কলকাতা শহরের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল কল্পনার জগতে। পরিচয় হয়েছিল বইয়ের পাতায়, সেলুলয়েডের পর্দায়। দমদম, শিয়ালদা স্টেশন, চিতপুর, ভবানীপুর, জোড়াসাঁকো, নিউমার্কেট, ধর্মতলা আর কলেজ স্ট্রিট। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, সত্যজিৎ, শীর্ষেন্দুর বইয়ের মাধ্যমে এসব যেনো চেনা গলির মতই মনে হত! তাছাড়া নিজ দেশের ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে মিল থাকায় সিনেমা ও বইয়ের পাতায় দেখা কলকাতাকে স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছাও বেশ পুরনোই। তাই কলকাতা ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে এই শহর সম্পর্কে বইয়ে পড়া শত গল্প চোখে ভাসতে থাকে। অবশেষে কলকাতা যেতে পেরে যেন সকল স্বপ্ন সত্যি হয়ে যায়। ধর্মতলা, নিউমার্কেট, প্রেসিডেন্সি, হাওড়ার রাস্তাগুলো দেখে গল্পের সাথে মিলাতে শুরু করি। গল্প উপন্যাসের প্রতিও টান আছে বরাবরই। আর প্রিয় লেখকের তালিকায় সবসময়ই স্থান পেয়েছে কলকাতার লেখকরাও। যাদের লেখার অধিকাংশ জুড়ে রয়েছে কলেজ স্ট্রিট। তাই কলেজ স্ট্রিট নিয়েও আমার আলাদা ফ্যান্টাসি ছিল।
অবশেষে আমার ফ্যান্টাসি বাস্তবে পরিণত হয় এবং অভিজ্ঞতা হয় কলেজ স্ট্রিট ঘুরে দেখার। অভিজ্ঞতায় যাওয়ার আগে কলেজ স্ট্রিট সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক। কলকাতায় কলেজ স্ট্রিট নামটি খুবই সুপরিচিত। এটি মধ্য কলকাতার একটি ১.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা। বউবাজার অঞ্চলের গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউ-এর মোড় থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড মোড় পর্যন্ত এই রাস্তাটি প্রসারিত। কলকাতা শহরের কয়েকটি প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং প্রধান বই প্রকাশনা ও বিক্রয়কেন্দ্র এই রাস্তার দুই ধারে অবস্থিত। শুধু বাংলা বইয়ের বৃহত্তম বাজারই নয়, এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরোনো বইয়ের বাজারও। আর ভারতের বৃহত্তম বইয়ের বাজারও বটে। তাই আজও গোটা উপমহাদেশে কলেজ স্ট্রিটের নাম মানুষের মুখে মুখে। কিন্ত কিভাবে যাত্রা শুরু এই কলেজ স্ট্রিটের? কবে থেকে এই কলেজ স্ট্রিট বইয়ের বাজারের জন্য খ্যাতি লাভ করে, তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি তবে এই রাস্তার দুই দিক জুড়ে যখন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, তখনই বহু ব্যবসায়ী এই কলেজ স্ট্রিটে এসে বইয়ের দোকান খোলেন। তারপর ধীরে ধীরে কলেজ স্ট্রিট একসময় হয়ে ওঠে কলকাতার বইয়ের সেরা বাজার। এখান থেকে ধারণা করা যায় যে অষ্টাদশ শতকের মাঝের দিকে এই বইয়ের বাজার গড়ে উঠে। এই কলেজ স্ট্রিট এলাকাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজ, যা এখন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় (১৮১৭), হিন্দু স্কুল (১৮১৭), হেয়ার স্কুল (১৮১৮), সংস্কৃত কলেজ (১৮২৪), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭), কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল (১৮৫৭)। কলেজ স্ট্রিট কলকাতার প্রধান বই প্রকাশনা ও বিক্রয় কেন্দ্র হওয়ায় এই অঞ্চলটিকে বইপাড়া বলা হয়।
সারাদিন কলকাতার নিউমার্কেট চষে বিকেলে ধর্মতলা থেকে ট্রামে চেপে সোজা কলেজ স্ট্রিট। ট্রাম থেকে নামলাম প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে। আশপাশে তাকাতে চোখে পড়লো কলকাতা মেডিকেল কলেজ, হিন্দু কলেজ, সংস্কৃত কলেজ। একটু সামনে তাকাতেই দেখি রাস্তার ধারে সারি সারি বইয়ের দোকান। বইয়ের বাজার দেখে আমার চোখ ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম! বাজার দেখে মনে হলো, আমাদের বাংলাবাজার আর নীলক্ষেত একসাথে করলেও কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের মার্কেটের