ফিরে আসুক সাধের ময়না

ফিরে আসুক সাধের ময়না

তোমার হাত যে ধরেছিলাম তাই পারিনি জানতে 

এই দেশে বসতি করে শান্তি শান্তি শান্তি 

তোমার হাত যে ধরেছিলাম তাই পারিনি জানতে 

সফলতার দীর্ঘ সিঁড়ি, তার নিচে ভুল-ভ্রান্তি   

                                      – শক্তি চট্টোপাধ্যায়

 

কার হাত ধরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় জানতে পারেননি, সেটি তিনিই ভালো জানেন। তিনিই বলতে পারবেন, কোন সে হাত তার মানসপটে এতই স্পষ্ট যে কবিতার ছন্দেও তার স্মরণ হয়। কিন্তু, বাংলাদেশের ক্রিকেট বহুদিন ধরেই একটি হাত ধরে এগিয়ে চলেছে, যার হাত ধরে হেটে চলেছে সফলতার সিঁড়িতে। তিনি, বাবা-মায়ের সাধের ময়না। যাকে পুরো বিশ্ব চেনে সাকিব আল হাসান নামে।

যে হাতের জাদুদে রচিত হয়েছে বহু সুখক্ষণ, যার হাত জন্ম দিয়েছে বহু সুখকর গল্পের; সে হাতই আজ অনাকাঙ্খিত ভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের মূল আলোচ্য বিষয়। ইতোমধ্যে এটি স্পষ্ট যে, সাকিবের কড়ে আঙ্গুল আর কখনোই ফিরে পাবে না স্বাভাবিক শ্রী। মনের কষ্ট বুকে চেপে যে স্বাভাবিক স্বরে এই বেখবরটি তিনি দিয়েছেন তা ব্যাথাতুর নয়নে দেখেছে অজস্র সাকিব ভক্ত। অনেকের আঁখিই হয়েছে অশ্রুশিক্ত। ‘সকল’ বাংলাদেশি ভক্তের বদলে কেন ‘সাকিব’ ভক্ত লিখলাম সেটি বয়ান করবো কিছুক্ষণ পরে। তার আগে একটি বিষয় স্পষ্ট করে দেই, পত্রিকার জন্য যখন লিখতে বসি, তখন আবেগের দুয়ারটা থাকে বন্ধ। পাছে যদি পেশাদারিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু, এ লেখাটি আমি লিখব একজন সাধারণ আদমি হিসাবে, যার অনুভূতিতে আঘাত করেছে অশ্রু লুকানো সাকিবের মুখটি।

বর্তমান প্রজন্মের হওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন আটকে থাকে অনেকটা সময়ই। তাতে, বহুকিছুই চোখে পড়ে। ক্রিকেট ভক্ত হলেই আপনাকে সাকিব ভক্ত হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু, সাকিব ভক্ত নন, এমন আদম সন্তানদের মাঝে একটি শ্রেণি রয়েছে যারা নিজেদের সাকিব ‘হেটার’ ভাবতে ভালোবাসে। ঘৃণার মতন ঘৃণিত একটি শব্দকে মনে পোষণ করে সদম্ভে তার জানান দেয়া আমার মনে তাদের সুস্থতা নিয়ে এক রকমের প্রশ্ন জন্ম দেয়। সাকিব কে ঘৃণা করার কারণ কী? তিনি ঔদ্ধত, তিনি অহংকারী, মাঠে তার আচরণ আক্রমণাত্বক, তার স্ত্রী বেপর্দা চলাফেরা করে!

সাকিবকে শারাফাতের পথে আনার এই যে পেরেশানি, এটা আমি বেশ উপভোগ করি। একটু পিছনে ফিরে তাকান; যখন বাংলাদেশের হয়ে ইংল্যান্ড এর তৃতীয় স্তরে খেলতে গিয়ে খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন আশরাফুল। আমাদের  স্বপ্নের সীমানা তখন ঐটুকুনই ছিল। সেখানে সাকিব আসার পরে যেন বদলে গেল বহুকিছুই। তার আনজাম ধরে বহু প্রথম দেখল বাংলাদেশ; যাকে নেহায়েত ইত্তেফাক বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। আমাদের দেশের একজন ক্রিকেটার ভীন দেশের সব বড় তারকাদের সাথে টেক্কা দিয়ে মাঠ কাপাচ্ছেন এ তো ছিল কল্পনারও অতীত। র‌্যাংকিংয়ে পয়লা স্থান ত দূর, শীর্ষ দশই মনে হত অলিক স্বপ্ন। সাকিব আহিস্তা অদ্ভুতভাবে কায়ানাতকে দেখিয়ে দিয়েছেন একজন বাঙালি কত দূর যেতে পারে। অথচ, তিনি নাকি খুদগর্জ, দলের বদলে খেলেন শুধুই নিজের জন্য!

