নাগরিক ঐক্যের জনবান্ধব ভিত্তি; কার জন্য ও কি নিয়ে ঐক্য চাই- শেষ পর্ব

নাগরিক ঐক্যের জনবান্ধব ভিত্তি; কার জন্য ও কি নিয়ে ঐক্য চাই- শেষ পর্ব

জোনায়েদ সাকির প্রস্তাবণা ও নাগরিক সনদের রাজনীতির পুনঃ যাত্রা:

বাংলাদেশে জোট ভিত্তিক ক্ষমতার রাজনীতিতে জোটের আগেই ভোটের ভাগাভাগি গুরুত্বপূর্ণ। এইসব জোটের আভ্যন্তরীণ ও উন্মুক্ত কোন আলোচনাতেই নাগরিক ইস্যু প্রাধান্য পায় না। এখানে শুধুই রাজনৈতিক ক্যাচাল চলে এবং একে অপরকে ঠেঙানোর অপকৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। জনবান্ধব দাবি নিয়ে কথা উঠলেই মনে করিয়ে দেয়া হয় এটা নির্বাচনী ইশতেহারের ইস্যু। কিন্তু একটি দলের নির্বাচনী মেনিফেস্টো ঠিক কি, এটা কেউ জানে না, জানার ব্যবস্থাও রাখা হয়না কৌশলে। ভোটের ঠিক ২-৩ দিন আগে দু-তিন জন কেউকেটাকে দলের ইশতেহার বানানোর দায়িত্ব দেয়া হয়, ইনারা কাটপেস্ট করে দায়সারা ভাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং এর হাইলাইট গুলো শুধু প্রশ্ন সাপেক্ষে সাংবাদিকদের জানান দেয়া হয়। এই নির্বাচনী ইশতেহারের জন্য সম্পদ ব্যবস্থাপনার দুরদর্শী দিকগুলো, বিভিন্ন সমস্যা গুলো, নাগরিক দাবির দিকগুলো থাকে কিনা, কোন কোন বিষয় ও সমস্যা প্রাধান্য পাবে তার কোন দায়বদ্ধতা থাকে না। অর্থাৎ নাগরিক তো বটেই এমনকি কর্মীরাও দলীয় মেনিফেস্টো জানেন না, অবাক করা ব্যাপার জানে না নির্বাচন কমিশনও। যেমন আওয়ামীলীগের ভিশন ২০২১ বা ২০৪১ এ ঠিক কি আছে কিংবা বিএনপির রূপকল্প ২০৩০ তে ঠিক কি আছে তা তাদের অধিকাংশ নেতাই জানেন না, কর্মী তো দুরের কথা। নির্বাচনের মেনিফেস্টোতে কি কি আছে, সেগুলা দুরদর্শী কিনা, বাস্তব কিনা, সত্য কিনা কিংবা আগের বছরের পুনরাবৃত্ত কিনা, একই প্রতিশ্রুতিতে পুর্বে কি কাজ করা হয়েছে সেটা যাচাইয়ের কোন প্রথা ও প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশনে নেই।

দেশের স্বৈরাচারী সরকার বিরোধী নাগরিক ঐক্য প্রক্রিয়াতেও মূলত তলে তলে প্রধান পদ পদবী, মন্ত্রীত্ব এবং দলীয় আসন ভাগাভাগির সূত্র ধরেই এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এই গতানুগতিক ধারায় অভিনবত্ব সৃষ্ট করে একটা অদ্ভুত কাজ করে ফেললেন জোনায়েদ সাকি। সরকারী বিরোধী পাওয়ার পলিটিক্সের হর্তা কর্তাদের উপস্থিতিতেই দুর্বিত্তপরায়ন রাজনীতি হটিয়ে নাগরিক বান্ধব শাসন কাঠামো আনতে একটি নতুন শাসন তন্ত্র এবং জনবান্ধব নাগরিক সনদের কথা সবিস্তারে বলে বসলেন উনি। যেহেতু এই মিটিং এর উপর দেশের সরকার ও বিরোধী সকল পক্ষের গভীর মনোযোগ ছিল তাই বক্তব্যটি দ্রুতই বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টি কড়েছে ফেলেছে।

১৫০টি আসনের বেশি একটি দলকে দেয়া যাবে না যাতে তারা নিরঙ্কুশ হয়ে পড়ে। এটা নিঃসন্দেহে একটা মহৎ প্রস্তাবনা। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচনী পাওয়ার পলিটিক্সে এটা বাস্তব নয়। পপুলিস্ট ব্যক্তি প্রার্থী প্রতিপক্ষ থেকে টাকা খেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জোটের ভোট কাটবে এবং কিছু ক্ষেত্রে বিদ্রোহী প্রার্থীর জিতে যাবার ঘটনাও ঘটবে।

