একটা পুরোনো গল্প দিয়েই শুরু করি। এক রাজ্যে এক কবিরাজ ছিল। নামে কবিরাজ হলেও কর্মে তিনি তেমন কিছুই ছিলেন না। ঔষধই বানাতে জানতেন একটি, যা পেটে পড়া মাত্রই সিস্টেম অটো। ছোট রাজ্য, যার ফলে এই দিয়েই বেশ নাম ডাক হল। তো, একদিন প্রতিপক্ষের এক রাজা বিশাল সৈন্য সমেত সে রাজ্য আক্রমন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে ছোট রাজ্যের সে রাজা শরণাপন্ন হলেন ঐ কবিরাজের। এমন এক ঔষধের আবদার করলেন, যাতে তার সৈন্যরা মহান বলে বলিয়ান হয়ে শত্রু পক্ষকে নাস্তানাবুদ করতে পারে। এ কথা শুনে কবিরাজ তো প্রমোদ গুণলেন। পারেনই তো একটা ঔষধ বানাতে, সে দিয়ে কি আর যুদ্ধ জয় করা যায়?
মাওলার নাম নিয়ে সে ঔষধই রাজাকে দিলেন সৈন্যদের খাওয়ানোর জন্য। ঔষধ পেটে পড়ার পর আর যায় কোথায়? সৈন্যরা এক জন মাওলার ডাকে ডাক দিয়ে বাথরুমে ঢুকে বের হয়, তো আরেকজন ঢুকে। এরকম চলল সারাদিন। এই অবস্থা দেখে প্রতিপক্ষের সেনাপতি গেল ঘাবড়িয়ে। রাজাকে বলল, প্রভু তাদের যে সৈন্য সংখ্যা দেখছি, তাতে এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় আমাদের কম্ম নয়, চলুন সন্ধি প্রস্তাব করি। কবিরাজের ‘মহান’ কর্মে স্বল্প সৈন্য নিয়েও রাজত্ব রক্ষায় সক্ষম হয়ে রাজা তো যারপনাই খুশি। কবিরাজের নাম জশও বাড়তে লাগল হু হু করে।
খেলার পাতায় কবিরাজকে কেন টেনে আনলাম এবার আসি সে ঘটনায়। বাংলাদেশের টেলিভিশনে ধারাভাষ্যের বিষয়টির বয়স খুব একটি বেশি না। তো, পয়লা এমন একজনকে কর্তাদের মনে ধরল যিনি স্বাভাবিক ভাবে নিজের নামটাও উচ্চারণ করতে পারেন না। তার কাপা কণ্ঠ কর্তাদের সেই কবিরাজের মতনই মুগ্ধ করল। যার ফলে চাকরি পাকা। এখন আদমির পেটে জ্ঞানের বহর কতটা তা ঠাহর করতে গিয়েছে কে? যার ফলে, মেঘমুক্ত মাঠ; কর্দমাক্ত আকাশের মতন মহান বাণী শুনলাম আমরা। তাতে, কর্তাদের মোহ তো কাটলই না, বরং তার অদ্ভুদ উপমাকে কবিদের জন্য শিক্ষণীয় ঠাওর করে ক্রিকেটই না, ফুটবল, হ্যান্ডবল, বাস্কেটবলসহ সমস্ত খেলার ধারাভাষ্যে তার নিয়োগ নিশ্চিত হলো।
যার ফলে লেগ সাইডে অসাধারণ কাভার ড্রাইভ কিংবা অফ সাইডে দুর্দান্ত ফ্লিকের মত কাল্পনিক কিছু শটের বয়ান শুনেছি আমরা। ক্রিকেটের আইন প্রনয়ণকারী সংস্থা এমসিসি থেকে শুরু করে সদ্য ক্রিকেট শিখছে, এমন যে কেউ বিষম খাবে লেগ সাইডে কাভার ড্রাইভ কি করে করা যায় সেটি ভেবে। আপনি একবার ভাবুন তো কেভিন পিটাসরেন ফুটবল ভাষ্যকার হিসাবে ধারাভাষ্য দিচ্ছে কিংবা ওয়েইন রুনি ক্রিকেটের! দূরহতম কল্পনাতেও এটা সম্ভব না। কিন্তু ঐ যে, গলা কাপানোর যে বিরল যোগ্যতায় কর্তা মুগ্ধ হয়েছে, তাতে ভদ্দরলোক শুধু ক্রিকেট ফুটবলই না হ্যান্ডবলেও বিশেষজ্ঞ হয়ে বসে রয়েছেন! ধরাধমে এতটা যোগ্যতা সম্পন্য আদমি দ্বিতীয়টা নেই।
