প্রথমে বলে রাখি যারা ক্লাসিক পাঠক নন, মানে যারা একটু ধীর-স্থিরভাবে বই পড়তে চান না তারা এটা না পড়লে ভালো হয়। কারণ এটা মূলত পামুকের শৈশবের স্মৃতিকথা। এবং তার জন্মস্থান ইস্তাম্বুল শহরের ঐতিহাসিক দলিল বলা যায়। এই ভাবেও যে একটি শহরের স্মৃতি লেখা যায় তা এই বই না পড়লে আমরা বুঝতেই পারতাম না।
আসলে একজন সাধারণ মানুষের শৈশব যেমনটা হয় আরকি পামুকেরও তেমনই কেটেছে। যেহেতু মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন তাই তার শৈশব এবং বেড়ে উঠার দিনলিপি নিয়ে আমি অতোটা আগ্রহী ছিলাম না প্রথমে। কারণ সেটা তেমন চিত্তাকর্ষক কিছু হবে বলে মনে হয়নি। কিন্তু এই বই এর মূল মজাটা হলো ইস্তাম্বুল এর ইতিহাস, তার বিষণ্নতা, তার মানুষজন, দোকানপাট, তার সাহিত্য, গোড়াপত্তনের ইতিহাস, নদীগুলোর বহমান ঢেউয়ের চিত্র -এইসব কিছুই পামুক যে নান্দনিকতায় এই বই এ হাজির করেছেন সেটা সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে। পামুক এই শহরের ইতিহাসের সাথে তার শৈশবের মেলবন্ধন করে যে ন্যারেটিভ তৈরি করেছেন। যে মনোমুগ্ধকর ভঙ্গিতে হাজির করেছেন এটাই বইটাকে সুখপাঠ্য করেছে। এখান থেকে আমরা জানতে পারি একটি বিরাট শহর কিভাবে বিষন্নতাকে শিল্পের চাদরে মুড়িয়ে নিয়েছে। কিভাবে বিষণ্নতা পুরো একটি শহরের বাসিন্দাদের তার জালে জড়িয়ে দিব্যি যুগের পর যুগ পার করে চলেছে। এই বিষণ্নতার নানান রূপ, রং বৈচিত্র্য এবং এটা কিভাবে তাদের সাহিত্যে শিল্পে স্থান করে নিয়েছে তা জানতে পারি ৷ হুজুন বা বিষণ্নতা নিয়ে বেশ ক্লাসিক একটা আলাপ করেছেন পামুক তার ইস্তাম্বুল: একটি শহরের স্মৃতিচারণ বইতে। আমরা বিষণ্নতাকে আধুনিকতার একটা ব্যারাম বলে ডিফাইন করে থাকি। বিশেষ করে আমি এটা করতাম। কারণ, বিষণ্নতা ঠিক এই অর্থে আধুনিক প্রজন্মের মাঝেই আমরা দেখি। তারপর এটা থেকে ড্রাগস, ইয়াবা, ফেন্সিডিল হিরোইন বা লালনের গান শুনে শুনে গাঁজা সেবন এইদিকেও যায়। মানে প্রবণতাটা এমনই মোটাদাগে।
কিন্তু পামুক এইখানে যে আলাপটা পেশ করছেন তাতে বিষণ্নতা ব্যাপারটা বেশ নান্দনিক একটা রূপ পাই। পামুক বলতেছেন ইস্তাম্বুলের চারজন বিষাদগ্রস্থ লেখকই তাদের কবিতা গল্পে লেখায় ইস্তাম্বুলের ইতিহাসকে একটা নান্দনিক উপায়ে হাজির করছেন। একজনের নাম কোকো আর তিনজনের নাম মনে আসতেছেনা। আবার উনি এটার সাথে সুফি ধারার নান্দনিক যোগাযোগটাও অল্প পরিসরে দেখাতে চাইলেন। বেশ ইন্টারেস্টিং একটা আলাপ আছে এইখানে। লেখক মূলত সুফিবাদের মধ্যে যে হুজুন/বিষাদ এর উপস্থিতি, ঐটাকে বেশ পবিত্র বলে উল্লেখ করছেন। অর্থাৎ তারা এটার মাধ্যমে ঈশ্বরের দিদার লাভের সেতু মজবুত করতে চেষ্টা করেন। এর বাইরে উনি আরো বলতেছেন ইস্তাম্বুলের শিল্প সংগীত চিত্রকলা এমনকি মানব জীবনেও হুজুন’র বেশ উপস্থিতি আছে। সব ইস্তাম্বুলিয়ান জন্মসূত্রে তার ধ্বসে যাওয়া বীরত্বপূর্ণ ইস্তাম্বুলের অদৃশ্য হাহাকার সাথে