বমোড়লদের কোর্টে ঠেলে দিয়েছে। তারাই সমাধা করুক। ফল এই হয়েছে যে, তুরস্ক একাকি সৌদি আরবের মুখোমুখি দাঁড়ানোর রিস্ক থেকে বাঁচতে পেরেছে। এটা অনেক বড় একটা সফলতা। প্রচণ্ড রাজনৈতিক প্রজ্ঞা না থাকলে এ ধরণের ব্যাপারে পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি।

৫.

পশ্চিমাদের চরিত্র এবং পলিটিক্স বোঝার ক্ষেত্রে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তুরস্কই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সক্ষম। কারণ মুসলিম বিশ্বের মধ্যে আর কোন রাষ্ট্র পশ্চিমাদের সাথে রাজনৈতিক এবং সামরিকভাবে এতো বেশি জড়ায়নি। ঐতিহাসিকভাবেও অটোমান তুরস্কের সাথে ইউরোপ ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিল। কয়েকশত বছর অটোমানরা বলকান এবং পূর্ব ইউরোপ শাসন করেছে। তাই তুরস্ক বরাবরই পশ্চিমের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। খুব নিকট অতীতে পশ্চিমারা তুরস্ককে অতি উৎসাহ দিয়ে সিরিয়া সংকটের গভীরে জড়িয়ে দেয়। সংকট যখন তুঙ্গে এবং একটি সফল সমাপ্তির দিকে গড়াচ্ছিল তখনই তারা তুরস্ককে পথের মাঝখানে রাশিয়া ইরান আর আসাদের সামনে একা ফেলে চুপ করে সরে পড়ে, যার শাস্তি তুরস্ককে এখনো ভোগ করতে হচ্ছে। তাই এবার আর পশ্চিমাদের কথা শুনে এগুতে চাচ্ছে না। বরং বলটা তাদের কোর্টেই ঠেলে দিয়ে একরকম নিরবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। মিডিয়ায় একটু একটু তথ্য ফাঁস করে পশ্চিমা মিডিয়াকে ব্যস্ত রাখার কৌশল নিয়েছে এবং এর মাধ্যমে তাদের সরকারগুলোর উপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। সম্ভবত, তুরস্ক প্রথমে নিশ্চিত হতে পারেনি যে, এই ঘটনা কি তুর্কি-সৌদি সংঘর্ষ লাগিয়ে এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি শিকার করার পশ্চিমা কোন ষড়যন্ত্র, নাকি এটি দাম্ভিক সৌদি নেতৃত্বের অপরিনামদর্শি কোন কাজ? তাই পশ্চিমাদের উপর নির্ভর করে হুট করে একশনে যাওয়ার ঝুঁকি না নিয়ে এখনো পর্যন্ত খুবই সতর্ক পায়ে এগুচ্ছে।

৬.

আতাতুর্কের পরে এরদোগান তুরষ্কের সবচেয়ে শক্তিমান শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সবগুলো সিদ্ধান্তের রশি বলতে গেলে তার হাতে। তারপরেও তুরস্ক একটি ‘প্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিক’ আধুনিক রাষ্ট্র। এখানে সরকারকে জবাবদিহি করতে হয়। রয়েছে শক্তিশালি ডিপস্টেট এবং বুর‍্যুক্রেসি। জ্বালানির মতো গুরুত্বপূর্ন কোন খনিজ সম্পদ এদেশের নেই। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে কৃষি এবং শিল্পোৎপাদন। এসব পন্যের রপ্তানির উপর নির্ভর করে দেশের অর্থনীতির চাকা। আর এজন্য চাই প্রসারমান বাজার এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ। তাই এ ধরণের রাষ্ট্রের জন্য বিদেশনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে। সব কিছুর আগে ভাবতে হয় অর্থনীতির কথা। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বন্ধু রাষ্ট্র খুঁজতে হয়। একটি বন্ধু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন ধরণের ব্যাবস্থা নিতে দশবার চিন্তা করতে হয়। কারণ একটি বন্ধু হারানো মানে একটি বিশাল বাজার হারানো। শতকোটি টাকার বিনিয়োগ হারানো। তাই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টকে অবশ্যই রাষ্ট্রীয়-স্বার্থ এবং জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করতে হয়। ব্যবসা এবং বিনিয়োগের কথা চিন্তা করতে হয়। প্রেসিডেন্টের নিজস্ব আবেগ, মতামত এবং ইচ্ছে এখানে গৌণ।

.

