ফুটবলাররা পায়ের জাদুতে মুগ্ধ করেছেন পুরো দুনিয়াকে। কেউ এক পায়ে আবার কেউ বা দুই পায়ে সমান তালে কম্পন তুলেছিলেন সবুজ গালিচায়। ফুটবলের সৌন্দর্য বলতে আমরা ঐ দুই পায়ের জাদুকেই বুঝি। কিন্তু ঐ দুই পায়ের জাদু ছাড়াও গ্লাভস হাতে গোলবার সামলানোতে দুই হাতের জাদুর ছোঁয়ায় বিশ্বসেরা হয়েছেন সংখ্যায় খুব কমই আছেন। আগে ঐ যুগের কিছু কিংবদন্তির কথা বলি, ঐ যুগে মাইকেল বালাক, রিবালদো, রোনালদো, লুইস ফিগোদের মত বিশ্বসেরাদের ছাপিয়ে একজন গোলকিপার হয়ে নিজেকে সেরা প্রমাণ করা সত্যি অসাধ্য সাধন করার মতই ছিল। রোনালদো-রিবালদোরা যখন ব্রাজিলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ম্যাচপ্রতি গোল করে। তখন অলিভার কান জার্মানিকে বয়ে নিচ্ছিলেন গোল ঠেকিয়ে! ম্যাচের পর ম্যাচ গোল ঠেকিয়েই ২০০২ বিশ্বকাপে গড়েছেন ইতিহাস। গোল্ডেন বলজয়ী প্রথম ও একমাত্র গোলকিপার! গোলবারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চীনের প্রাচীর অলিভার কানের কথাই বলছি। একমাত্র গোলরক্ষক হিসেবে গোল্ডেন বল জয়ের পাশাপাশি একই বছর ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে হয়েছিলেন দ্বিতীয়। ফিফার সাথে অলিভার কানের সদ্য এই কথোপকথনটি জবানের পাঠকদের জন্যে অনুবাদ করে দেয়া হল :
একজন বিশ্বসেরা গোলরক্ষকের প্রধান কাজ কি?
অলিভার কান : গোলরক্ষকের কাজ হচ্ছে বিপজ্জনক মুহূর্তে গোল রক্ষা করে তার দলকে সাহায্য করা। আমি মনে করি এটাই গোলকিপারের প্রধান কাজ। কিন্ত এখন ফুটবলে এই ধরণের গোলরক্ষকের অভাব রয়েছে। এখন দেখা যায় সবাই পায়ের দক্ষতার ওপর নজর বেশি দেয়। হ্যাঁ গোলরক্ষকের জন্যে এটা গুরুত্বপূর্ণ; কিন্ত গোলকিপারের প্রধান কাজ গোলবার রক্ষা করা এবং এটাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
সেরা হওয়া বেশি কঠিন নাকি শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট রক্ষা করা কঠিন?
সেরা হওয়ার পথে আপনাকে অনেক ত্যাগ করতে হয়। আমি কখনো ত্যাগ করতে কার্পন্য করি নাই। বরং এটা ছিল আমার কাছে একইসাথে প্রেরণা এবং একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্ত শীর্ষে থাকা অনেক কঠিন। কারণ যখনই আপনি শীর্ষে অবস্থান করেন, আপনার কাছে সকলের আশা বাড়তে থাকে এবং আপনি নিজেও নিজের কাছে আরও বেশি প্রত্যাশা করেন। এমন সময় আসবে যখন আপনি আর শুধু ভালো প্রদর্শন করেই সন্তষ্ট থাকবেন না। আরও ভালো করতে চাইবেন।
‘আইএফএইচএইচএস‘ তিনবার আপনাকে সেরা গোলকিপার হিসেবে নির্ধারণ করেন। এটা আপনার জন্যে ইতিবাচক ছিল নাকি নেতিবাচক?
অবশ্যই ইতিবাচক। নিজেকে প্রেরণা যোগাতে সবসময়ই পরিবর্তন দরকার। এবং আমি যখন মাঠে নামতাম তখন আমি প্রতিজ্ঞা করে নামতাম, ‘দেখো আমিই বিশ্বসেরা গোলকিপার’।
তাহলে আপনার কখনো কোন পিছুটান ছিলনা?
