সৌদি আরব কি ইসলামের কেন্দ্র হতে পারবে না?

ফয়সাল দেবজি’র লেখা

সৌদি আরব কি ইসলামের কেন্দ্র হতে পারবে না?

সৌদি আরবের ভূমিকা নিয়ে সারা দুনিয়াতে বিতর্ক রয়েছে মুসলিমদের মধ্যে আছে আশাহতাশা এইসবের বাইরে বিখ্যাত তাত্ত্বিক ফয়সাল দেবজি মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন, সৌদি কি আসলেই ইসলামের কেন্দ্র হতে পারে নিউ ইয়র্ক টাইম প্রকাশিত কলামটি জবানের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন তুহিন মুহাম্মদ।


ভারতীয় সাহিত্যিক নাজির আহমেদ ১৮৬৯ সালে তার একটি উর্দু উপন্যাসে, ভূগোল ক্লাসে দু’টি মেয়ের ভূমিকা চিত্রায়িত করেছেন। যেখানে তারা মানচিত্রে বিভিন্ন দেশ সনাক্ত করছিল। যখন তারা আরব উপদ্বীপে আসলো তখন তাদের শিক্ষক বললেন, এটি একটি খালি জায়গা যা মারাদিন বেদুইন দ্বারা অধিকৃত। এই বিরাণভূমির একমাত্র ঐতিহাসিক তাৎপর্য হল, এটি ইসলামের জন্মস্থান।

মুসলিম শক্তির কেন্দ্র বাগদাদ, কায়রো, ইস্তাম্বুল, ইসফাহান, দিল্লী এবং সমরকন্দের মসজিদ, গম্বুজ এবং মাদ্রাসার তুলনায় ইসলামের জন্মস্থান মক্কা এবং মদিনার সৌধ এবং প্রতিষ্ঠানগুলো স্থাপত্য মান ও অর্থনৈতিক দিক থেকে নিম্নমানের।

মুসলিম রাজারা খুব কমই এই মক্কা এবং মদিনা পরিদর্শন করেন। যার ফলে, এই স্থানগুলো তার শত্রুদের নির্বাসনের জন্য উপযোগী স্থান হিসেবে কাজ করে।

আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের আগে সৌদি আরব বা আরব উপদ্বীপ সারা পৃথিবীর মুসলমানদের জন্য কেন্দ্রীয় ও প্রান্তিক উভয় অবস্থানে ছিল। এমনকি মক্কা ও মদিনা মুসলিম তীর্থযাত্রীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলির প্রতিনিধিত্ব করে, দূরবর্তী এবং বিপজ্জনক শহর হওয়া সত্ত্বেও এই পবিত্র শহর দু’টির দৃষ্টিভঙ্গি এখনো হজ্বের সময়ের তীর্থযাত্রীদের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়ে।

ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান’র শাসন প্রতিষ্ঠার সময় থেকে সৌদি আরব খুব দ্রুত রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি তৈরি করতে লাগলো। তিনি ইয়েমেনের সাথে এক নিষ্ঠুর যুদ্ধে জড়িয়েছেন, কাতারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন এবং ইরান ও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দীদের ক্ষেত্রে আক্রমনাত্মক অবস্থান নিয়েছেন। প্রিন্স মোহাম্মদ সফল কিনা তা বিষয় নয়, তবে এটি মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরবের ধর্মীয় স্ট্যাটাসের আদল বদলাবে।

ইসলাম অবধারিতভাবে এশিয়ায় তার নিজস্ব ভিটে খুঁজে পাবে, যেখানে এখন পর্যন্ত তার সবচেয়ে বেশি অনুসারী বাস করে, এবং যার বৈশ্বিক সম্পদ এবং শক্তি ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনশীলতার অভিমুখী।

 

নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর পর ১৯ শতকে প্রথমবার আধুনিক ভূগোলে আরব উপদ্বীপকে ইসলামের কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছিলো। যখন অটোম্যান সাম্রাজ্যের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছিলো এবং ব্রিটিশ প্রভাব ভারতীয় অর্থনৈতিক ও সামরিক ভিত্তি থেকে বিস্তৃত হয়েছিলো।

‘মুসলিম বিশ্ব’ এমন একটি জাতিতে পরিণত হয়েছে যে মানচিত্রবৎ টার্মে একটি ধর্মকে উপন্যাসে কল্পনা করা সম্ভব হয়েছে। ১৮৮২ সালে ব্রিটিশ কূটনৈতিক ও অ্যরাবিস্ট উইলফ্রিড স্কাওয়েন ব্লান্ট ‘দি ফিউচার অব ইসলাম’ বইটি প্রকাশ করেন। যেখানে তিনি পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে মুসলিম বিশ্ব ইউরোপীয় শক্তি ধারা উপনিবেশায়িত হয়েছে। এবং তারা ইসলামকে ব্রিটিশ উপনিবেশের সুরক্ষা চাদরে নেয়ার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছে; এই দাবি অটোম্যানরা যতটুকু করছে তার চেয়ে ভারতীয়রা বেশি করছে।