রাজনীতিতে ‘ফরওয়ার্ড এরিয়া’ নামে একটা ব্যাপার আছে। মানে আপনি ততটুকুই সামনে এগুবেন যতটুকু জায়গা পরবর্তীতে আপনি ধরে রাখতে পারবেন। যদি এমন হয় যে, আপনি আবেগের বশীভুত হয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেলেন, অনেক কিছু চেয়ে বসলেন, যেগুলো পরবর্তীতে পরিস্থিতির চাপে আপনি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন- তাহলে রাজনৈতিকভাবে আপনাকে এর চরম মূল্য দিতে হবে।  এর দু’টি উদাহরণ দেয়া যায়: একটি হচ্ছে সিরিয়া সংকট, আরেকটি হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সিরিয়ার যুদ্ধের শুরুতেই বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তুরস্ক, সৌদিআরব এবং কাতারসহ আরও কয়েকটি দেশ হুমকি দেয়। কিন্তু পরবর্তী পরিস্থিতিতে এইসব দেশকে এমন সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসতে হয়। ১০ বছর ধরে চলে আসা বাংলাদেশের স্বৈরসরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সরকারবিরোধী দলগুলো প্রায়ই হুমকি ধমকি দিয়ে আসতো। কিন্তু এটা যে তাদের সাধ্যের বাইরের কাজ তা তাদের কাজকর্ম প্রমাণ করেছে। ফলে জনগণের সহানুভূতি লাভ করার পরিবর্তে উল্টো তাদের ঠাট্টা বিদ্রুপের শিকার হচ্ছে। সুচিন্তিত পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক দুই ক্ষেত্রেই উভয় পক্ষ ব্যার্থ হয়েছে। ফলে এখন এসব শক্তিকে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে। এখানেও খাশোগিকে মুহাম্মাদ বিন সালমানের নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে – এই ব্যাপারে সম্ভবত সকল রাষ্ট্র নিশ্চিত হতে পেরেছে। কিন্তু এই অপরাধের জন্য কি তারা বিন সালমানকে বলি দিতে রাজি হবে? এই ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা নেই। তার কারণ-

ক.

ইসরাইল এবং বিশ্বের যায়োনিস্ট লবি খুব পরিকল্পিতভাবেই তাকে ক্ষমতায় এনেছে। ফিলিস্তিনের একটা দফারফা করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাকে তুলে আনা হয়েছে। এর পাশাপাশি আগামী পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত যাতে সৌদি আরব নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায় সেটাও বিবেচনায় ছিল। যদি মুহাম্মাদ বিন সালমান টিকে যায় তাহলে কয়েক দশকের মধ্যে সৌদি আরব আতাতুর্কের তুরস্কের রূপ ধারণ করলে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। এই ব্যাপারে ট্রাম্প স্পষ্ট করে বলেছিলেন: ‘আমাদের লোককে আমরা সঠিক স্থানে বসিয়েছি।’ খাশোগির হত্যাকাণ্ড আমেরিকানদের জন্যও নিঃসন্দেহে একটি অপ্রত্যাশিত কাজ। তাদেরকেও চরম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। এটা তারাও মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু এই অপরাধের জন্য কি তারা তাদের পরিকল্পিত ব্যাক্তিকে সরাতে রাজি হবে? যায়োনিস্ট লবিও কি তা করতে দেবে? তার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

আগামী মাস থেকে ইরানের উপর আমেরিকা কঠোর অবরোধ আরোপ করতে যাচ্ছে। অবরোধ কার্যকর করার মার্কিন পরিকল্পনার মূল কেন্দ্রে রয়েছে প্রধানত সৌদি আরব এবং অন্যান্য তেলরপ্তানিকারক উপসাগরীয় দেশগুলো। অবরোধের কারণে তেলের বাজারে যে বিশাল ঘাটতি তৈরি হবে সেটাকে সামাল দেয়া হবে এসব দেশের তেল উত্তোলন বৃদ্ধি করার মাধ্যমে। তাই আমেরিকা এই মুহুর্তে সৌদি আরবে কোন ধরণের অস্থিশীলতা চাচ্ছে না।

 

খ.

