উড়ে যাও পুতুল রাহেলার কাছে

উড়ে যাও পুতুল রাহেলার কাছে

– চাচা, আইজ বিকিকিনি কেমন?

– আর বিক্রি! শহরের পুলাপাইন কি কাগজের পুতলা কিনে? তাও কয়ডা বেচছি …

কথাটা শেষ না করে পথে নেমে পরে রহিম মিঞা। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। সোজা হয়ে দাঁড়াতেও এখন এখন কষ্ট হয়। ধানমন্ডির সিগন্যালে কাগজের পুতুল ফেরি করে সংসার চলে তার। আসলেই কি চলে? কোনো রকমে খাবারটাই জোটে শুধু। যার কাছ থেকে পুতুল আনে তার টাকা, সিগনালে দাড়ানোর টাকা, মাস শেষে টাকা… এসব দিয়ে আর থাকে? তবু, দৌড়াতে হয়, হাসিমুখে ইনিয়ে বিনিয়ে পুতুল বিক্রির চেষ্টা করতে হয়।

– বাজান নেন না একটা পুতলা, দেখেন কি সন্দর লড়ে চড়ে

সিগন্যালে আটকে পড়া একটি গাড়ির সামনে গিয়ে নানা ভঙ্গিমায় একটি বাচ্চাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন রহিম মিঞা। কিন্তু সাউন্ড প্রুফ গ্লাস ভেদ করে তার সে কথা ভেতরে যায় না, কালো কাচের আবরণের বাহির দিয়ে বোঝা যায় শুধু অবয়বটুকুই। সিগন্যাল ছেড়ে দিতেই দৌড়ে ফুটপাথে উঠে পড়ে রহিম মিঞা। পাশে এসে বসে হালিম। বয়স কত হবে? বারো-চৌদ্দ? ও বিক্রি করে বাদাম।

– কাকা, গেছে কয়ডা?

– দুইডা গেছে রে বাজান। এই দিয়া কি চলব ক?

– তুমার পুলাপাইন নাই?

রহিম মিঞা উদাস হয়ে যায়। বড় ছেলেটাকে পড়ালেখা শেখাতে পারেননি, গার্মেন্টেসের কাজে লেগে কি করে যেন ভালো পোস্টে চলে গিয়েছে। কিন্তু একেবারেই চলে যাওয়া যাকে বলে। বাবা-মা যে আছে সে কথা তো সে ভুলেছে সেই কবেই। পরেরটা মেয়ে। মেয়েও গার্মেন্টেসেই কাজে লেগেছিল। সে নাকি ঐখানেই কাকে ভালোবেসে বিয়েও করে ফেলেছে। বিয়ের আগে প্রতি মাসেই বাবার জন্য এটা সেটা নিয়ে আসত সে। এখন আর পারে না। জামাইটা নাকি নেশা করে। বাবাকে টাকা পাঠিয়েছে শুনলেই মারধর করে। তাও মেয়েটা আসে। কি সুন্দর ফুটফুটে ছিল মেয়েটা। রহিম মিঞা বড় শখ করে নাম রেখেছিল পরী। এখন তাকে চেনাই যায় না। শুকিয়ে কালো হয়ে কেমন হয়ে গিয়েছে পরী! রহিম মিঞা নিজেই তাকে বারণ করে দিয়েছে আসতে। এত আদরের মেয়ে, অমন চেহারা সহ্য হয়! অসহায় বাপ, নিজের কাছেও যে এনে রাখবে সে উপায়ওতো নাই। তারপরের ছেলেটা মারা গিয়েছে। শেষ ছেলেটা সবচেয়ে বড় আঘাত দিয়েছে রহিম মিঞাকে। রহিম মিঞা তখন রিক্সা চালাত। খেয়ে না খেয়ে ছেলেটাকে পড়িয়েছিলেন, যাতে পড়ালেখা শিখে মস্ত অফিসার হয়ে সংসারের হালটা ধরে। সে মস্ত অফিসার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে রিক্সাচালক বাপের পরিচয় দিতে লজ্জা হয়! রহিম মিঞায় স্ত্রী রাহেলা মারা গিয়েছেন প্রায় পনেরো-ষোল বছর। তারপর থেকেই রহিম মিঞা অপেক্ষা করে আছেন রাহেলার কাছে যাওয়ায়।

– ও কাকা…

হালিমের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে রহিম মিঞার।

– হু?

– কুন চিন্তায় ডুব দিছিলা? জিগাইলাম তুমার পুলাপাইন নাই? এই যে থ খাইলা!

– আছে রে বাজান! একডা না, তিনডা আছে। কিন্তু তাগোর বাপ নাই!

– মানে?

– তুই বুঝতি না, ল দুইডা মুখে দিয়া লই কিছু। সিগনাল পরলেই তো আবার খাড়ান লাগবো।

পাশে একটা ভ্যানে ভাত বিক্রি করে শরীফার মা। এক প্লেট ভাত, ডাল দশ টাকা। ও দিয়েই দিব্যি চলে যায়। কিন্তু রান্না ছিল রাহেলার। মুখে দিলেই মনে থাকত। আজ বারবার রাহেলার কথা মনে পরছে কেন, কে জানে?

খাবার পর একটু তন্দ্রামত আসে রহিম মিঞার।

– হালিম রে, আমি একডু চোখডা বুজি সিগনাল পরলে ডাক দিছ রে বাজান।

বলে চোখটা বুজে রহিম মিঞা। চোখে সামনে জীবন্ত হয়ে উঠে রাহেলা, তার ছেলে মেয়েরা। কত আব্দার ছিল তাকে ঘিরে একটা সময়। লাল ফিতা, কাঠের পিস্তল, মেলার বাতাসা। শরীরটা একটু ঠাণ্ডা হয়ে আসে। ফেলে আসা সুখে? হবে হয়তো। আবার চোখের সামনে আসে রাহেলা। স্বামীর সেবাই ছিল যার ধর্ম। কথার মারপ্যাঁচও বুঝত না, বুদ্ধির মারপ্যাঁচও না। সব সময়ই মুখে একটা হাসি থাকতো। কি এমন সুখ দিয়েছিল তাকে রহিম মিঞা যে রাহেলার হাসিই সরত না?

– এই জওয়াব জাইনা আপনে কি করবেন?

কে? কে কথা বলে? চমকে যায় রহিম মিঞা। রাহেলার গলার স্বর এত বছর পরেও চিনতে ভুল হয় না।

– তুমি?

– তুমি, তুমি করতেছেন কেন? আমি রাহেলা। আপনে এরাম শুকায়া গেছেন কেন?

চোখ দিয়ে পানি নামে রহিম মিঞার। সম্বিৎ ফিরে পেতেই দেখে তাকে ধাক্কাচ্ছে হালিম!

– কি ঘুম দিছ কাকা? কাল বৈখাশ ছাড়ছে, তুফান আইতেছে, বড় তুফান। ও কাকা?

রহিম মিঞা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে হালিমের দিকে। হালিমের পিছনে উড়ে যাচ্ছে তার কাগজের পুতুল। ঠিক মত বাঁধা হয় নি, বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার সব পুঁজি। ভেজা চোখটা মুছে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে রহিম মিঞা। ধুলোর জন্য খুব বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। আচ্ছা? আসমান কতদুরে? এই পুতুলগুলো কি রাহেলা পর্যন্ত পৌছাতে পারবে? রাহেলা যে পুতুল খুব ভালোবাসত …