কলকাতার পুজোর সাতকাহন

কলকাতার পুজোর সাতকাহন

শারদোৎসব মানে একঝাঁক আনন্দ। পেজা তুলোর মতো মেঘের আনাগোনা। কাশফুলের মতো নরম সময়। আর ভারতীয় বাঙালির নস্টালজিয়া মানেই শারদীয় দুর্গোৎসব। বাতাসে কেমন উড়ু উড়ু ভাব। শরতের আগমনের খবর কে দেয় বলুন তো। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন। বলতে গেলে শরতের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হল কাশফুল। কিন্তু শহর কলকাতায় তো আর এসব বোঝার উপায় নেই। তার জন্যে আপনাকে গাড়ি ধরতে হবে, কিম্বা ট্রেন। তারপর প্রাচীন কলকাতা ছাড়িয়ে কিছুটা এগোলেই আপনি দেখতে পারবেন কাশফুলের মেলা। আর তারপরেই আসে শিউলি ফুল। শরতে এই দুধসাদা ছোট্ট একটি ফুলের কথা না বললেই নয়। যার বৃন্তটি নরম কমলা রঙের। ভোর হলেই ঝরে পড়ছে টুপটাপ। ছোটবেলায় কেউ যেন তা কুড়িয়ে নিয়ে না যায়, তার জন্যে কতকিছুই না করেছি। হ্যাঁ এরকম নানা স্মৃতি আছে আমার আপনার। তবে যাই হোক এরকম নানা নস্টালজিয়া নিয়েই শারদ এসে হাজির বাঙালির আঙিনায়। তোরজোড় একদম চরমে। আর কিছুদিনের মধ্যে মহালয়ার ভোর। সেই অমোঘ সুর। যার জন্যে প্রত্যেকে না হোক বেশিরভাগ মানুষই ঘুম থেকে ওঠে। আর তিনি হলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। তাই, বাঙালি যে যেখানেই থাকুক না কেন রেডিও হোক বা ইন্টারনেটে শোনা ঐ ভদ্রলোকের গলা বাঙালিকে স্মৃতি আক্রান্ত করে তোলে। অন্তত আমাদের জেনারেশনের ছেলেবেলার স্মৃতির ঝাঁপি খুলে ধরতে ঐ ভদ্রলোকের কাঁপা কাঁপা গলার জুড়ি মেলা ভার।

ঐ গলা শুনলেই ছেলেবেলার সমস্ত প্রিয় নেই মানুষরা স্মৃতির দরজায় ভিড় করে দাঁড়ায় – শুধু কি আমাদের ছেলেবেলার মহালয়ার স্মৃতি জুড়ে ঐ মানুষটির গলা? শুনি, আমাদের আগের জেনারেশনের মানুষের ছেলেবেলার মহালয়ার স্মৃতিতেও ঐ মানুষটির গলার সমান অধিকার। “বাজলো তোমার আলোর বেনু… এই আনন্দ যজ্ঞে সবার মধুর আমন্ত্রণ…”

এতক্ষণ তো গেলো পুজো আসছে আসছে ব্যাপার। এবার আসি পুজোর শপিং। যার জন্যে এত সাজ সাজ ব্যাপার। এত ঘটা, আড়ম্বর। চৈত্র মাসের মতো তো আর প্যাচপ্যাচে গরম নেই। তবে হ্যাঁ একটা অদ্ভুত অস্বস্তি আছে ওয়েদারে। তার সঙ্গে সঙ্গে আছে রিমঝিম বৃষ্টি। আর বৃষ্টির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তো আছেই। আর প্রেম মানেই প্রহর শেষের আলোয় প্রেমিক প্রেমিকা যুগলই শুধু এই সময় পরস্পরের চোখে সর্বনাশ দেখতে পান না, বৈবাহিক জীবনের নিস্তরঙ্গতায় অভ্যস্ত মাঝবয়সি বাঙালি কাকু-পিসেও হাতিবাগান বা গড়িয়াহাট চত্বর পার হওয়ার সময় স্ত্রীর চোখে সেই সর্বনাশের ভীষণরকম আভাস পান। সত্যি, ‘খাস দক্ষিণী সিল্ক, মাত্র দু’শ টাকা, দু’শ টাকা-র মোহ এড়ানো একদমই ভীষণ কঠিন।