 

সস্তা রাজনৈতিক বাহাস এবং একের বিরুদ্ধে অন্যের কুটচালই যেখানে দলীয় এবং দেশের রাজনৈতিক আলোচনার মূল বিষয় থাকে সেখানে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে জোনায়েদ সাকির এই প্রস্তাবনা নতুন ভাবনার জন্ম দিয়েছে পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনে। অবশ্যই আগে থেকেই ভিন্ন ভিন্ন পরিসরে নাগরিকদের জন্য নিয়মতান্ত্রিক ও কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা ও দাবির ব্যাপার ছোট বড় দলের উপলব্ধিতে এসেছে এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই নাগরিক বোধ ছড়িয়ে দেওয়ার প্রশংসনীয় কিছু চেষ্টাও হয়েছে। এই ব্যাপারে রাষ্ট্রচিন্তা নামের সংঘঠনের একটিভিস্টরা প্রশংসিত কাজ করেছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক মুভমেন্ট করা এই সংঘঠন বরাবরই একটি নিয়মতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের তাগাদা দিয়ে গেছে। একটি জনবান্ধব নাগরিক সনদ নিয়ে নিরলস কাজ করেছেন, ডেভেলপমেন্ট এক্টিভিস্ট এবং পলিটিক্যাল এনালিস্ট জিয়া হাসানইন্ডিপেনডেন্ট একটিভিস্টরা জনগনকে বারবার ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে সমাজের সাথে চলা রাজনীতির বুঝাপড়ার ক্ষেত্রগুলোকে ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং নতুন করে কি ধরনের সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট তৈরি করা সময়ের দাবি। তথাপি সব রাজনৈতিক স্টেইক কে দর্শক কিংবা শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত রেখে এইধরনের জন কল্যাণ বোধের ভিত্তিতে বক্তব্য দান সুবিবেচনা প্রসূত হয়েছে (যেখানে তিনি ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন, দুর্নীতি, সম-অধিকার, সাংবিধানিক নৈরাজ্য রোধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন সহ একটি নাগরিক সনদের কথা বলেছেন)। এর পরবর্তীতে আমরা দেখেছি প্রায় সব দলই শাসন তন্ত্র পরিবর্তনের পাশাপাশি এক গুচ্ছ নাগরিক কল্যাণের দিক নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। ঢাকায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপি একটি সমাবেশই করেছে তাদের ৭ টি দাবী ও নাগরিক বান্ধব ১২ লক্ষ নিয়ে, সেখানে তারা ক্ষমতায় আসলে কি কি লক্ষে কাজ করবে সেটা সবিস্তারে বলেছে। অবাক করা ব্যাপার হল, ইসলামী আন্দোলনের নেতা চরমোনাই পীর সাহেবের ঢাকা সমাবেশে একই ধরনের নাগরিক বান্ধব বক্তব্য শুনা গেছে। আরো অবাক করা ব্যাপার, নির্বাচনী বছরে প্রথম বারের মত সরকারের মন্ত্রীরা বলতে শুরু করেছেন তারা ফের ক্ষমতায় আসলে কি করবেন। নির্বাচনহীন সরকারের কুশিলবরা যেখান ভুলেই গেছিলেন দায়বদ্ধতা বলে কিছু আছে সেখানে সাকির জন-সনদের রাজনীতি রাজনীতিতে ভালো কিছু আলোচনার শুরু করে কিছু আশার সন্ধান দিয়েছে।

বর্তমানে বিরোধী জাতীয় ঐক্যের প্রক্রিয়া যেমন এগুচ্ছে তেমনি জনবান্ধব রাজনীতির ও নাগরিক স্বার্থ্য সংশ্লিষ্ট কথার আলোচনাও সমাজে বেড়েছে। এটা একটা বড় প্রাপ্তি, রাজনীতি থেকে এই আলোচনা পুরোপুরি বিস্মৃত ছিল। বর্তমানে অভিন্ন সাত দাবি ও ১১ লক্ষ্যের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের রূপরেখা তৈরি হয়েছে এবং তারা যেসব লক্ষ গুলোতে ঐক্য করেছে দৃশ্যতই সেগুলো মহৎ।

বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ৭ দফা দাবিগুলো হলো—

  • ১. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, আলোচনা করে নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার।
  • ২. নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা দেওয়া।
  • ৩. বাক্, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
  • ৪. কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন, সামাজিক গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের অভিযোগে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দিতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা।
  • ৫. নির্বাচনের ১০ দিন আগে থেকে নির্বাচনের পর সরকার গঠন পর্যন্ত বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া।
  • ৬. নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং সম্পূর্ণ নির্বাচনপ্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে তাঁদের ওপর কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ না করা এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করা।
  • ৭. তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা এবং নতুন কোনো মামলা না দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া।

বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ১১টি লক্ষ্য হলো—

  • ১. মুক্তিসংগ্রামের চেতনাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাহী ক্ষমতা অবসানের জন্য সংসদে, সরকারে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, ন্যায়পাল নিয়োগ করা।
  • ২.সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও সৎ-যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিশন গঠন করা।
  • ৩. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা নিশ্চিত করা।
  • ৪. দুর্নীতি দমন কমিশনকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করা হবে। দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি কঠোর হাতে দমন ও দুর্নীতির দায়ে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা।
  • ৫. বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি, বেকারত্বের অবসান ও শিক্ষিত যুবসমাজের সৃজনশীলতা ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাকে একমাত্র যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা।
  • ৬. জনগণের মৌলিক মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষক-শ্রমিক ও দরিদ্র মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সরকারি অর্থায়নে সুনিশ্চিত করা।
  • ৭. জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতি ও দলীয়করণ থেকে মুক্ত করা।
  • ৮. বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা আনা, সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সুষম বণ্টন ও জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা।
  • ৯. জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গঠন এবং প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও নেতিবাচক রাজনীতির বিপরীতে ইতিবাচক সৃজনশীল এবং কার্যকর ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা।
  • ১০. ‘সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’—এই নীতির আলোকে পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা।
  • ১১. প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সমরসম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত ও যুগোপযোগী করা।

দুই- শাসন তান্ত্রিক পরিবর্তনে নেগসিয়েশন কৌশল:

যেহেতু বাংলাদেশের ক্ষমতাবলয়ের বর্তমান ও সাবেক দলগুলো ক্ষমতায় গিয়ে জনবান্ধব দাবীর ব্যাপারে প্রতারণা করে তাই নতুন রাজনীতিতে কৌশলগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেগসিয়েশন দরকার।

১. ইন্টেলেকচুয়াল পাওয়ারকে ভোটের পাওয়ারের উপর একটা নির্দিস্ট পর্যায় পর্যন্ত স্থান দেয়া।

এখানে একটা প্রস্তাবনা এসেছে যে ১৫০টি আসনের বেশি একটি দলকে দেয়া যাবে না যাতে তারা নিরঙ্কুশ হয়ে পড়ে। এটা নিঃসন্দেহে একটা মহৎ প্রস্তাবনা। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচনী পাওয়ার পলিটিক্সে এটা বাস্তব নয়। পপুলিস্ট ব্যক্তি প্রার্থী প্রতিপক্ষ থেকে টাকা খেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জোটের ভোট কাটবে এবং কিছু ক্ষেত্রে বিদ্রোহী প্রার্থীর জিতে যাবার ঘটনাও ঘটবে। ফলে ছোট দলগুলোর স্বয়ং প্রেসিডেন্টও ঐক্য জোটের প্রার্থী হয়ে জিতে আসতে ব্যর্থ হবেন। ফলে এই ফর্মুলা ও কৌশল বাংলাদেশের ভোট কেনার সংস্কৃতিতে ফলদায়ক হবে না।

যেহেতু ছোট দলগুলো ভোটের রাজনীতিতে একেবারেই দুর্বল তাই এখানে ভিন্ন কৌশল দরকার। এই কৌশল এরকম করা যেতে পারে-

১। প্রধানমন্ত্রী পদ সবচাইতে বড় দলের বাইরে থাকবে। অর্থাৎ বিএনপি’র কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এবং এমন সম্মানিত ও দায়িত্বশীল সৎ লোক মন্ত্রীসভাকে নেতৃত্ব দিবেন যিনি নিয়মতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা বিন্যাস, সংসদ ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বিন্যাসের ব্যাপার গুলো বুঝেন এবং কোথায় কোথায় ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে সেখানে দ্রুত হাত দিতে পারেন। এক্ষেত্রে ড কামাল হোসেন কিংবা অন্য সিনিয়র সংবিধান বিশেষজ্ঞকে একটি নির্দিস্ট মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে হবে। এই ২-৩ বছরের মধ্যেই শাসনতন্ত্র পরিবর্তনের কাজ দ্রুত সম্পন্ন হতে হবে। যেহেতু বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত তাই এই ফ্রেমে থেকেই কাজটা করে নিয়ে পড়ে বিন্যস্ত হয়ে পড়া কম ক্ষমতার নতুন প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যেতে পারে (দুর্বল ক্ষমতার প্রধানমন্ত্রীকেই বিএনপি’র মেনে নিতে হবে)।

