ছাত্র রাজনীতির বর্তমান ও ছাত্রদের দায়িত্ব

ছাত্র রাজনীতির বর্তমান ও ছাত্রদের দায়িত্ব

বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি সব সময়ই অগ্রসরমান। অভ্যূদয়ের ইতিহাসে এর গুরুত্বও কম নয়। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ছাত্র রাজনীতির গুরুত্ব বিগত দু-তিন দশক ধরে ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। এমনকি নব্বই দশকের সাথে বর্তমান ছাত্ররাজনীতির তুলনা করলে দেখা যাবে, পার্থক্যটা আকাশ-পাতাল।

কেন ছাত্র রাজনীতির এই বেহাল দশা? সেটার উত্তর খুঁজতে হয়তো খুব বেশি বিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না; শুধু সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই তা বোঝা সম্ভব। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সশস্ত্র সংঘর্ষ, নির্যাতনের মতো কারণগুলো ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে গেছে। মুলত এই বিষয়গুলোর জন্যই অভিভাবকেরা তার সন্তানের রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে অসম্মতি প্রদান করেন। কিন্তু আমরাইবা কি কখনো সঠিকভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পেরেছি? হয়তো পারিনি কিংবা পারছি না! প্রচলিত একথা সত্য যে, সবাই রাজনীতি করলে ড্রোন কে তৈরি করবে? বিতর্ক কে করবে? ব্যাংকার কে হবে? সরকারি আমলাইবা কারা হবে? এরকম প্রচলিত ‘পেশা সচেতন’ প্রশ্নের পরও ‘রাজনৈতিক সচেতনতা’র ব্যাপারটিও থেকে যায়। দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন থাকে।

প্রশ্ন থাকে, যে শিক্ষার্থী একদিন ড্রোন তৈরি করবে বা করছে, সে কি জানার অধিকার রাখে না সীমান্তে ঝুলে থাকা ফেলানীর লাশ নিয়ে কি রাজনীতি চলছে? তার মধ্যে যদি এই ভাবনাটুকু আসাতো তাহলে সে ড্রোনকে প্রতিযোগিতায় প্রদর্শনের বদলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কাজে লাগানোর উপযোগীতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতো।

বর্তমান সময়ে ছাত্র রাজনীতির জন্য বা যে কোন রাজনীতির জন্যই প্রতিকূল সময়। কারণ এখন রাজপথ রাজনীতির জন্য মসৃণ নয়। রাস্তায় সরকার দলের মিছিল ছাড়া অন্য কোন মিছিল নামলেই পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দেয়। জনগণের সুরক্ষার বদলে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভে নির্বিচারে রাবার বুলেট ছোড়ে। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন কিংবা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে সে দৃশ্য দেখা গেছে।

এবার আপনারাই ভাবুন, কিভাবে একজন ছাত্ররা তার রাজনৈতিক উপলব্ধি তৈরি করতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার আগে আমাদের আরও একটি প্রশ্নে উত্তর খুঁজে বের করতে হবে, কেন তরুণ শিক্ষার্থীরা রাজনীতি থেকে এত দূরে? সহজে বলতে গেলে- প্রথমত ছাত্র রাজনীতি বিষয়টায় অনেক ঝুঁকিপূর্ণ, দ্বিতীয়ত সৎভাবে রাজনীতি করলে কোন ‘লাভ’ হয়না এবং তৃতীয়ত, ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হয় সব বখাটে ছেলেরা- এই ধারণাগুলো।

২০১২ সালে জাবির সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সামনে লোকচক্ষুর সামনে খুন হতে হয় জুবায়েরকে। জুবায়েরকে খুন হতে হয়েছিল বাইরে কারও কাছে নয়, এমনকি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কর্মীদের কাছেও নয়। তাকে খুন করেছিল নিজ সংগঠনের সহকর্মীরা। ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দলেই তাকে খুন হতে হয়।

 

এই বিষয় বা প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা যাক। ছাত্র রাজনীতি কেন ঝুঁকিপূর্ণ? পাকিস্তান শাসনামলে কি ছাত্র রাজনীতি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না? তখন কি ছাত্ররা রাজপথে নামেনি? হ্যা তখনো ছাত্র রাজনীতি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তবে ব্যাপারটা হচ্ছে তখন আমরা স্বাধীন ছিলাম না, কারণ তখন পশ্চিম পাকিস্তানের ‘শাসক’ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ছিল ‘শোষক’। যার ফলে ছাত্র রাজনীতি ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে ছিল। সে হিসেবে এখন আমাদের শাসক আমরাই। তবে ভয়টা কোথায়? ভয়টা এই যে, কর্তৃত্ববাদী সরকার আমাদের নিজেদের হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুবায়ের হত্যা একটি বড় উদাহরণ। ২০১২ সালে জাবির সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সামনে লোকচক্ষুর সামনে খুন হতে হয় জুবায়েরকে। জুবায়েরকে খুন হতে হয়েছিল বাইরে কারও কাছে নয়, এমনকি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কর্মীদের কাছেও নয়। তাকে খুন করেছিল নিজ সংগঠনের সহকর্মীরা। ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দলেই তাকে খুন হতে হয়।