অবলা বঙ্গবালারা বিয়ে নামক জিনিসটা পাঁচন ভেবে গলাধঃকরণ করেন ঠিকই, কিন্তু তাঁরা অবশ্যই ধরিত্রীর মত সর্বংসহা নন, যে স্বামীর চোখের আকুতিতে সাড়া দিয়ে দু’শ টাকার সিল্ক বা একশ টাকার কোলাপুরী চটির ডাক এড়িয়ে বীরদর্পে পাশ কাটিয়ে যাবেন। দিনকাল যে কীভাবে পালটায় তারই জলজ্যান্ত উদাহরণ এই পুজোর মরশুম। বিশ্বাস না হলে একবার হাতিবাগান বা নিউমার্কেট এলাকা উঁকি মেরে দেখুন। বিকেল হতে না হতেই সকলেই বেরিয়ে পড়ছেন শপিং-এ।

নামিদামি বিপণির ব্যাগ হাতে অনেককেই দেখবেন গুছিয়ে কেনাকাটা করতে। শপিং মলগুলোয় মাঝে মধ্যে ডিসকাউন্ট দিলেও সাধারণ জামাকাপড়ের দোকানে হঠাৎ ছাড় মেলে না বললেই চলে। জরি বসানো চপ্পলই হোক বা রোজকার বিছানার চাদর, দরজা জানালার পর্দা-খোঁজ করলে কী না মেলে। তবে সাংসারিক চাপ, অফিসে বসের চোখ রাঙানি, নিত্য ঝামেলা এসব কিছু ছাড়িয়েও ভিড়ে ঠাসাঠাসি নিউমার্কেটে অনেকেই ব্যস্ত নতুন জামা কাপড় কিনতে।পুজোর দিনগুলোতে ভালো থাকতে হবে যে।

রেস্টুরেন্ট, শপিং মলে ঠাসাঠাসি ভিড়। জিরো ফিগারের সুন্দরী ললনারা অত্যাধুনিক পোষাকে সুসজ্জিত হয়ে বেড়িয়ে পড়বে। সঙ্গে তাদের বন্ধু ও বান্ধবীরা। রাস্তায় রাস্তায় জনস্রোত মেপে নেওয়ার আগে সকলেরই ডেস্টিনেশন অবশ্যই শপিং মল। সেখানে গড়িয়া হাট, নিউ মার্কেট, হাতি বাগান সবার আগে।

সেই সেকেলে ধুতির চল উঠে গিয়েছে প্রায়। সেই জায়গায় উঠে এসেছে বিভিন্ন ট্যাগলাইন দেওয়া টি শার্ট। তারমধ্যেই চলে এসেছে ঢাকিরা। শনি রবিবার মানে ক্রেতার ঢল বাজারগুলিতে। বিকেলের পর যা জনসমুদ্রে পরিণত। সোমবার মহালয়া। ভিড় আরও বাড়বে। তারপরও রয়েছে টেক শপিং। অনেকে হয়ত আসতে পারেননি শপিং এ। চিন্তা কি! হাতের মুঠোয় যখন আস্ত পৃথিবী। তাই রঙ বলুন, আর ডিজাইন পছন্দ করার জন্যে ফোনেই চলছে শপিং। ভিড়ের চাপে পা রাখার জায়গা নেই ধর্মতলায়। বিরক্তির একশেষ কারো কারো মুখে। এত ভিড় তো পুজোয় ঠাকুর দেখতেও হয় না।

এবারের ফ্যাশনে জামাকাপড় তো বটেই, অন্যান্য কেনাকাটায় সমান দৃষ্টি না দিলে সব পরিশ্রমই কিন্তু ব্যররথ। সেক্ষেত্রে রঙ বাছাই পর্বে, এবারের লেটেস্ট ট্রেন্ড কিন্তু চেরি রেড। একদম সাহসী হতে ঠেকায় কে। গড়িয়াহাট বলুন আর নিউমার্কেট। এই চেরি রেডের চাহিদা এবার বেশ উর্ধ্বমুখী। এছাড়াও রয়েছে উজ্জ্বলতায় ভরপুর হলুদ রঙ।

তবে হ্যাঁ শুধু মেয়েরাই ফ্যাশনদূরস্ত হয়ে উঠবে এই পুজোয় তা তো নয়। ছেলেরাই বা পিছিয়ে কোথায়। শেরওয়ানি থেকে শুরু করে টি-শার্ট, ডিজাইনার স্যুট। সবেতেই পছন্দ হওয়া চাই টপ ক্লাস। পুজোয় পাশের পাড়ার পুচকি, কিম্বা সোনুকে পটাতে হবে তো। যাই বলি না কেন, এটা সহজ সত্যি ফ্যাশন যে কোনও মানুষের সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলতে কতটা সাহায্য করে।

