মেসি-রোনালদোর এক দশকের শাসনের অবসান ঘটিয়ে ফিফার বর্ষসেরা হয়েছেন বলকান ম্যাজিশিয়ান লুকা মদ্রিচ। তার এই অসামান্য অবদানের সম্মানে এ সপ্তাহে জবানের বিশেষ আয়োজন থাকছে এ ফুটবল জাদুকরকে নিয়ে।
২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ক্রোশিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বপ্নের ফাইনালে। যদিও শেষ পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখা হয়নি আঠারো ক্যারাটের সোনায় মোড়ানো সোনালি ট্রফিটি। তবে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছেন কোটি ফুটবল ভক্তের মনে হয়েছেন ক্রোয়াটদের রূপকথার নায়ক।
যেখানে ৩৩ বছর বয়সে ফুটবলাররা তাদের বুট জোড়া তুলে রেখে আজীবনের জন্য ফুটবলকে বিদায় বলতে গিয়ে অতীতের সোনালী স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে আবেগে আপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সেখানে ৩৩ বছর বয়সে নিজের হাতে তুলে নিলেন নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার। সেটাও আবার মেসি-রোনালদোর ১০ বছরের রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে!
তবে এতো বড় অর্জনের পরেও নেই কোনো উল্লাস, শুধু পুরস্কার হাতে তুলে নেওয়ার সময় ঠোঁটের কোণে ছিলো লাজুক হাসি। হয়তো এই তার এই লাজুক হাসি আর অমায়িক ব্যবহারের প্রেমে পড়েছেন প্রতিপক্ষের সমর্থকরাও।
৩৩ বছর বয়সী এই চির-তরুন লুকা মদ্রিচ জুনিয়র জন্ম নেন ১৯৮৫ সালে যুগোস্লাভিয়ার অধিনস্থ স্বাধীনতাকামী ক্রোশিয়ার জাদার শহরের মদ্রিচি গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ছিল অসামান্য ভালোবাসা। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে ১৯৯৬ সালে যোগ দেন স্থানীয় ক্লাব জাদার এফসি’তে। সে সময় মদ্রিচ ছিলেন বয়সের তুলনায় রোগা পাতলা।
আজ সেই রোগা পাতলা ছোট ছেলেটাই একবিংশ শতাব্দীর সেরা ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের মাঝ মাঠের চালিকা শক্তি একই সাথে বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা মিড ফিল্ডার।
২০০৮ সালে তার খেলায় মুগ্ধ হয়ে তাকে দলে ভেড়ায় ইংলিশ ক্লাব টটেনহ্যাম হটস্পার। সেখানে চার বছরে ১২৭ ম্যাচ খেলে ১৩ গোল করলেও তার সুপ্ত প্রতিভা যেনো সঠিকভাবে ফুটে উঠছিলো না। ২০১২ সালের সামার ট্রান্সফারে তাকে দলে ভেড়ায় স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ। যদিও প্রাথমিকভাবে ব্লাংকোস সমর্থকদের প্রায় সিংহভাগ (৭০%) তাকে দলে ভেড়ানো স্রেফ টাকা নষ্ট বলে তখন মার্কার একটি জরিপে মতামত দিয়ে ছিলো। তবে তাদের ধারণা বদলে যায় মদ্রিচ দলে যোগ দেয়ার পর তার প্রথম এল ক্লাসিকোতে পারফর্মেন্স দেখে। সে সময়কার মাদ্রিদ সেনশন রোনালদো ওজিলকে ছাড়াই সে ম্যাচের জয়ে অসামান্য অবদান রেখে রিয়াল মাদ্রিদের মূল একাদশে জায়গা করে নেন ক্রোয়াট ম্যাজিশিয়ান লুকা মদ্রিচ।
তারপর মাদ্রিদের সাথে পার করেছেন প্রায় ৬ বছর। এর মাঝে_ লা লিগা জিতেছেন এক বার, উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ জিতেছেন চার বার, কোপা ডেল রে জিতেছেন এক বার, স্প্যানিশ সুপার কাপ জিতেছেন দুই বার, উয়েফা সুপার কাপ জিতেছেন তিন বার, ক্লাব ওয়ার্ল্ডকাপ জিতেছেন তিন বার।
এই কাপগুলো জয়ের মাঝে তার অবদান ছিলো অসামান্য। বিশেষ করে ২০১৩-১৪ উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের ফাইনালে ৯২.৪৮ মিনিটে তার করা কর্নার থেকে রামোসের হেডে করা গোল। যেই গোলের সুবাদে সেবার চ্যাম্পিয়নস লীগ জিততে পেরেছিলো রিয়াল মাদ্রিদ। তার সেই সূক্ষ্ম কর্নার কিক ব্লাংকোসদের হৃদয়ে আজীবন বেঁচে থাকবে।
তাছাড়া বর্তমান সময়ে তার মাদ্রিদের মাঝ মাঠের প্লে মেকার হয়ে খেলা, দুর্দান্ত পাস, আর স্কিল জায়গা করে দিয়েছে মাদ্রিদ ভক্তদের হৃদয়ে।
২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে ক্রোশিয়ার অধিনায়ক হিসেবে আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ডের মত তারকাখচিত দলকে হারিয়ে ক্রোয়াটদেরকে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বপ্নের বিশ্বকাপের ফাইনালে। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা পাওয়া ক্রোয়েশিয়া ১৯৯৮ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে তৃতীয় হয়ে পুরো বিশ্বকে তাক লাগালেও ২০১৮ সালে ফাইনালে খেলে ফুটবল বিশ্বকে নতুনভাবে যেন চিনিয়েছিলেন নিজেদের।
যে ব্লাংকোস ভক্তরা মদ্রিচকে টটেনহ্যাম থেকে রিয়াল মাদ্রিদে ভেড়ানোকে অর্থ ব্যয় বলে মার্কার পোলে ভোট করেছিলো আজ তাদের ভোটেই লুকা মদ্রিচ ২০১৮ বছরের ফিফা বর্ষ সেরা ফুটবলার হিসেবে মনোনীত হয়েছেন।
যদিও মেসি রোনালদোর প্রায় এক যুগের সেরা হওয়ার দ্বৈরথে মদ্রিচের এমন আচমকা হানা অনেক মেসি-রোনালদো সমর্থকরা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি তবে ফুটবল বিশ্লেষকরা তার এমন অসাধারন অর্জনকে সাধুবাদ জানিয়েছে।
হয়তো ১০ বছর পর রোনালদো মেসির পর অন্য কারও হাতে উঠতে যাচ্ছে ফিফা ব্যালন ডি’অর।
হয়তো এখানেই অবসান ঘটতে যাচ্ছে মেসি-রোনালদোর দ্বৈরথ। আর মেসি -রোনালদোকে হারিয়ে এই অর্জন গুলো যেমন ক্রোয়াট ম্যাজিশিয়ান লুকা মদ্রিচের কাছে তার ফুটবল ক্যারিয়ারের সেরা স্মৃতি হয়ে আজীবন চির অম্লান হয়ে রইবে তেমনি ইতিহাসের পাতায় ও তিনি বেঁচে থাকবেন কিংবদন্তি ফুটবল জাদুকর হয়েই।
পড়ুন : শৈশব-কৈশোরের ছোট্ট মদ্রিচ