মি. ব্লান্ট প্রথম ব্যক্তি যিনি আরবকে ইসলামের কেন্দ্রে স্থাপন করে ইসলামিক ভূগোলকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করার একটি যুক্তি নির্মাণ করেছেন। তিনি মন্তব্য করেন যে, ইস্তাম্বুল এবং তার তুর্কি সাম্রাজ্য কখনোই সত্যিকার অর্থে মুসলিম নেতৃত্ব হতে পারে না, তিনি আরব এবং ইসলামের মাতৃভূমির জন্য একটি আসন সংরক্ষিত রেখেছেন। ইস্তাম্বুল, মুসলিম শক্তির রয়ে যাওয়া একমাত্র রাজধানী, যা খেলাফতের অভিযোগে বিতাড়িত হয়েছে। এবং ইসলামিক কর্তৃপক্ষ রাজকীয় নৌবাহিনীর সুরক্ষায় আরব উপদ্বীপে প্রত্যাবর্তন করেছে।

এবং এই ব্রিটিশ লেখক আরব উপদ্বীপকে কেন্দ্র করে নতুন মুসলিম বিশ্ব গঠনের ক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন। ভারতের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী ছাড়াও দেশটির সশস্ত্র বাহিনী, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, তীর্থযাত্রীরা অটোম্যান সাম্রাজ্যের আমলেই আরবের নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং জনসংখ্যার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো।

এই সময়ে আরব ওয়াহাবি আন্দোলন ও ইবনে সৌদ’র পরিবারের শক্তির একীকরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, যা ১৯৩২ সালে আধুনিক সৌদি আরবের জন্ম দেয়।

শিল্পীর তুলিতে ১৯ শতকের হজ্বের দৃশ্য। শিল্পী: আলফ্রেড দেহদেঙ্ক

প্রাথমিকভাবে, ওয়াহাবি আন্দোলন ভারতে এবং অন্যত্র মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিলো, ওয়াহাবি-সমর্থকেরা মন্দির এবং সাধুদের সমাধি যেখানে মূর্তিপূজা করা হতো, সব ধ্বংস করে দেয়। অটোম্যানরা ওয়াহাবিদের বিদ্রোহী ঘোষণা করলে ভারতীয় মুসলমানরা আনন্দিত হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর খিলাফতের পতন এবং নতুন তুর্কি প্রজাতন্ত্র না হওয়া পর্যন্ত তারা মুসলিম নেতৃত্বে অটোম্যানদের দাবি সমর্থন করেছিল।

কিন্তু সময়ের সাথে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়, এবং আরব সমাজের বাইরে দুর্বল এবং ঔপনিবেশিক অভিজাতদের সাথে ওয়াহাবি মুসলিম সমাজগুলোকে আরও সুবিধাজনকভাবে সম্পর্কে আবদ্ধাবস্থায় দেখা যায়।

বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশরা ওয়াহাবিদের প্রশংসা করাকে নিজেদের অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিলো এবং যারা এর ভারতীয় সমর্থক ছিলো তাদেরকে ব্রিটিশদের দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের অবক্ষয় ও অন্ধবিশ্বাস দূরকারী প্রোটেস্ট্যান্ট মুসলিম হিসেবে দেখতো।

আন্দোলনের মুসলমানরা ইংরেজদের মতো চরম রক্ষণশীল এবং উদার আধুনিক উভয়েরই অন্তুর্ভূক্ত ছিলো। যুক্তিবাদীদের মতো ওয়াহাবিদেরও মধ্যেও ঐহিহ্যবাহী ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ ‘পপিস’ কর্তৃপক্ষের পতনের পক্ষপাত লক্ষ্য করা যায়। তারা মুসলিম রাজাদের পতনে ইচ্ছুক এবং আরব অরিজিনের বিশুদ্ধ ইসলামে ফিরে যেতে ইচ্ছুক।

যখন ১৯৩০-র দিকে ব্রিটিশরা ইবনে সৌদ এবং তার ওয়াহাবি সৈন্যবাহিনীকে সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন ভারতীয় মুসলমানরা সৌদি আরবের সৃষ্টিকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ছিল। এই স্বাগত জানানোর ভিত্তি ইস্তাম্বুলের মধ্যে নিহিত ছিল। অথবা এই কারণে কায়রো এবং বাগদাদের পরিবর্তে মক্কা এবং মদিনা ইসলামের কেন্দ্রে পরিণত হলো এবং তা শুধু ভৌগলিকভাবে নয় বরং আদর্শ মুসলিম সমাজের ঐতিহাসিক মডেল হিসেবে।