 

এতে করে সাত দফা দাবী এবং এগার দফা জনবান্ধব ভিত্তির প্রাথমিক ক্রেডীবিলিটি তৈরি হবে।

২। যেহেতু বলা হচ্ছে নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হবে সেহেতু নির্বাচনী নমিনেশনকে এক্সপার্ট রিজার্ভেশনের ভিত্তিতে যেতে হবে। অর্থাৎ একটি নতুন শাসনতন্ত্র তৈরি ও কায়েমে প্রধানমন্ত্রী সহ ঠিক কত সংখ্যক ও কোন কোন মন্ত্রী, কত সংখ্যক সংসদীয় কমিটি ও কোন কোন টি এবং ঠিক কত সংখ্যক এক্সপার্ট পেশাজীবী সাংসদ দরকার সেটা ঠিক হবে। ধরা যাক এটা করতে প্রধানমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী সহ ৭৫ টি ক্ষমতাবান মন্ত্রী ও সাংসদ পদ দরকার হবে। এবার এখানে ছোট ছোট দলের বড় বড় স্টেইক ঠিক করা হবে, বিএনপিকে এই ৭৫টি ক্ষমতার পদের সিংহ ভাগই ছেড়ে দিতে হবে, এই নিজেদের সবচেয়ে সেইফ আসন গুলোর কিছু এখানে ছেড়ে দিতে হবে। আর ছোট দলগুলো এখানে মেঠো বা ব্যবসায়িক নেতা নমিনেশন না করে বুদ্ধিবৃত্তিক হেভিওয়েট নির্ধারণ করবেন যারা একটা জনকল্যাণ ভিত্তিক রাষ্ট্রের স্ট্রাকচার দাঁড়া করাতে সমাজের গভীর জ্ঞান, বিশ্বায়ন প্রজ্ঞা ও দুরদর্শিতা, কারিগরি ও কাঠামোগত দিক থেকে পুরোপুরি সক্ষম।

মূল বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনী আসনের বিপরীতে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বর্তমানের কাঠামোরই “পদ” নিয়ে নেগসিয়েশন করতে হবে। মেঠো রাজনীতির ক্রীড়ানক এম্পিরা শাসনতন্ত্র পরবর্তনের মেধায় পিছিয়ে। ফলে তাদের দিয়ে জনকল্যাণ আশা করা যায়না যদি তারা সৎ ও হয়। তাই এখানে প্রধানমন্ত্রী সহ ৭৫টি ক্ষমতাবান মন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটির “এক্সপার্ট রিজার্ভেশনের ভিত্তিতে” নেগসিয়েশন চালাতে হবে। এই পদ গুলোর যথাসম্ভব বেশিরভাগ বিএনপির বাইরে রেখে বাকি ২২৫ আসনে মেঠো রাজনীতির পাওয়ার গেমে যেতে হবে নচেৎ নির্বাচনে জিতাই মুশকিল হয়ে পড়বে জোটের জন্য। অর্থাৎ একদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তনের বন্দবস্ত রাখতে হবে যাতে জিতে গেলে বিএনপি দাবী থেকে সরে পড়ার সুযোগ না পায়, অন্যদিকে পাওয়ার পলিটিক্স এবং ভোটের রাজনীতিতেও টিকে থাকতে হবে বর্তমান সিস্টেমের গেইম প্ল্যান ঠিক রেখে।

২। জাতীয় ঐক্য জাতীয় রাখতে হবে:

জাতীয় ঐক্যের বিন্যাস প্রতিনিধিত্বমূলক হতে হবে অর্থাৎ এই ফোরামে ডান মধ্য বামের নীতি নির্ধারনী আসনকে সুরক্ষ দিতে হবে, বক্তব্য প্রদানের সুযোগ তৈরি করতে হবে, সুরক্ষা দিতে হবে উপজাতীয় এবং আঞ্চলিক গোষ্ঠী গুলোকে। সুরক্ষা দিতে হবে পিছিয়ে পড়া পার্বত্য কিংবা হাওড় কিংবা মঙ্গা আক্রান্ত অঞ্চলের মানুষের দাবী, ভূমি অধিকার নিয়ে কাজ করা, নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনকে। স্পেইস ও নীতি সুরক্ষা দিতে হবে নদী ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা, বিদ্যুৎ বন্দর জ্বালানী নিয়ে কাজ করা বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠনকে। ঘুষ-নিয়োগ-তদবিরের বর্তমান পেশাজীবী রাজনীতির বাইরে এসে এখানে প্রকৃত এক্সপার্ট পেশাজীবীরা দেশের বিশেষ সমস্যা নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাবেন।

