স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো অনেকটা দুর্নীতি জন্য সহায়ক থেকে গেলেও রাজনৈতিক দল ও প্রশাসন কিছু স্থিতাবস্থা এবং সামাজিক বোঝাপড়ার উপর দাঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছিল এতদিন। এই আপাত স্থিতাবস্থার প্রকৃতি এমন ছিল যে, আমলা, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবি ও ঠিকাদার এই চার’কে ঘুষ দুর্নীতির কিছু সুযোগ দিয়ে কোন ছোট বড় সরকারি কাজ মোটামুটি একটা মানে সম্পন্ন করতে হবে। পুরো প্রকল্পই ১০০ ভাগ হাওয়া হয়ে যাবে না, কিংবা ব্যয় বৃদ্ধি এমন হবে না যা দৃষ্টিকটু হয়ে জাতীয় বাজেটের উপর খুব বেশি চাপ ফেলে। নির্বাচনে টুকটাক স্থানীয় জালিয়াতি হবে তবে পুরো আসনের কিংবা পুরো দেশের মানুষের ভোটাধিকার মেরে দেয়া হবে না। অর্থাৎ এখানে সহনীয় দুর্নীতি, সহনীয় সময় ক্ষেপণ এবং সহনীয় চাঁদাবাজি হবে, তবে মূল উন্নয়ন কাজটি হারাবে না এবং বুদ্ধিজীবি ও নাগরিক এই সহনীয় ঘুষ দুর্নীতির মডেল নিয়ে মাঝে মাঝে কথা বলবেন কিন্তু তেমন উচ্চবাচ্চ করবে না।
অনেকগুলো বেসরকারি এবং সরকারি ব্যাংক লুট হয়েছে, হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ খেলাপি হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। প্রায় সবগুলা সরকারি ব্যাংক মূলধন খুইয়ে ফেলেছে
তবে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ নির্বাচনের পরে আমরা দেখতে পাচ্ছি- এই স্থিতাবস্থার শর্ত মানা থেকে ক্ষমতাসীনরা পুরোপুরি সরে গেছে। একদল ভোটের দায়হীন প্রকৃত অর্থে অনির্বাচিত লোকদের রাজনীতির সাথে সমাজের চলা স্যোশাল কন্ট্রাক্টের মর্ম বুঝার ও মানার চেষ্টা না করে এখানে বেপারোয়া লুটের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। ফলে অনেকগুলো বেসরকারি এবং সরকারি ব্যাংক লুট হয়েছে, হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ খেলাপি হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। প্রায় সবগুলা সরকারি ব্যাংক মূলধন খুইয়ে ফেলেছে। রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে যাচাই বাছাইহীন ঋণদানে সর্বস্ব হারিয়ে পর পর কয়েকটি বছর ব্যাংকগুলো বাঁচিয়ে রাখতে বেইল আউট দেয়া হচ্ছে (প্রায় ২৩ হাজার কোটি দেয়া হয়েছে বিগত ২ বছরে)।
এই সময়ে জাতীয় বাজেট বছর প্রতি ৫০ হাজার কোটি করে বাড়িয়ে অর্থনীতির সূচক ফুলিয়ে ফাফিয়ে তোলা হয়েছে। ৭% প্রবৃদ্ধি হয়েছে কিন্তু এই কর্মহীন প্রবৃদ্ধি বেকারত্ব দূরে ভূমিকা রাখেনি বারং বেরকার বেড়েছে। প্রায় ১ কোটি অর্ধ ও পুর্ণ শিক্ষিত সার্টিফিকেটধারী বেকার রাস্তায় ঘুরছে। রাজস্ব আয়ের নতুন নতুন খাত খোলা হলেও বাজেটের উল্লম্ফনের সাথে প্রতি বছর এক লক্ষ কোটির বেশি ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে, এতে একদিকে ক্ষুদ্র অর্থনীতি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় অর্থনীতি ঋণ নির্ভর হয়ে উঠেছে। ফলে বৈদেশিক ঋণের চাপ বেড়েছে ও ঋণের সুদ -জাতীয় বাজেটের ২য় সর্বোচ্চ খাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
সকল ধরণের লজ্জা ও রাজনৈতিক শিষ্টতার সীমা অতিক্রম করে সরকারি প্রকল্প গুলোর ব্যয় মূল প্রাকল্লিত ব্যয়ের বহু গুণ বাড়ানো হচ্ছে, যা আগে লক্ষ টাকায় বাড়াতো তা এখন শত কোটিতে এমনকি হাজার কোটি করে শুধু বেড়েছে।