ট্রাম্প প্রশাসন ইরানকে সিরিয়াস ভাবে নিয়েছে। দেশটির বৃদ্ধিপাওয়া নখগুলো কেটে দিতে আমেরিকা বদ্ধপরিকর। এই উদ্দেশ্যে আগামী মাস থেকে ইরানের উপর আমেরিকা কঠোর অবরোধ আরোপ করতে যাচ্ছে। অবরোধ কার্যকর করার মার্কিন পরিকল্পনার মূল কেন্দ্রে রয়েছে প্রধানত সৌদি আরব এবং অন্যান্য তেলরপ্তানিকারক উপসাগরীয় দেশগুলো। অবরোধের কারণে তেলের বাজারে যে বিশাল ঘাটতি তৈরি হবে সেটাকে সামাল দেয়া হবে এসব দেশের তেল উত্তোলন বৃদ্ধি করার মাধ্যমে। তাই আমেরিকা এই মুহুর্তে সৌদি আরবে কোন ধরণের অস্থিশীলতা চাচ্ছে না। মুহাম্মাদ বিন সালমানকে ক্ষমতাচ্যুত করলে বর্তমান চলে আসা পরিস্থিতি কতটুকু স্থিতিশীল থাকবে সে ব্যাপারে আমেরিকানরা সন্দিহান। তাই এই রকম একটি মুহুর্তে তারা কোন রিস্ক নিতে রাজি হবে না।

গ.

পশ্চিমা দেশগুলোতে সৌদি আরবের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমেরিকায়। শুধু অস্ত্রচুক্তিই হয়েছে ১শ বিলিয়ন ডলারের বা তার চেয়েও বেশি মুল্যের। বৃটেনের অস্ত্র রপ্তানির ৫০% যায় সৌদি আরবে। জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি এবং স্পেনের অস্ত্রের বড় বাজার সৌদিআরব। এগুলো ছাড়াও, জ্বালানি নির্ভর অর্থনীতি থেকে সৌদি আরবের অর্থনীতিকে বের করে একটি শিল্প বিনিয়োগ- নির্ভর আধুনিক অর্থনীতিতে রুপান্তর করার মুহাম্মাদ বিন সালমানের ঘোষিত পরিকল্পনার কারণে আমেরিকান এবং ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে এই অঞ্চলে। নিওম প্রজেক্ট থেকে শুরু করে সবকিছু তারা ভাগভাগি করে নিচ্ছে। এই মাসের ২৩ তারিখে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশাল অর্থনৈতিক সম্মেলন, যেটাকে বলা হচ্ছে ‘ডেজার্ট ডাভোস’। এখানে পশ্চিমের প্রায় সব বড় বড় বিজন্যাস টাইকুন অংশগ্রহণ করছে বা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। যদিও খাশোগির ঘটনার পরে অনেক বড় বড় ব্যাক্তিত্ব এবং কোম্পানি সম্মেলন বয়কট করার ঘোষণা দিয়েছে, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব কি আসলেই তাদের এরকম বিশাল বিনিয়োগ প্রজেক্ট হাতছাড়া করতে রাজি হবে কেবল একজন সাংবাদিকের কারণে?

তুরস্ককে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যেকোন পদক্ষেপ নেয়ার পূর্বে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। পশ্চিমাদের কৌশল পড়তে পারা এই মুহুর্তে খুবই জরুরি। পশ্চিমা মিডিয়ায় ঘটনাটি প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি কভারেজ পেয়েছে। এখনো মিডিয়া এটা নিয়ে খুব শক্ত অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু এগুলো পাল্টাতে খুব বেশি সময় লাগবে না। গোটা দুনিয়ার মিডিয়া ইহুদিদের হাতের ইশারায় চলে। তাদের কিঞ্চিত আঙুল হেলানিতে খাশোগি ইস্যু চোখের পলকে মিডিয়া থেকে গায়েব হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওয়াশিংটন পোস্ট এবং আল জাজিরার মতো কয়েকটি মিডিয়া মিলে কিছুই করতে পারবে না। তাই পশ্চিমাদের উপর ভরসা করে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে যাওয়ার আগে এই ব্যাপারগুলো সুক্ষ্মভাবে ভাবতে হচ্ছে। এমন যেন না হয় যে, ফ্রন্ট লাইনের এতো বেশি সামনে চলে গেল যে, সেখান থেকে আবার ফিরে আসতে হচ্ছে প্রয়োজনীয় সাপোর্টের অভাবে। যদি এমনটি হয় তাহলে আম-ছালা দুটোই তো যাবেই, উল্টো নিজেরাই সংকটে পড়বে।

এই অঞ্চলে জ্বালানি নিয়ে একটি ভয়াবহ যুদ্ধ আসন্ন, যা সিরিয়া যুদ্ধের চেয়েও বেশি ধংসাত্মক হবে। তুরস্কের পূর্বে রয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দী ইরান এবং ঐতিহাসিক-শত্রু আর্মেনিয়া। নিকট ভবিষ্যতে এই দুইটি দেশের তুরস্কের মিত্র হবার সম্ভাবনা জিরো পার্সেন্ট। ভরসা ছিল আরব দেশগুলো। কিন্তু আরব বসন্তের ব্যর্থতার পর অধিকাংশ প্রভাবশালী আরব রাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে।

 

.

