গেল মৌসুমে স্বপ্নের ‘তেরো’ জয়ের পর থেকেই যেন আঁধার জেঁকে বসেছে বার্নাব্যুর সদা আলোকিত আকাশে। আনন্দের রেশ কাটবার আগেই নেপথ্য কারিগর জিদান জানিয়ে দিলেন বিদায়ের খবর। সেটি হজম হবার পূর্বের যুবরাজ জানালেন তিনিও হাটছেন গুরুর দেখানো পথে। আফতাবের রোশনী মুহূর্তেই যেন ঢেকে গেল আঁধারে।
তবু, দলটার নাম মাদ্রিদ হওয়ায় আশায় বুক বেধেছিলেন সাধারণ সমর্থকরা। ভাবনাটা ছিল, হয়ত কিছুটা সময় লাগবে কিন্তু শতাব্দী শ্রেষ্ঠরা ঠিকই নিজেদের দাপট অব্যাবহ রাখবে। মৌসুমের প্রথমভাগের শেষ পর্যায়ে এসে এখানে এখন সে আশার বদলে রাজ করছে দ্বিধা।
কোচ হিসাবে লোপেতিগে নিজের মানের জানান দিয়েছেন স্বদেশের হয়ে সাফল্য দিয়েই। সুতরাং, যোগ্যতার মাপকাঠিতে তিনি উৎরে গিয়েছেন বলা যায়; প্রশ্ন যেটি দাড়াচ্ছে সেটি হচ্ছে মাদ্রিদের সদা ক্ষুধার্ত সমর্থকদের মনের ক্ষুধা মেটানোর জন্য তিনি আসলে উপযুক্ত কি না? আলোচনার জন্য সময়টা অনেক দ্রুত হয়ে গেলেও কিছু কারণে কথাগুলো চলে আসছে।
লোপেতিগে প্রথম যে পেরেশানিটির জন্ম দিয়েছিলেন সেটি ট্রান্সফার মার্কেটে। হ্যা, জিদানের সময়কালটায় তিনিও এক প্রকার নিরবই ছিলেন ট্রান্সফার মার্কেটে, সে হিসাবে বলা যায় লোপেতিগে জিদানেরই সিলসিলা রক্ষা করেছেন। কিন্তু, এখানে প্রশ্নটি আসছে এই জন্য যে, জিদান’র স্কোয়াডে যারা ছিলেন তারা জিদানের খেলার ধরণের সাথে পুরোপুরি অভ্যস্ত। যার ফলে নতুন কোনো মুখ ছাড়াই তিনি সাফল্য পেয়েছিলেন। একই সাথে কোচ হবার পূর্বে রিয়ালেরই সহকারির পদে থাকায় খেলোয়াড়রা ছিলেন তার চেনা, যার ফলে জিদান খুঁজ ভালো মতনই নিজের দল সম্পর্কে ওয়াকবিহাল ছিলেন।
লোপেতিগের বেলায় যেটি হয়েছে, সেটি হচ্ছে তিনি জিদানের রেখে যাওয়া স্কোয়াডে ভরসা রেখে নিজস্ব ধাঁচে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করছেন খেলোয়াড়দের। যে ধাঁচের সাথে রিয়াল একাদশের কেউই অভ্যস্ত নয়। যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে মাঠের ফলাফলে। এ ক্ষেত্রে তিনি ট্রান্সফার উইন্ডোটা ব্যবহার করে এমন কিছু খেলোয়াড় আনতে পারতেন যারা তার ধাঁচের সাথে অভ্যস্ত। এর বদলে তিনি আনলেন কোর্তোয়া এবং ডিয়াজকে। কোর্তোয়া বিশ্বমানের সন্দেহ নেই, কিন্তু ঐ মুহুর্তে একজন গোলরক্ষকের বদলে মূল মাঠের খেলোয়াড়ের জারুরাত ছিল বেশি। শেষ চমক হিসাবে আনলেন ডিয়াজকে। এটাকেও বিস্ময়করই বলা যায়, রোনালদোর শূণ্যস্থান; যেটি পূরণ অসম্ভব বলে এখনই প্রায় প্রতিয়মান সে জায়গা নেয়ার জন্য ডিয়াজ কোনো অংশে উপযুক্ত নন।