সকল ধরণের লজ্জা ও রাজনৈতিক শিষ্টতার সীমা অতিক্রম করে সরকারি প্রকল্প গুলোর ব্যয় মূল প্রাকল্লিত ব্যয়ের বহু গুণ বাড়ানো হচ্ছে, যা আগে লক্ষ টাকায় বাড়াতো তা এখন শত কোটিতে এমনকি হাজার কোটি করে শুধু বেড়েছে।
দুর্বৃত্তপরায়ণ সরকার নাগরিক স্বস্তির কথা না ভেবে কয়েক মাস পর পরই গ্যাস বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর দাম বাড়িয়েছে। মাত্র দেড় বছর সময়ে চার বার বিদ্যুৎ মূল্য বাড়ার ঘটনা ঘটেছে।
অনেক অবকাঠমো প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। কিন্তু এই সময়ে নগর ও মহাসড়কে যানজট কমার ও গণপরিবহন তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। দেশের পঁচাত্তর হাজার কিমি সড়ক মেয়াদ উত্তীর্ণ, রেল জরাজীর্ণ। কিলোমিটার প্রতি শত কোটি টাকা খরচ হলেও মাত্র ২ বছরের মাথায় মহাসড়কের কার্পেটিং ই শুধু উঠে যায়নি, বড় বড় গর্তে ভরে গেছে পুরো দেশের সড়ক। গড়ে প্রতিদিন ৬৪ জন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন।
ফ্লাইওভারের নাম করে একদিকে লূট হয়েছে অন্যদিকে গণবান্ধব গণপরিবহণ মেট্রো ও বিয়ারটি করার রাস্তা বন্ধ করে ফেলা হয়েছে। মেট্রো’র নাম দিয়ে বছরের পর বছর শুধু বেড়া রাস্তা ঘিরে রাখা হয়েছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি, এখন পর্যন্ত ত্রিশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের হিসাব হলেও মেট্রো’র নূন্যতম ভাড়া ২০০+ রেখে এই পরিবহণ থেকে গণকে সরিয়ে দিবার ফয়সালা হয়েছে।
রাস্তার ধূলা ও যানজট পুর্ণ নগরীতে পরিবহণের ধোঁয়া, খাদ্যের ভেজাল, ময়লার ও জীবাণু’র সঙ্ক্রামক, ব্যাকটেরিয়াল আগ্রাসন এবং ক্যান্সার বাহিত রোগে সয়লাভ সারা শহর, শুধু স্বাস্থ্য খাতেই প্রবৃদ্ধি দুই অংকে। মধ্য রাতের পরেও খোলা থাকছে সব ফার্মাসী। যাবতীয় মন্দ বিষয় ডেকে আনা খাতের প্রবৃদ্ধি দুই অংকে যার মধ্যে বেসরকারি খাতের শিক্ষাও রয়েছে।
নেই জন প্রতিনিধিত্ব, নেই দায়বদ্ধতা,আছে শুধু উন্নয়নের নামে বেশুমার অর্থ লোপাট। এক সারি নন টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প দেশের দায় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে উন্নয়ন এখনো রাস্তাকেন্দ্রিক। সেই রাস্তাও গর্ত, কাদা ও ধুলোভরা। উন্নত শিক্ষা, উন্নত স্বাস্থ্য, উন্নত কর্মসংস্থান ও উন্নত কাজের পরিবেশ এবং সর্বোপরি উন্নত জীবনমান এখনও ‘উন্নয়নের’ প্রতিশব্দ হয়ে ওঠেনি।
পাঁচ বছরের বেশি সময় টানা প্রায় সব পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন, চাকুরিতে নিয়োগ ফাঁস হয়েছে। দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র স্বীকার করার দায়ও দেখায়নি, বন্ধতো দুরের কথা।
ব্যাপক হারে হয়রানি গুম ও খুনে জড়িয়ে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ব্যক্তির ভিন্নমতের উপস্থিতি রাষ্ট্রে চরম পর্যায়ে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে, বিরোধীদের উপর গোয়েন্দা হয়রানি, মামলা, জেলে ভরার উৎসব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাজনৈতিক সংষ্কৃতি হিসেবে। জানুয়ারি ১, ২০১৮ থেকে মাত্র ১০ মাসে ৪০০ জনের অধিক নাগরিককে শুধু খুন করে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও ক্ষমতাবলয়ের ক্যাডাররা।
ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে মুক্ত বুদ্ধির চর্চা, লিখালিখি ও জনবান্ধব সাংবাদিকতাকে শিকল পরাতে ১৪টি জামিন অযোগ্য কালো আইন করা হয়েছে। যা ইতমদ্যে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়ে পাশও হয়ে গেছে। স্বাধীন সাংবাদিকতার দিন শেষ হয়ে গেল এই কালা আইনের মাধ্যমে।
স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নির্বাচন গুলোতে দেখা গেছে ভোটের আগের রাতে কিংবা দুপুরের আগেই প্রায় সব ব্যালটে প্রকাশ্য সীল মারার বেপারোয়া ও একচেটিয়া বলপ্রয়োগের সংস্কৃতি।
আদালতে দলীয় বিচারক নিয়োগ এবং সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছা বাস্তবায়নের কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিম্ন আদালতে ৮০ ভাগের উপরে দলীয় চাটুকার, মেধাহীন ও নিম্ন মানের বিচারক নিয়োগ হচ্ছে।
এই সময়ে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের অংশগ্রহণ বাড়েনি শুধু স্যাটেলাইট ক্লিনিক নামে কিছু লুটের আয়োজন হয়েছে, চিকিৎসা ব্যয়ে নাগরিকের নাভিশ্বাস উঠেছে।
চল্লিশ থেকে ষাট লক্ষ শিক্ষিত বেকার তৈরি হয়েছে এবং সরকার চাকুরি প্রার্থী ও শিক্ষার্থীদের জন দাবী মেনে না নিয়ে বরং দলীয় পেটায়া বাহিনী দিয়ে নৃশংস ভাবে দমনের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। আনপ্রডাক্টিভ সরকারি চাকুরির ভাতা ও সুবিধা অন্যায্য ও দৃষ্টিকটু পর্যায়ে বাড়িয়ে বেসরকারি খাতে মেধা প্রবাহ বন্ধ করার আয়োজন হয়েছে।
নেই জন প্রতিনিধিত্ব, নেই দায়বদ্ধতা,আছে শুধু উন্নয়নের নামে বেশুমার অর্থ লোপাট। এক সারি নন টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প দেশের দায় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে উন্নয়ন এখনো রাস্তাকেন্দ্রিক। সেই রাস্তাও গর্ত, কাদা ও ধুলোভরা। উন্নত শিক্ষা, উন্নত স্বাস্থ্য, উন্নত কর্মসংস্থান ও উন্নত কাজের পরিবেশ এবং সর্বোপরি উন্নত জীবনমান এখনও ‘উন্নয়নের’ প্রতিশব্দ হয়ে ওঠেনি।
অর্থাৎ একদল অনির্বাচিত লোক শাসন কাঠামোয় ঢুকে যত্রতত্র গুণ্ডাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেছে, দায়বদ্ধতাকে পুরোপুরি সরিয়ে দিয়েছে এবং রাজনীতির সাথে সমাজ ও নাগরিকের বুঝাপড়ার ক্ষেত্রগুলোকে পুরোপুরি লঙ্ঘন করে ফেলেছে। আগের যে দুর্নীতি সহায়ক রাজনৈতিক কাঠামো ছিল সেটা পুরোপুরি ভেঙে দিয়ে শুধু লুট আর লুটের কাঠামো প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
এমতাবস্থায় নাগরিক সমাজ ও রাজনীতিতে নতুন একটি বুঝাপড়ার স্থান রিডিফাইন করা ছাড়া বিকল্প নাই। নতুন একটি স্যোশাল কন্ট্র্যাক্ট তৈরির জন্য নাগরিকদের ঐক্য তৈরির বিকল্প নেই। এই দুর্বৃত্তায়ন, এই অধপতনের উচ্ছাস , এই গুণ্ডাতন্ত্র থেকে মুক্তির জন্য নাগরিকের ঐক্যবদ্ধ না হয়ে আর কোন উপায় নেই। নিরেট ঐক্য দরকার সবার আগে নাগরিকের, ঐক্য দরকার একটি নাগরিক সনদের উপর। এমন ঐক্য দরকার যেখানে নাগরিক ঠিক করে দিবে, রাজনীতি করতে হলে একজন ঠিক কি কি করতে পারবে আর কি কি পারবে না। এমন একটি সনদ চাই যেখানে রাজনৈতিক সততা, দায়বদ্ধতার একটা পরিসীমা তৈরি হবে। একটি জনবান্ধব ভ্যালু তাড়িত নাগরিক সনদ তৈরির ভিত্তি নির্মান করা না গেলে আগামীতে ক্ষমতায় যেই আসুক, সেই রাষ্ট্র লুটের বর্তমান বেপারোয়া ধারা অব্যহত রাখবে। তাই জনতার জেগে উঠাই এই সময়ের বড় প্রত্যাশা। এর বিকল্প নাই।