পূর্বের পরিচ্ছেদের শেষ দিকে যে বিষয়গুলোর জিকর করেছি তার কোনটি ঠিক ক্রিকেট সম্পর্কিত কেউ বলতে পারবেন? সাকিব-তামিম-মুশফিকরা যখন জাতীয় দলের দূত হলেন; তখন তাদের বয়স কত ছিল? যদি তর্কের খাতিরেও মেনে নেই, তাহলেও তো বলতে হয়, ঐ বয়সে ভূল করাটা স্বাভাবিকই। আমার সোজা চোখে যা মনে হয়, অস্থির আমাদের জীবনে সুকুনের বড় অভাব। তাই, সাকিবের স্ত্রী বেপর্দা বলে, তাকে ঘৃণা করি এর মতন অদ্ভুত আলফাজ ব্যবহার করি আমরা!

সন্দেহ নেই, মাশরাফির নেতৃত্বে চোখে চোখ রেখে খেলা শিখেছে বাংলাদেশ। মাশরাফির যে সৈনিকটি এ ক্ষেত্রে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি সাকিব। ব্যাট হাতে যেমন বেধরক পিটিয়েছেন প্রতিপক্ষের তারকা বোলারদের, তেমনি বল হাতে জাদুর ভেলকিতে ভস্ম করেছেন প্রতিপক্ষকে। একক রেকর্ড বিবেচনায় সাকিবের সমকক্ষও এখনো কেউ নেই বাংলাদেশে। অথচ, এই মানুষটাকেই ঘৃণা করার কি অদ্ভুত প্রয়াস! অন্ধ চোখে সবই তো সমান, তা সে ময়না হোক বা অন্য কোনো পাখি; তাই তাদের থেকে বরং চোখ ফেরাই বর্তমানের দিকে।

 

এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি ।

শূণ্যতার দিকে চোখ, শূণ্যতা চোখের ভেতরেও

এক গ্লাস শূণ্যতা নিয়ে বসে আছি। 

                            _ রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

 

সাকিবের আজকের এই হালতের পিছনে মূল দায়টা যায় কথার করাতে তাকে ফানা করা যেত খুব সহজেই। বহুবার সে চেষ্টা করেছিও। এবার আর ইচ্ছে করছে না। বরং, মনে হচ্ছে সব কিছু জানার পরেও এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়েই বসে রয়েছি আমরা। সজ্ঞানে শূণ্য চোখে সব বিষয়ে ওয়াকিফ হবার পরেও কেমন যেন আশ্চর্য নীরব আমরা। সাকিবের ঘটনাটি হতে পারে একটি বড় ইবরাত, যদি আমাদের অন্ধ চোখ খুলে তাহলেই শুধু।

এশিয়া কাপের আগেই শোনা যাচ্ছিল এমন আসরে অংশ নেয়ার জন্য সায় দিচ্ছে না সাকিবের শরীর। তিনি আমিরাতের বদলে শরণাপন্ন হতে চেয়েছিলেন শল্যবিদের। তবু, পারেননি। যিনি কখনো পেশাদার ক্রিকেটার হিসাবে মাঠেই নামেননি, তিনি অধিকর্তা রূপে আদেশ জারি করলেন আমিরাত গমনের! এটা যেন মানুষের শরীর নয়, সরকারি কর্ম প্রকল্প; ইচ্ছে হলো পাশ করিয়ে নিলাম জোর খাটিয়ে। আসরের মধ্যপথেই সাকিবের আঙ্গুলের একটি ছবি দেখেছিলাম, যা দেখে আঁচ করেছিলাম খারাপ কিছুর। এতটা খারাপ সেটা ভাবনাতেও আনতে চাইনি।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তার আঙ্গুল আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে না। বাড়তি হিসাবে যোগ হয়েছে সংক্রামণ। যার পুরোপুরি দূর না হওয়া পর্যন্ত সম্ভব না অপারশেনও। খোদা না করুন, সংক্রামণ আরো ছড়ালে হারাতে হতে পারে হাতও! সামান্য শব্দগুলো বোধহয় বোঝাতে পারছে না যে ঠিক কি অবস্থায় রয়েছেন তিনি! আমাদের তলিয়ে ভাবার স্বভাবটা বড় কম, তাই মুহুর্তের চাকচিক্যে আমরা ভুলে যাই বহু কিছুই। একজন খেলোয়াড়ের জীবনকালটা খুব ছোট। যতদিন পারফর্ম করবেন ততদিনই মানুষের মুখে মুখে নাম, একটু আড়াল হয়েছেন মানেই বিস্মৃতির অতল। সাকিবের ক্যারিয়ারের এখন মধ্য গগন, এমন অবস্থায় এ পরিস্থিতি; যার সম্পূর্ণ গোয়ার্তুমিতে সৃষ্ট সেটি কি কাম্য ছিল?