সমান হবেনা। অনেকে মনে করে থাকে কলেজ স্ট্রিটে শুধু পুরনো বই বিক্রি হয়। তবে শুধু পুরনো বই বিক্রি হয় না, কলেজ স্ট্রিট বই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও বিক্রয় কেন্দ্রের জন্যও বিখ্যাত। কলেজ স্ট্রিটেই রয়েছে কলকাতার অগ্রণী বই প্রকাশনা ও বিক্রয় কেন্দ্রগুলো। আনন্দ পাবলিশার্স, দে’জ পাবলিশার্স, রুপা অ্যান্ড কোং, সাহিত্যম, পত্র ভারতী প্রভৃতি প্রধান বাংলা প্রকাশনা সংস্থাগুলির প্রধান কার্যালয় এখানেই অবস্থিত। পুরনো বইয়ের বাজার হিসবে বিখ্যাত হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মূল্যবান নতুন-পুরনো সব ধরনের বই সংগ্রহ করতে চাইলে অনায়াসে পাওয়া যাবে এখানে। আনন্দ পাবলিশার্সে বই দেখতে দেখতে মিতিন মাসি সমগ্রে চোখ আটকে যায়। বই কেনার লোভ আটকাতে না পেরে নিয়ে নিলাম এক সেট।
কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় রয়েছে অন্তত হাজার খানেক বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান। রাস্তার দু’ধারেই বইয়ের অনেক ছোট ছোট দোকান আছে। দোকান ছাড়াও রাস্তার দুই ধারের ফুটপাতে সারি সারি সাজানো বই। আর এখানের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শুধু যে বাংলায়ই বই প্রকাশ হয় তা নয়, বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, অসমিয়া ইত্যাদি ভাষায়ও বই প্রকাশিত হয়। তাছাড়া প্রকাশিত হয় স্কুল, কলেজ, ভর্তি পরীক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়েরও নানা বই। তাই কলেজ স্ট্রিটজুড়ে সব সময়ই থাকে বইপ্রেমীদের ভিড় ও আড্ডা। বইয়ের ফাঁকে উঁকি মারে বিক্রেতার উৎসাহী মুখ। এই বইপাড়াকে বইয়ের খনি বললেও ভুল হবে না। দুষ্প্রাপ্য বইয়ের আঁতুড় ঘরও বলা চলে বইপাড়াকে। এই বইয়ের দোকানগুলিতে ঘুরতে ঘুরতেই হঠাৎ করে হাতে উঠে আসতে পারে প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য কোনো বই। শুধু ভারতেরই নয় বিশ্বের অন্যতম পুরনো বই বাজার যে এই কলেজ স্ট্রিট। এছাড়া ভারতের এবং এশিয়ার সব থেকে বড় বইয়ের বাজারও বলা হয়ে থাকে। আমিও ঘুরতে ঘুরতে আমার অনেক পুরাতন বই পেয়ে যাই সেখানে।
কিন্ত শুধু বইয়ের বাজারের জন্যেই বিখ্যাত নয় কলেজ স্ট্রিট। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বইয়ের বাজারকে কেন্দ্র করেই এখানে গড়ে ওঠে ঐতিহাসিক কফি হাউস, দিলখুশা কেবিন, বসন্ত কেবিন ইত্যাদি। এই কফি হাউস ছিল কলকাতার কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী, অধ্যাপক কলেজের ছাত্রছাত্রীদের আড্ডাস্থল। কে আসেননি এখানে? সুভাষচন্দ্র বসু, সত্যজিৎ রায়, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সবারই বিচরণ ছিল এখানে। তারা বিভিন্ন সময় আড্ডা দিয়েছেন। আর এই কফি হাউসকে নিয়েই প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী মান্না দে’এর গাওয়া গান ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানটি। বাঙলায় এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে এই গানটি শোনেনি।
তবে মান্না দে যে বলে গেছেন, কফি হাউসের আড্ডা এখন আর নেই। আসলেই কফি হাউসের আড্ডাটা হয়ত আজ আর তেমন নেই। এখনো অনেকে আসেন বটে, কিন্তু সেসব দিনের মতো হয়ত আর আড্ডা জমে ওঠে না। তবে এখনো এখানে অনেক মানুষ আসেন, কফি পান করেন, আড্ডা দেন। এখনো বিকেলের আড্ডায় গমগম করে কফি হাউস। বইপাড়া আর কফি হাউস দুইটা মিলে যেন একাকার এই কলেজ স্ট্রিট। তাই বইপ্রেমী হয়ে থাকলে কলেজ স্ট্রিট আপনার জন্যে সেরা ট্রিট হয়ে উঠবে। আর সাথে তো থাকছেই ঐতিহ্যবাহী কফি হাউজের কফির চুমুকে চুমুকে আড্ডা। সন্ধ্যার পর ভরপুর কফি হাউজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধোয়া ওঠা এক কাপ কফিতে চুমুক দিতে দিতে শেষ হয় আমার কলেজ স্ট্রিট ভ্রমণ। আমি তখন অদ্ভুদ এক প্রশান্তি নিয়ে দেখছি গমগম করতে থাকা ইন্ডিয়ান কফি হাউজকে।