ইসলামের নতুন এই ভৌগোলিকতা প্রগতিশীল বা প্রোটেস্ট্যান্ট ছিলো, সেই সাথে ইস্তাম্বুলের মধ্যে রোমের পতন প্রতিবিম্বিত হচ্ছিলো। এবং যার ফলে আরবের পবিত্র শহরে জেনেভা’র কঠোরতা পরিলক্ষিত হচ্ছিলো। এর জন্মের মধ্যে, সৌদি আরবে মি. ব্লান্টের কল্পনাই দেখা যাচ্ছিলো, ইসলামের কেন্দ্র রাজকীয় নৌবাহিনী দ্বারা সুরক্ষিত হচ্ছিলো এবং  দৃঢ়ভাবেই খ্রিস্টান শিবির স্থাপিত হচ্ছিলো।

প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর ব্রিটিশ নৌবাহিনীর স্থানে আমেরিকান নেভি আসে। এবং তেল পশ্চিমা পুঁজিবাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে পরিণত হয়। কিন্তু  সৌদি আরবের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার সাথে তার ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রীয় বিরোধিতা থেকে রক্ষা করতে অনেকেই দায়ী ছিলো। যেমন, আমেরিকান ও ব্রিটিশ আর্মি এমনকি পাকিস্তানি আর্মিও। যা একে আভ্যন্তরীন স্থিতিশীলতা দেয় এবং বহিরাগত হুমকি থেকে রক্ষা করে।

আজ সৌদি আরব আপাত দৃষ্টিতে ইরানকে শাসাচ্ছে। কিন্তু এই কর্তৃত্ব দাবি সম্ভব হয়েছে মিশরের পতন এবং ইরাক ও সিরিয়া ধ্বংস হওয়ার কারণে। ইরান ব্যতিত এখন শুধু তুরস্ক তাদের প্রতিদ্বন্দী হিসেবে বহাল রয়েছে।

কিন্তু সৌদি আরবের পক্ষে একমাত্র তার ধর্মীয় অবস্থানকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক শক্তি কুক্ষিগত করা সম্ভব

 

প্রিন্স মোহাম্মদের রাজত্ব এতিহ্যগত রাজ্যের চেয়ে অনেক বেশি সেক্যুলার রাজ্য মনে হতো যার সার্বভৌমত্ব শেষ পর্যন্ত রাজতন্ত্রের অভিযোগে জাতি এবং যাজকের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত হয়। কিন্তু সৌদি আরবের পক্ষে একমাত্র তার ধর্মীয় অবস্থানকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক শক্তি কুক্ষিগত করা সম্ভব, এক্ষেত্রে অবশ্যই ভূ-রাজনীতিকে তার প্রান্তীয় বৈশিষ্ট্য দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

যদি স্বৈরাচারী শাসকেরা ইসলামের ভূগোলকে অধিনতা’র অর্থ হিসেবে দাঁড় করায়, তাহলে সেক্যুলারদের কাছে ধর্মীয় অধিনতা’র মানে কি হবে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, অটোম্যানদের পরাজয়ের ফলে পরোক্ষ ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রণে ইসলামের পবিত্র শহরগুলি স্থাপন করা হয়, তখন মুসলিম চিন্তাবিদেরা ভ্যাটিকানের মডেলের ভিত্তিতে মক্কা ও মদিনাকে রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ করার বা বিশ্বের মুসলমানদের নামে তাদের আন্তর্জাতিকীকরণের ধারণা নিয়ে বিতর্ক করছিলেন। ইরান এখনো পবিত্র শহরকে সৌদির কবল থেকে কেঁড়ে আনতে আধুনিক পদ্ধতিটি আরোপ করে।

সৌদি আরবকে ধর্মীয় রাষ্ট্রের পরিবর্তে রাজনৈতিক রাষ্ট্র হিসেবে নির্মাণ করার প্রকল্পটি শতবর্ষী ইসলামিক ভূগোলের স্বপ্নকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার মতো। যা সব সময় আরবকে তার অরাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে প্রমাণে কাজ করে।

মক্কা এবং মদিনা এখনো তীর্থযাত্রী পাবে, কিন্তু ইসলাম অবশেষে সত্যিকার একটি বৈশ্বিক কাঠামো ধারণ করবে এবং ঔপনিবেশিক মানচিত্রাঙ্কনবিদ্যার সাথে মানিয়ে নেবে, এই ভাবনা মধ্যপ্রাচ্যকে গর্বিত করে থাকে, যদিও তারা মুসলিম বিশ্বের খুব কম সংখ্যক জনগোষ্ঠীর ধারক।

ইসলাম অবধারিতভাবে এশিয়ায় তার নিজস্ব ভিটে খুঁজে পাবে, যেখানে এখন পর্যন্ত তার সবচেয়ে বেশি অনুসারী বাস করে, এবং যার বৈশ্বিক সম্পদ এবং শক্তি ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনশীলতার অভিমুখী।