সাবেকি পুজো ছাড়িয়ে কলকাতার পুজো এখন থিম নির্ভর। কোটি কোটি টাকা খরচ হবে পুজোর জন্যে। এখন থেকেই পুজো উদ্যোক্তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ঝলমলে আলোর রোশনাইয়ে সেজে উঠবে রাস্তাঘাট। এখন তো পুজো মানেই এক একটা বিপনন প্যাকেজ। তবে সাবেকিয়ানা যে নেই তা নয়। উত্তর কলকাতার বনেদী বাড়ির পুজো এক্ষেত্রে বেশ পরিচিত। খেলাত ঘোষ পরিবার, মুক্তারাম বাবুর বাড়ি কিম্বা শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো। এছাড়াও আছে মদনমোহন বাড়ি, বাগবাজারের পুজো। এ নিয়ে উত্তর কলকাতা আর দক্ষিণ কলকাতার রেশারেশি পুরনো দিন থেকেই আছে। যা বেশ মজারও বলতে গেলে। দক্ষিণ কলকাতার পুজো বলতে একডালিয়া, শ্রীভূমি, সিঙ্ঘি পার্ক। যা এক কথায় অনবদ্য।

অন্যদিকে কুমোরটুলির ব্যস্ততা কিন্তু চরমে। মহাষষ্ঠীর আগে সব অর্ডার দিতে হবে। তাই রাত বিরেত শিল্পীরা ব্যস্ত। অবশ্য চক্ষুদান পর্ব এখনো বাকি। তাই নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। পূজো আসছে আসছে এই অনুভূতিটাই অন্যরকম। পিঠে পিঠে ঢাক, হাতে কাঠি— শ্যামবাজারের পাঁচ মাথায় ঢাকিদের এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ, গড়ের বাদ্যির জোগাড় নিয়ে হ্যারিসন রোডে ব্যাগ পাইপ আর সানাইওয়ালা ড্রেস পরে কুচকাওয়াজের জন্য তৈরি, গণেশ ঠাকুর ইঁদুর-সহ ঠেলাগাড়ির সওয়ারী, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে তার খাটানো কমপ্লিট, —হ্যালো, ওয়ান…টু…থ্রি, ভলানটিয়াররা রেডি, আর কয়েকটা রাত পোহালেই পূজো। আর্বিট্রেশন, কিংবা বড়সাহেবের চেম্বার দুয়ারে পায়চারি— সহ ইতি, কলকাতায় এখন পুজো। অফিসে অফিসে তালা পড়তে আর বাকি নেই বেশি, হাওড়ার মুট বয়ে বয়ে গরম ট্যাক্সি হুড্ খুলে হাওয়া খাচ্ছে, লালদিঘির টলটলে জলে সাদা মেঘ ভাসছে, টেলিফোন ভবনের ছুটিহীন মেয়েটি জানালা দিয়ে অপলক সেদিকে তাকিয়ে আছে। তবে ব্যতিক্রম কিন্তু তারা। যারা আপনার আমার নিরাপত্তার দায়ীত্বে রয়েছেন। সীমান্তে দূরবীন ঠেকিয়ে যে বাঙালি ছেলেটি পূজো উদযাপন করতে চলেছে, কিংবা পূজোর কলকাতাকে সচল রাখার দায়িত্ব নিয়ে যে গৃহস্থদল ট্রাম আর বাসের কাণ্ডারি, ব্যতিক্রম তাঁরাও। কাঁধের ওপর বিশাল দায়িত্ব। সে সব দায়িত্ব সামলে আবার পরিবারকে সময় দেওয়া। মন আনচান করলেও নিজের দায়িত্বে অটল।

নস্টালজিয়া দিয়ে শুরু, আর নস্টালজিয়া দিয়ে শেষ। পুজো এলেই তো মন কেমন, মন উড়ু উড়ু। এই আসছে আসছে ব্যপারটাই মাতিয়ে রাখে সবাইকে। শপিং নিয়ে হুড়োহুড়ি, পুজোর প্যান্ডেল হপিং, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, খাওয়া দাওয়া। সবমিলিয়ে আবার পরের বছরের জন্যে অপেক্ষা। তবে তাই থাক। শিউলি ফোঁটা ভোর, কাশফুলের নরম আবেগ। কলকাতার সাবেকিয়ানা। মুহুর্তরা ধরা থাক মনের মণিকোঠায়। শুভ শারদীয়া হোক নির্মল আনন্দময়।