একজন খেলোয়াড় হিসেবে আপনার সবচেয়ে বড় লড়াই আপনার নিজের সাথেই। হ্যাঁ, অবশ্যই এমন অনেক সময় ছিল যখন আমি চাইতাম নিজেকে আড়াল করে রাখতে, মাঠে না নামতে। মাঝে মাঝে বিশ্বের সেরা গোলকিপারের তকমাটা অনেক ভারী হয়ে যেত।
যেমন?
এই যেমন, ১৯৯৯ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল ম্যাচে আমরা অতিরিক্ত সময়ে হেরে যাই। এটা ছিল আমরা জন্যে সবচেয়ে কঠিন সময় কারণ আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কষ্টদায়ক পরাজয় ছিল। এবং আরেকটা ঘটনা হচ্ছে ২০০৬ বিশ্বকাপ। যখন লেহমানের সাথে আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় লেহমান আমাকে অতিক্রম করে প্রথম হওয়ার লড়াই জিতে যায়।
২০০২ সালের ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অব দ্য ইয়ারে আপনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এটা নিশ্চয়ই আপনার কাছে অনেক বড় পাওয়া ছিল?
পেশাদার ফুটবল নিরলসভাবে চলতে থাকে। তাই আপনার খুব একটা সময় থাকেনা এটা নিয়ে ভাবার। কিন্ত যখন আমি খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানলাম, তখন আমি সময় পেলাম আমার অর্জন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার। একজন গোলরক্ষক হিসেবে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়া এবং তারপর সেরা খেলোয়াড় হিসেবে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করা, আমার জন্য অনেক বড় কিছু ছিল। যদিও একজন বায়ার্ন খেলোয়াড় হিসেবে কোন কিছুতে দ্বিতীয় হওয়া দুঃখজনক। কিন্ত আমি আসলেই অনেক খুশি ছিলাম দ্বিতীয় হয়েও। (হাসি)
এই মুহুর্তে সেরা গোলরক্ষক হিসেবে কাকে বেছে নিবেন?
কেইলর নাভাস রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। তবে বিশ্বকাপের বছর হিসেবে কর্তোয়ার কথা বলতে হবে। বিশ্বকাপে কর্তোয়া ধারাবাহিক ছিল। এবং হুগো লরিস ও ভালো খেলেছে এবং তার দলকে শীর্ষে নিয়ে যায়। কিন্ত আমার সবচেয়ে মনে থাকবে ক্যাসপার শেমাইকেলের কথা। ক্রোয়েশিয়ার সাথে শেষ মুহুর্তের পেনাল্টি ছাড়াও আরও দুইটি স্পট কিক আঁটকে দেয়। এবং এটাই হচ্ছে একজন গোলকিপারের খেলা।
এবং সেরা খেলোয়াড়?
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অসাধারণ ছিল। মেসি কোন বড় শিরোপা জয় করতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং বিশ্বকাপেও নিজের নামের প্রতি সুবিচার করেননি। কিন্ত এবারের ক্রোয়েশিয়া ছিল জাদুর বাক্স। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ে লুকা মদ্রিচের ভূমিকা ছিল সবিশেষ উল্লেখযোগ্য এবং তার রাশিয়া অভিযান ছিল চমকপ্রদ। তাই সেরা খেলোয়াড় হিসেবে মদ্রিচের কথাই বলতে হয়।
আপনি সব সময় নিজেকে সেরা হওয়ার জন্যে তাগাদা দিয়েছেন। এই সেরা হওয়ার মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যাওয়া কি কঠিন হয়ে পড়েছিল?
একজন পেশাদার খেলোয়াড়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সাধারণ জীবনে ফিরে যাওয়া। মনে হবে যেন আপনি উজ্জ্বল আলোয় বসে আছেন এবং হঠাৎ কেউ সব আলো বন্ধ করে দিল; আপনি অন্ধকারে ডুবে গেলেন। যে জিনিসটা আপনার জীবনকে আকার দিয়েছিল, আকস্মাৎ সেটা নাই হয়ে গেলে আপনার জীবন শূণ্য মনে হবে। কিন্ত আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে নেওয়ার একটা রাস্তা সহজেই বের করে নিয়েছিলাম। আজকে আমি নিজেকে একজন ফুটবল উদ্যোক্তা হিসেবে দেখি।
এখনো কি সেরা হওয়ার তাগিদ দেন নিজেকে?
এখন লক্ষ একটাই, ব্যবসায় সফল হওয়া। এখন আর এটা সেরা হওয়ার লড়াই না। এখন সবার সাথে কাজ করাই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা আনন্দদায়ক।