এ তো গেল মাঠের বাইরের সমস্যা। মাঠে রিয়ালকে প্রায়শই চিনতে হচ্ছে চিরচেনা জার্সি দেখে। লোপেতিগের যে ধরণ; বল পায়ে জমিয়ে জমাট এক আক্রমণ রচনা করে প্রতিপক্ষের পিলে চমকে দেয়া; সেটি কখনোই রিয়ালের ধরণ ছিল না। রিয়ালের খেলোয়াড়রা বরং দ্রুত লয়ের আক্রমণাত্বক অথবা প্রতি আক্রমণাত্বক ফুটবলেই অভ্যস্ত। তার বদলে নিজেদের মাঝে দেয়া নেয়া করে আক্রমণ গড়ার বদলে হিসাবে গড়বড় করে প্রতিপক্ষকে উপহার দিচ্ছে সহজ সব গোল। রিয়ালের যে বহুকালের রাওয়াইয়্যাত লোপেতিগে ভাঙ্গার জন্য মনঃস্থির করেছেন সেটি বরং দলকেই পরিণত করছে ভঙ্গুর এক দলে।
লেপেতিগের দল নির্বাচনের স্পষ্ট যে তিনি এখনো নিজের পছন্দের একাদশ সাঁজাতে হিমশিম খাচ্ছেন। শুরুর দিকে ফ্রন্ট থ্রি নতুন ভূমিকায় থাকলেও লোপেতিগের দ্বিধা সমস্যার জন্ম দিয়েছে সেখানেও। বেনজেমা প্রথম কিছু ম্যাচ পিওর নাইন হিসাবে খেলে সাফল্য পেলেও ইদানিং তাকে দেখা যাচ্ছে নিচে নেমে আক্রমণ রচনায় ব্রত হতে। খেলোয়াড়দের স্বাচ্ছন্দ্যের ধরণ আর লোপেতিগের দ্বিধার জগাখিচুড়ির এক অদ্ভুত মেলবন্ধনই যেন দেখা যাচ্ছে এখন। তিনি যদি পাসিং ফুটবলের দর্শনের আকড়ে থাকার বিষয়ে মনঃস্থির করে থাকতেন তাহলে সব চেয়ে উত্তম হত তার অধিনে যারা এই ধাঁচে অভ্যস্ত তাদের কাউকে দলে এনে সুতো বাধার কাজটা করতে দেয়া। সেটি না করায় সৃষ্টি হয়েছে এক শূণ্যতার।
মোরিনহোর সাথে বিশ্লেষকরদের মত আধারে ঢাকা পড়তে যাচ্ছে লোপেতিগের মাদ্রিদ অধ্যায়ও। সবেই সব শুরু হলেও, অনেক সময় শুরুর গল্প দেখেই শেষটা আঁচ করা যায়। রিয়ালের বর্তমান খেলোয়াড়রা যদি লোপেতিগের ধাঁচের সাথে নিজেদের মিলিয়ে নিতে পারেন সেটি হবে মিরাকল। এ ক্ষেত্রে লোপেতিগের রক্ষাকবচ হতে পারেন সেবেওস। যেহেতু তিনি নানা পর্যায়ে লোপেতিগের অধিনে খেলেছেন তাই, লোপেতিগে তাকেই মূল করে দল সাজিয়ে দেখতে পারেন। যেমনটা জিদান করেছিলেন ক্যাসেমিরোকে দিয়ে। এই একজনই কিন্তু আমূল বদলে দিয়েছিল রিয়ালের চিত্র।
সময়ই বলে দিবে এ পথের শেষটা কেমন হবে। তবে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে লোপেতিগে যদি সমাধা খুঁজে না পান, তাহলে তিনি যে খুব বেশিদিন বার্নাব্যুর শোভা বাড়াতে পারবেন না সেটি বলে দেয়া যায়। কারণ, সাফল্যের বিষয়ে মাদ্রিদ সমর্থকরা বরাবরই ক্ষুধার্ত।