বর্তমান পরিস্থিতিতে তুরস্ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। চতুর্দিক থেকে শত্রু পরিবেষ্টিত। উত্তরে কৃষ্ণ সাগর, যেখানে রাশান নৌবহর প্রতিনিয়ত টহল দিচ্ছে। পূর্ব-দক্ষিণে বিক্ষুদ্ধ সিরিয়া এবং আরেক বিষফোঁড় কুর্দি টানেল। দক্ষিণ-পশ্চিমে ভূ-মধ্যসাগর এবং সাইপ্রাস। ভূ-মধ্যসাগরে তুরস্কের তাবৎ শত্রুদের শক্তিশালী নৌবহর গিজগিজ করছে। সাইপ্রাস সমস্যার কোন সুরাহা এখনো হয়নি। এটা নিয়ে ইউরো-সাইপ্রাস এবং গ্রিসের সাথে তুরস্কের এক রকম যুদ্ধাবস্থা চলছে। সামরিক শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারবে না বলেই গ্রীস সরাসরি চ্যালেঞ্জ করার সাহস করছে না, কিন্তু সুযোগ পেলেই ছোবল মারতে এক মুহুর্তও দেরি করবে না। এরই মধ্যে ভূ-মধ্যসাগরে গ্যাসফিল্ড নিয়ে তুরস্কের সাথে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এই অঞ্চলে ভবিষ্যতের যে কোন নৌযুদ্ধে তুরস্ককে মুকাবিলা করার জন্য মিশর, ইসরাইল, গ্রীস এবং সাইপ্রাস ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। মাত্র ১০/১২ দিন পূর্বেও সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ক্রীট দ্বীপে এই উদ্দেশ্যে যৌথ মিটিং করেছে এবং আকারে ইঙ্গিতে তুরস্কের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই অঞ্চলে জ্বালানি নিয়ে একটি ভয়াবহ যুদ্ধ আসন্ন, যা সিরিয়া যুদ্ধের চেয়েও বেশি ধংসাত্মক হবে। তুরস্কের পূর্বে রয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দী ইরান এবং ঐতিহাসিক-শত্রু আর্মেনিয়া। নিকট ভবিষ্যতে এই দুইটি দেশের তুরস্কের মিত্র হবার সম্ভাবনা জিরো পার্সেন্ট। ভরসা ছিল আরব দেশগুলো। কিন্তু আরব বসন্তের ব্যর্থতার পর অধিকাংশ প্রভাবশালী আরব রাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। এরকম স্পর্শকাতর একটি সময়ে এরদোগান সরকার শক্ত হাতে তুরস্কের হাল ধরে আছে। সার্কাসের মটর সাইকেল আরোহী যেমন একটি সরু রশির উপর মটর সাইকেল চালায় এরদোগানও তুরস্ককে ঠিক এভাবেই পরিচালিত করছে। একটু এদিক সেদিক হলেই, ভারসাম্যের মধ্যে সামান্যতম হেরফের হলেই পা ছিটকে গভীর খাদে পড়ে যাওয়ার সমূহ-সম্ভাবনা আছে।

এরকম একটি স্পর্শকাতর মুহুর্তে, যখন এক একটি মিত্রদেশ তুরস্কের জন্য সোনার চাবির মতো, তখন সৌদি আরবের মতো একটি প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘাতে জড়ানো তুরষ্কের জন্য আত্মহত্যা করার মতো। কারণ এর প্রভাব সৌদি আরব আর তুরস্কের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং সৌদি আরবের সকল মিত্ররাষ্ট্রের সাথেও তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্ক চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মধ্যেই ৬টি আরব রাষ্ট্র সৌদি আরবের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। তাই তুরস্ক খাশোগি হত্যার সঠিক বিচার চায়। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে দেশটির সরকারকে হাজারো বিষয় নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। আমরা দূর থেকে সরল চোখে ঘটনাকে যেভাবে দেখছি, যত সহজ ভাবছি, আদতে ঘটনা সেরকম নয়। আরো অনেক গভীর।