ইনসানের শরীরের হালত তার চেয়ে ভালো কে বোঝে? সাকিব বারবার বলার পরেও তার কথা অগ্রাহ্য করে এখন যে পরিস্থিতিটিতে তাকে ফেলে দেয়া হয়েছে তার দায়টা কে নেবে? হ্যা, সাকিবের বিকল্প বাংলাদেশ দলে নেই, কিন্তু সে যুক্তিতে তার খেলোয়াড়ী জীবনেই যতিচিহ্ন সৃষ্টি করে দেয়া মতন অবস্থা সুস্থ মস্তিষ্কের কাজ? মাঠের লড়াইয়ে যেভাবে নিজেকে নিংড়ে দিয়ে নিয়ে গিয়েছেন সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে সেই মনোবল হয়ত সাহায্য করবে তাকে এই দুঃসহ সময় কাটিয়ে উঠতে। কিন্তু এ থেকে কেউ কি শিক্ষা নেবে? কেউ কি প্রশ্ন করবে সেই কেউকেটাদের যাদের গোয়ার্তুমির ফল ভোগ করছেন সাকিব?

ক্রিকেটিয় ব্যাখ্যায় না পেরে যারা অনাহুত ভাবে তার চরিত্রকে সামনে এনে; যা তারা নিজের চোখের সামনে দেখেননি তারা সাকিবের সমালোচনায় মত্ত হতে পারেন। কিন্তু, বাংলাদেশই শুধু না তামাম ক্রিকেট বিশ্বই জানে সাকিব এক গওহরের নাম। যার ঔজ্জ্বল্যে আলোকিত হয় বাংলাদেশের ক্রিকেট। পেরেশানি যখন রয়েছে তাবদিরও রয়েছে। সাধের ময়না আবার নিজস্ব ভঙ্গিমাতেই মাঠে ফিরবেন এইটাই এখন চাওয়া। যে সিদ্দাতের সাথে তিনি নিজেকে নিংড়ে দেন দেশের জন্য, যে মাহিরে মুগ্ধ করেছেনে, করেন সকলকে তিনি একজন কতৃত্ববাদীর প্রহসনের শিকার হয়ে হার মানবেন এমনটা কেউই বোধহয় বিশ্বাস করে না। ক্রিকেটের প্রতি তার যে ভালোবাসা, যে আরজু তাই আবার তাকে ফিরিয়ে আনুক প্রিয় বাইশ গজের ময়দানে।

গুটি কয়েক ক্রিকেট পন্ডিতদের বাদ দিলে বাবা-মায়ের সাধের ময়না সবারই চোখের মণি। এত মানুষের ভালোবাসা হার মানবে ব্যধির কাছে? তাও এক বধিরের জন্য যার জন্ম? না, এমনটা ভাবনাতেও আসেনা। ময়না বরং ফিরে আসুক আরো সুরেলা হয়ে, আবারো তার স্যালুট হয়ে উঠুক অজস্র ফেসবুক অ্যাকাউন্টের প্রোফাইল পিকচার। বেশি দুর যেতে হবে না, মাশরাফিই তো আছেন চোখের সামনে। যিনি দেশে ফিরেই ছুটে গিয়েছিলেন সাকিবকে দেখতে। মাশরাফি যদি পারে তাহলে ময়নাও পারবে, পারতেই হবে। কিউই কন্ডিশনের হিম ধরানো পেস যাকে কাবু করতে পারেনি, তিনি একজনের অবিবেচনার শিকার হয়ে হার মানতে পারেন না।

 

গোপন রাখলে থাকবে না আর_ বাইরে যাবে 

পারলে হৃদয় দূর্বলতা দেশ জ্বালাবে 

মিছেই আমায় জব্দ করে 

                                     _ শক্তি চট্টোপাধ্যায়