প্রথম দিকে অনেকেই আসতে চাইবেন না তবে তার জন্য ক্রেডিবিলিটি তৈরি করতে হবে, ঐক্যের বাইরে থেকেও অথিতি হিসেবে সবাইকে আসার সুযোগ দিতে হবে। সুযোগ দিতে হবে সাবজেক্ট ম্যাটার এক্সপার্টদের, বুদ্ধিজীবীদের, দলীয় পরিচয়ের গন্ডির বাইরে এসে। তাঁদের কথা শুনার সংস্কৃতি, ভিন্ন মতের শ্রোতা হবার কালচার তৈরি করতে হবে। কাউকে বিরাগভাজন করা চলবে না।

৩। বুদ্ধিবৃত্তিক পদের প্রার্থীকে রাজনীতির সাথে সমাজ-অর্থনীতি-পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নের সংযোগ গুলোকে বুঝতে হবে

আলোচ্য ৭৫টি ক্ষমতাবান পদ কিভাবে নির্বাচনী কাঠামোতে কিংবা টেকনোক্র্যাট কোটায় সুরক্ষিত হবে সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইন্টেলেকচুয়াল কিংবা নাগরিক সমাজের কাছাকাছি নিয়ে এসে সেই প্রার্থীকেও নির্বাচনে জিতিয়ে আনার চেষ্টা থাকতে হবে যাতে ব্যক্তি বুদ্ধিজীবি ও পেশাজীবী রাজনীতির সাথে সমাজ ও অর্থনীতির সংযোগ, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ম্যাক্রো এবং মাইক্রো অর্থনীতির সংযোগ , পরিবেশ সংযোগ, টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি এবং সর্বপরি সমাজের অপরাধ প্রবণতা ও অপরাধ দমনের কারিগরি দিক গুলো অনুধাবন করতে সক্ষম হন এবং বোধগম্য পর্যায়ে সমাধান করার কৌশল স্তির করতে পারেন। বুদ্ধিব্রিত্তিক প্রার্থীকে নাগরিক সনদের পয়েন্ট গুলোর এন্ড টু এন্ড ইমপ্যাক্ট ভিজুয়ালাইজ করতে সক্ষম হতে হবে। সুতরাং সেভাবে প্রস্তুতিও নেয়া চাই যাতে নাগরিক সমস্যা ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত সমস্যা গুলোর যেনতেন সাময়িক সমধানের পরিবর্তে টেকসই সমাধান পরিকল্পনা তৈরি হয়।

৪। ভোটের মেঠো রাজনীতিতে কোন ভুল সিদ্ধান্ত নয়

ভোটের রাজনীতিতে কোন রিস্ক নেয়া চলবে না, সেখানে যে প্রার্থী যোগ্যতা রাখেন তাকেই নমিনেশন দিতে হবে। শাসনতন্ত্র পরিবর্তন হবার আগে যেহেতু বর্তমানের নিয়মেই খেলতে হবে তাই সেখানে বর্তমান ধারাতেই পাওয়ার পলিটিক্স চালাতে হবে, অর্থাৎ বাকি ২২৫ আসনে। এখানে ভোটের বেইজ দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, প্রার্থীর দল বা কেন্দ্রীয় ফিগার নয়, মিডিয়া কিংবা রাজধানীর সুশীল ইমেজের ভিত্তিতে নয়।

বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ৭ দফা দাবি এবং নাগরিক সনদের লক্ষ্যে নেয়া ১১ দফা’র রাজনীতি সৎ ও বিশ্বাস যোগ্য করে তুলে নাগরিককে জাগিয়ে তোলার সৎ চেষ্টা হোক। প্রতারণার রাজনীতিকে পরাস্ত করে রাজনীতিতে গুণগত মানের নিশ্চয়তা আসুক। শুভবোধ জাগ্রত হোক চারিদিকে।

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও বেপারোয়া রাষ্ট্র লুট নিপাত যাক। ব্যাংক ও বাজেটের টাকা ও ক্ষমতা ভাগাভাগির হীন রাজনীতিকে পিছনে ফেলে নাগরিক স্বার্থ্যের রাজনীতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাক।