একজন পারভেজ ও মাতলুব মাস্টার

একজন পারভেজ ও মাতলুব মাস্টার

-বাবা, একজন ভদ্রলোক এসেছেন তোমার সাথে দেখা করতে।

– কে?

– যিনি তোমাকে তার নিজের কিডনি দিয়েছেন, তিনি। তুমি কেমন আছো দেখতে এসেছেন।

– তা এ কথা আগে বলিস নি কেনো? চল চল। ঠিক মত বসতে দিয়েছিস? খেতে দিয়েছিস কিছু? বলি, কতক্ষন বসিয়ে রেখেছিস মানুষটিকে?

– ঠাণ্ডা হও বাবা। সবই দেয়া হয়েছে। উনি এসেছেন বেশ কিছুক্ষণ হচ্ছে। তুমি ঘুমোচ্ছিলে বলে ডাকিনি।

– দেখো দেখি কাণ্ড। চল চল।

দ্রুত তৈরি হয়ে নেন মাতলুব মাস্টার। শহরে একনামে তাকে চেনে সবাই। কিছুদিন আগেই কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে উনার। কিডনি দিয়ে যিনি মাতলুব মাস্টারের জীবন বাঁচিয়েছেন আজ তিনি এসেছেন দেখা করতে। সুস্থ হবার পর থেকেই মাতলুব মাস্টার ভদ্রলোকের পরিচয় জানতে ব্যাকুল হয়ে আছেন। কোনো এক অজানা কারণে কেউই তাকে সে মহৎ ব্যক্তির পরিচয়টি জানায়নি।

হন্তদন্ত হয়ে বসবার ঘরে ঢুকলেন তিনি। ঢুকেই যে মুখটি দেখলেন সেটি তিনি আশা করেননি। তারই এক সাবেক ছাত্র বসা। পারভেজ। শহরের অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী।

– আসসালামুআলাইকুম স্যার

– ওয়ালাইকুম সালাম। তাহলে তুইই আমাকে কিডনি দিয়ে বাঁচিয়েছিস? আমি যদি জানতাম…

– আমি সেই মানুষ, তাহলে কিডনিটা নিতেন না, তাই না স্যার? (মাতলুব মাস্টার কে কথা শেষ করতে দেয় না পারভেজ) আমি সেটি জানি স্যার। আমি শেষবারের মত আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি স্যার। যাবার আগে কিছু কথা বলে যেতে চাই।

মাতলুব মাস্টারের ভেতরে একটি অদ্ভূত অনুভুতির সৃষ্টি হয়। নীতিবান হিসেবে উনার শহরব্যাপী খ্যাতি রয়েছে। কত বড় বড় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার উনার ছাত্র। তাদের কথা বলতেও গর্বে বুকটা ফুলে উঠে। সেখানে এ পারভেজ, কর্মের জন্য তিনি যার মুখ পর্যন্ত দেখতেন না, তার কিডনি দিয়ে…. বড় অশান্তি হতে থাকে। গলার স্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন তিনি। ইশারায় পারভেজকে বসতে বলেন।

– বল

– আমি কেমন ছাত্র ছিলাম তা তো আপনি জানেন স্যার। পড়াশোনা বিষয়টি আমার মাথায় তেমন ঢুকতো না। সে হাইস্কুলের সময়ই আপনি গাঁ ছেড়ে শহরের স্কুলে চলে এলেন স্যার। আমারও পড়াশোনা ওখানেই শেষ হয়ে যায়। বাবা তো সেই ছোটবেলায়ই মাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলো। সংসার বলতে, আমি আর মা। স্কুল ছেড়ে আমি লেগে গেলাম মুদির দোকানে।

কথাটা শেষ করে একটু দম নেয় পারভেজ। সামনে রাখা পানির গ্লাসটা থেকে দু’ঢোক পানি খায়।

– তারপর?

– দিন যে খুব খারাপ যাচ্ছিল তা বলবো না স্যার। মাকে কাজ থেকে ছাড়িয়েও এনেছিলাম। দু’জন মানুষের সংসার। কতটুকুই আর জিনিস লাগে?

– তা এ পথে এলি কেনো?