নিয়ে আসে দুনিয়াতে আর পরবর্তী জীবনে তাদের উপর এটার প্রভাব ব্যাপক হতে থাকে। অর্থাৎ তারা রাস্তা ঘাট সেতু কালভার্ট কফি হাউস সবকিছুতে এর ছোঁয়া আছে আর একজন মানুষ এসবের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে হুজুনে নিমজ্জিত হয়। ইস্তাম্বুল যদিও দেখা হয়নি তবে চোখ বন্ধ করে ব্যাপারটা কল্পনা করলেও একটু হলেও অনুভব করা সম্ভব হয়। এখানে পামুক আরো ব্যাপক ইতিহাস টানছেন ঐগুলো গুছিয়ে লিখতে আরও বড় লেখা দরকার। এখানে সংক্ষেপে নিজের পাঠ মুগ্ধতা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি। আমি চাচ্ছি আগ্রহী পাঠক যেন এই ব্যাপারে নিজেই খোজ-খবর করেন।
হুজুন বা বিষণ্নতা আরও কোন শহরের জীবনিতে আরও কোন দেশের কালচারে, সৃষ্টিতে, শিল্পে সমানভাবে ক্রিয়াশীল কিনা এই ব্যাপারেও গবেষণা হতে পারে। একটা ব্যাথা, দুঃখবোধ এইসব ঠিক মনে আর মাথায় ক্রিয়াশীল না হলে গানের সুরে, পেইন্টিং, কবিতায় ঠিক নির্যাসটা বা আবেগটা আসেনা। কিন্তু আমরা কি এইসবের পেছনে যে বিষণ্নতার ইতিহাস আছে তা মনে রাখি? এটার সাইকোলজিক্যাল ব্যাখ্যা কি হইতে পারে- তা নিয়েও ভাবা যায়।
জগজিৎ সিংয়ের গজলের ভক্ত আমরা অনেকেই। এই সুন্দর বিষণ্নতা আমাদের মনকে স্পর্শ করে। কয়েকদিন আগে, পাকিস্তানের একটা ট্রিবিউট প্রোগ্রাম ইন্টারনেটে দেখতেছিলাম। অনেক পুরনো অনুষ্ঠান সেটা। ফারিহা পারভেজ গাইতেছিলেন। তো ঐখানে নতুন যে কথাটা শুনলাম সেটা হলো, জগজিৎ এর একটা যুবক ছেলে সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যায়। আর তারপর তার স্ত্রী চিত্রা সিং ও একসাথে গাইতে শুরু করেন। প্রথম গজল ছিলো “হোটো সে চু লও তুম, মেরা গীত আমার কর দো”। এটা এভারগ্রিন ক্লাসিক হয়ে আছে তারপর একে একে সব কালজয়ী গজল জগজিৎ গাইলেন। তার সমস্ত আবেগ দিয়ে। তাহলে হুজুনের এই দিকটা কি আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভাবে নিতে পারি?
যাক বইটার আলোচনায় ফিরি, এটা ছাড়া এই বইয়ে আরেকটা ইনটারেস্টিং যে ব্যাপার পামুক বারবার তুলে ধরেছেন সেটা হলো- পশ্চিমী সভ্যতার অনুকরণ কিভাবে একটি পুরো শহর, তার ঐতিহ্য, হেরিটেজ, মানুষের মন ও মগজকে নড়বড়ে করে তাদের নিজেদের অস্তিত্বকে শেষ করে দিয়েছে। যদিও অনেকেই তাকে পশ্চিমা ঘেঁষা বলে অভিযোগ করেন, তার নোবেল প্রাপ্তিও এটার কল্যাণে হয়েছে বলে মনে করেন। আমি তাদের অনুরোধ করবো এই বইটা পড়ার জন্য। এখানে পামুক একটা ব্যাপার স্পষ্ট করতে চেয়েছেন যে, পশ্চিমের সভ্যতা কেবল তার নিজের জন্য ঠিক আছে। এটার অন্ধ এডাপ্টেশন অন্যের জন্য কোনভাবেই মঙ্গলজনক কিছু হতে পারেনা। আরো দীর্ঘ বক্তব্য হয়তো দেওয়া যায় কিন্তু আমি এটা আপাতত এইখানে সংক্ষিপ্ত রাখলাম।
সব মিলিয়ে এই বইয়ের মধ্য দিয়ে আপনি দেখবেন পামুকের চোখে ঐতিহাসিক একটা শহরের ইতিহাস। এই জার্নি আনন্দের, ভালোলাগার, বিষন্নতার, দারুণ এক অনুভূতি দিয়ে যাবে আপনাকে।