এই উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, কেন মেধাবীরা ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছে না? সজ্ঞানে কি তারা মরতে যাবে? তবে উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রনেতাদের সরিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য রাজনীতিতে আসতে হবে মেধাবীদের।

এবার দ্বিতীয় অনুসিদ্ধান্তে আসা যাক, সৎ ভাবে ছাত্র রাজনীতি করলে কোন লাভ হয় না। যে সকল ছাত্রদের মুখে এসব কথা শোনা গেছে তাদের মধ্যে আক্ষেপও যেনো বর্তমান ছাত্রনেতাদের দেখে তাদের মনেও কিছুটা হিংসে আছে, যেনো তাদের ও কিছুটা ইচ্ছা ছিলো বড় নেতাদের ‘পদলেহন’ করে কিছুটা অর্থবিত্তের মালিক হওয়া তাও এই ছাত্রবয়সেই! নাহলে ছাত্ররাজনীতিতে লাভ খোঁজার প্রশ্নটার কোন রকম নৈতিক যুক্তি আমি খুজে পাই না।  এই  অনুসিদ্ধান্তের দ্বিতীয় ধাপটিও একটি প্রশ্ন দিয়েই চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছানো যায়। বাহান্নো-একাত্তর এ যদি ছাত্ররা ওই লাভের আশাতেই রাজনীতি করতো তবে পূর্ব পাকিস্তান কখনো বাংলাদেশ হত না।

নব্বই’র পর থেকেই বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ খুব সুকৌশলেই রাজনীতি থেকে ছাত্রদের আলাদা করে রেখেছে। ছাত্রদল এবং ছাত্রলীগ নামে তাদের যে অঙ্গ সংগঠনদ্বয় আছে সেখানে কিছু ছাত্রদের তারা শুধুই পেশী শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার। ঠিক যেন রাখালের সাথে থাকা কুকুরের মত। আর ছাত্র রাজনীতির খোলসে এই জন্যই চাঁদাবাজি, হানাহানির সংস্কৃতি এসেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

 

তৃতীয় কথাটা একটু ভিন্ন। অনেকেই, বিশেষ করে আমাদের অভিভাবকেরা আক্ষেপ করেই বলেছিলেন “ছাত্র রাজনীতি করে সব বখাটে ছেলেরা”। আর একারণেই তার চান না রাজনীতি করে তাদের সন্তানেরা বখাটে হোক কিংবা বখাটেদের সাথে চলাফেরা করুক। কিন্তু একবার ভেবে দেখেছি কি ছাত্ররাজনীতির গুরুত্ব? একবার কি আমরা এই প্রশ্ন তুলেছি যে বখাটে সবাই যদি রাজনীতি করে তবে দেশের ভবিষ্যৎ কোথায় যাবে? বা এই বখাটে যাদের বলছি আদৌ কি তারা বখাটে নাকি সঠিক নেতৃত্বের অভাবে বখাটে? কিন্তু না আমরা প্রশ্ন করি না কখনো। প্রশ্ন করতে যেনো আমাদের নিষেধ। আর প্রশ্ন করবই বা কার কাছে? উত্তরটাইবা কিভাবে দেবে, কে দেবে?

শ্রেফ ‘তরুণরা রাজনীতি থেকে কেন এত দূরে?’ এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কয়েকটা অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের আবর্তন করতে হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের ইতিহাস শুরু হয়েছিল ছাত্র রাজনীতির হাত ধরে। এ দেশের সকল সফল আন্দোলন করেছে ছাত্ররা কিন্তু সে দেশের ছাত্র আর তরুণদের রাজনীতিতে এখন এত অবহেলা কেন? নব্বই’র পর থেকেই বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ খুব সুকৌশলেই রাজনীতি থেকে ছাত্রদের আলাদা করে রেখেছে। ছাত্রদল এবং ছাত্রলীগ নামে তাদের যে অঙ্গ সংগঠনদ্বয় আছে সেখানে কিছু ছাত্রদের তারা শুধুই পেশী শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার। ঠিক যেন রাখালের সাথে থাকা কুকুরের মত। আর ছাত্র রাজনীতির খোলসে এই জন্যই চাঁদাবাজি, হানাহানির সংস্কৃতি এসেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। যা সত্যিকার অর্থে ভয়াবহ। আর এই চক্রান্ত থেকে ছাত্র রাজনীতিকে কখনোই বের হতে দেবে না প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন মহল আর তাই ছাত্রদের ভাবতে হবে নতুন করে। জানি বিষয় টা সিলেবাস বহির্ভূত। তারপরও সিলেবাসের বাইরে গিয়ে ভাববার সময় এসেছে। ছাত্র রাজনীতির এই কালো থাবা থেকে মুক্ত হতে, ছাত্রদেরকেই মাঠে নামতে হবে। চর্চা করতে হবে সুষ্ঠু রাজনীতির।