– বলছি স্যার। হঠাৎ করেই নিয়মিত মায়ের শরীর খারাপ হতে শুরু করলো। প্রথমে ভেবেছিলাম বয়েস হয়েছে তাই বোধহয় এমন হচ্ছে। কিন্তু অবস্থা আরো খারাপ হতে শুরূ করলে একদিন রনেনের কাছে নিয়ে গেলাম। রনেনকে তো আপনার মনে আছে স্যার।

– হুম

– সব দেখেটেখে বললো অবস্থা বিশেষ ভালো না। একজন ডাক্তারের নাম বলে বললো উনাকে দেখাতে। মাকে নিয়ে উনার কাছে গেলাম। বেশ কিছু টেস্ট করতে দিলেন। মুদি দোকানের চাকরি, বুঝেনই তো স্যার। এসব করতে গিয়ে বেশ কিছু ঋণও করে ফেললাম। সব দেখে শুনে উনি বললেন মায়ের ব্লাড ক্যান্সার।

– তারপর

– তারপর? (চোখ ভিজে আসে পারভেজের) বসত ভিটে ছাড়া আর তো কোনো জায়গা জমি ছিলো না যে বিক্রি করবো। দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছি স্যার টাকার জন্য। যত বন্ধু-বান্ধব ছিলো সবার কাছে গিয়েছি। কেউ সাহায্য করেনি স্যার। যে দুয়েক জন করেছে সেটিও না করার মতো। আপনার আতিকের কথা মনে আছে স্যার?

– খুব মনে আছে। ওতো এখন বিশাল ব্যাবসায়ী

– জ্বী স্যার। খুব আশা নিয়ে আতিকের কাছে গিয়েছিলাম। সব শুনেটুনে পাঁচশ টাকা দিয়ে বলেছিলো ব্যাবসা নাকি খারাপ যাচ্ছে। তাই এর বেশি দিতে পারবে না। সে টাকাটা ওখানেই ফেলে চলে এসেছিলাম স্যার।

– তোর মা?

– আমার হাতের উপরেই মারা গিয়েছে স্যার। হতভাগা আমি বিনা চিকিৎসায় মাকে মরতে দেখেছি। (শত চেষ্টায়ও চোখের পানি আটকাতে পারে না পারভেজ) আমি জানি স্যার আপনার সব ছাত্রদের মধ্যে আমি সবচেয়ে খারাপ। আপনি আমার মুখের দিকেও তাকান না। কিন্তু যখনই শুনলাম আপনার অসুখের কথা, নিজেকে আটকাতে পারিনি। আপনিই ছোটবেলায় শিখিয়েছিলেন শিক্ষক পিতার সমান। চোখের সামনে মাকে ছটফট করে মরতে দেখেছি স্যার। মাকে তো পারিনি, তাই বাবাকে বাঁচাতে ছুটে গিয়েছিলাম। আজ আপনাকে দেখে বড় ভালো লাগছে স্যার। আপনি আমাকে ঘৃণা করুন স্যার। যার পুরো জীবনটাই পাপে ভরা তার জন্য ঘৃণা ছাড়া আর কি থাকবে? (একটু থেমে দম নেয় পারভেজ)। দেনার পাহাড় জমে গিয়েছিলো স্যার। কোনো রাস্তা দেখছিলাম না সামনে। অসহ্য এক ক্ষোভ, ঘৃণা জমে গিয়েছিলো সব কিছুর প্রতি। তাই এ রাস্তায় নামা।

বোবা কান্নায় চোখ বুজে আসে মাতলুব মাস্টারের। কত কি মনে পড়ে যায়। কি শিক্ষা দিলেন তিনি? যে তিনি নিজে না খেয়ে মানুষকে খাওয়ান তার ছাত্ররা এমন অমানুষ হয়েছে? অথচ কত গর্ব করেই না আতিকের কথা বলতেন তিনি। হঠাৎই নিজেকে বড় অসহায় মনে হতে থাকে। চোখ খুলে দেখেন পারভেজ নেই। নিঃশব্দে চলে গিয়েছে।

সেদিন রাতেই থানায় আত্মসমর্পণ করে পারভেজ। বিচারে সাজাও হয়েছে তার। জেলের বন্দি শেলের মাঝেই এক অপার্থিব সুখ খুজে পায় সে।

মাতলুব মাস্টার পারভেজের সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করেন। যে সব তথ্য পান তা উনাকে চমকে দেয়। পারভেজ অকাতরে গরিবদের টাকা বিলাতো। অনেকটা রবিন হুডের মতো। পারভেজের দরজা থেকে কেউ কোনোদিন খালি হাতে ফেরেনি। ভাবনার সাগরে ডুবে যান মাতলুব মাষ্টার। মুখোশ পরা মানুষগুলো সমাজের চোখে সফল। আর এ মানুষগুলোই জন্ম দেয় পারভেজদের। নিজেকে বড় ব্যর্থ মনে হয় তার। হঠাৎই চোখের সামনে ভেসে উঠে কয়েদি পারভেজের ছবি….