আরেক যন্ত্রণাদায়ক চরিত্রের দেখা মিলে বাংলাদেশের হোম সিরিজে। উপরোক্ত ব্যক্তির মতন তিনিও গলা কাপিয়েই কর্তাদের মুগ্ধ করেছেন, তা ক্রিকেটে তার জ্ঞান যতটুকুই হোক। এতদিন ধারাভাষ্য দেয়ার পরেও আদমি রেডিও-এবং টেলিভিশনের ধারাভাষ্যের মধ্যকার ফারাক টুকু বুঝে উঠতে পারেননি। তার আদর্শের মূল যোগ্যতা যদি হয়, গলা কাঁপানো তিনি বাড়তি হিসাবে যোগ করেছেন বিচিত্র ভঙ্গিমায় ইংলিশ বয়ান করা। সোজা একটি বলে ব্যাটসম্যান লিভ দিলেও তিনি যে স্বরে চিৎকার করে উঠেন, তাতে আপনি যদি মুহুর্তের জন্য টিভি থেকে চোখ সড়িয়ে নিয়ে থাকেন, আপনার মনে হতে বাধ্য যে, মাঠে কোনো বিশাল প্রলয় ঘটে গিয়েছে। তিনি আবার গুরুকে ছাড়ানোর প্রয়াশ হিসাবে প্রায়শই সতীর্থ ভাষ্যকারকে বাংলা নসিহত করে থাকেন। আমার খুঁব ইচ্ছে একদিন তারে পিচ রিপোর্ট করতে দেখা। তাহলেই, জাড়িজুড়ি ফাঁস হয়ে যেত। তবে, বান্দাও কম সেয়ান না, কর্তাকে ঘোল খাইয়ে যিনি কর্ম বাগিয়ে নিতে পারেন এই ভুল করে নিজের ‘ক্যারিয়ার’ যা সাধারণের জন্য বিরক্তির শেষ সীমা সেটা তিনি শেষ করবেন বলে মনে করার কোনো কারণই নেই। বিদেশে কোনো সিরিজ হলে, তাকে ডাকা তো দূর; তার নামটাও কেউ নেয় না। যদি নূন্যতম বোধ থাকত তাহলে তিনি নিজেই সরে দাড়াতেন। পরিতাপের হলেও সত্য যে বেবোধের সংখ্যা আমাদের সমাজে বড্ড বেশি।
টেলিভিশন থেকে মুক্তি খুঁজতে রেডিওতে যাবেন, রক্ষা নাই। সেইখানেই অপেক্ষায় রয়েছে আরেক ‘শ’। উপরোক্ত দুই বান্দা তো বাংলা এবং ইংলিশের ইজ্জতের ফালুদা করার প্রয়াশে ব্রত। এই আদমি আবার আরো এক কাঠি ওপরে। তিনি বাংলা এবং ইংলিশের এমন জগা খিচুড়িই পাকাইছেন, যার মর্মার্থ না বাংলার অধ্যাপক না ইংলিশের অধ্যাপকের পক্ষে উদ্ধার করা সম্ভব! তাহলে, সাধারণ, দর্শক; যাদের আমরা আম জনতা বলে থাকি তাদের হালতটা চিন্তা করেন।
এখন এই তিন আদমির হালত হয়েছে সেই কবিরাজের মতন, আর কর্তাদের রাজার মতন। এমন চাবায়া বাংলা বলাকে কর্তা মশাইয়ের কাছে ঠেকেছে বিশেষ গুণ। আরেক জন যখন ইংলিশে বিষম খান তখন বাংলার এক আজগুবি অর্থ দাঁড় করানোকে তার কর্তা ভেবেছেন এমন আদমি তো বিরল। আর শেষ জনেরটা তো লা জাওয়াব। না পারে বাংলা, না পারে ইংলিশ! এমন আদমিই বা কয়জন আছে?
বর্তমান বাস্তবতায় ধারাভাষ্য খেলার অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় চমৎকার দখল রাখেন এমন আদমির সংখ্যা নেহায়েত কম না। তারপরেও শত সমালোচনার পরেও কেন বারবার এদেরই ডাকা হয়, এ প্রশ্ন সাধারণে বহুদিন ধরেই। আরো এক আপদ খেলার বিরতিতে আলোচনা অনুষ্ঠান। এখানে উপস্থাপিকা হবার মানদণ্ড অবশ্য সহজ। হাটুর যত উপরে কাপড় তুলতে পারবেন, আপনার নোকরি ততই নিশ্চিত। যার ফলে এশিয়া কাপের ফাইনালের দিন আমাদের শুনতে হয়েছে, বিশ্বকাপ জেতার জন্য ভারতকে ২২৩ রানের টার্গেট দিয়েছে বাংলাদেশ! মোদ্দা কথা ক্রিকেট সম্পর্কে জ্ঞানের প্রয়োজনই নেই, হাতুট ওপর কাপর তুলে দাত বত্রিশটা রোদ্রে শুকাতে দেন স্বল্প বসনে, আপনাকে সড়ায় সাধ্যি কার?
সামনে জিম্বাবুয়ে সিরিজ যেহেতু নিজেদের মাঠে, তাই এই জ্বালাতন যে সহ্য করা লাগবে এটা নিশ্চিত। পরিতাপের বিষয় হল, সঠিক জ্ঞান রাখা আদমিদের বদলে কর্তারা বেছে নিয়েছেন সেই কবিরাজকে যার দৌড় গলা কাপানো পর্যন্তই! আর এর জের টানছি আমরা, সাধারণ সমর্থকরা। মজার বিষয় হলো, এদের প্রত্যেকের নামের অদ্যাক্ষরই ‘শ’।