আতঙ্কের নাম ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’

আতঙ্কের নাম ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’

রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের চিরচারিত নিয়মে বিতর্ক ও কঠোর সমালোচনার পরও জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে পাশ হয়ে গেল ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮। আইনটি নিয়ে পূর্বেই সমালোচনা চলছিল, তা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমের কর্মীরা। তাদের আশঙ্কা, আইনটির অনেক ধারায় হয়রানি ও অপব্যবহার হতে পারে।

এই আশঙ্কা যে একেবারেই ভুল নয়, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে বিতর্কিত ৫৭ ধারার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। ৫৭ ধারায় মুহূর্তে গ্রেফতার হয়েছে দেশের গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা। শহিদুল আলম, আসিফ নজরুল, ফাহিম মাসরুরের মতো ব্যক্তিদের হাতে পড়েছে হাতকড়া। তাদের কর্মকাণ্ড কতটুকু অপরাধ। সে বিষয়টিও আমরা জানি। প্রত্যেকেই স্বীকার হয়েছে চরম হয়রানির। ৫৭ ধারার এই ভয়াবহ অপব্যবহার আইনটিকে জনগণের রোষের মুখে ফেলেছে। সরকারকে একরকম বাদ দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রে আধিপত্য বজায় রাখতে ক্ষমতার একেবারে শেষ মুহূর্তে । ৫৭ ধারারই একটা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলো সরকার। ডিজিটাল আইনের ২৫, ২৮, ২৯ এবং ৩১ ধারায় সুকৌশলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।

এই কৌশলের বিরুদ্ধে খসড়ার সময় থেকেই সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মীসহ অন্যান্যরা উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। ডিজিটাল আইনেও ৫৭ ধারার মতো ধোঁয়াশা রাখা হয়েছে এর অপরাধ সম্পর্কে। এ আইনের উদ্দেশ্য যে সরকারের সমালোচনা ও ভিন্ন মত প্রকাশকারীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সে কথা স্পষ্ট। যার ফলে জনসাধারণ ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়।

নিচে ‘ডিজিটাল আইন ২০১৮’র সারসংক্ষেপ দেয়া হলো :

  • ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জন শৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা ব্লক বা অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এক্ষেত্রে পুলিশ পরোয়ানা বা অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেপ্তার করতে পারবে।
  • আইনে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করা হয়েছে। ফলে কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয়, বা প্রকাশ করে বা কাউকে করতে সহায়তা করে ওই আইন ভঙ্গ করলে এই আইনে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা হতে পারে, ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
  • কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত যদি কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে তা গুপ্তচরবৃত্তি বলে গণ্য হবে এবং এজন্য ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।
  • আইন অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার নামে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালালে বা মদদ দিলে অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
  • ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ঘৃণা প্রকাশ, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ বা ব্যবহার করলে জেল জরিমানার বিধান রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তিন থেকে সাত সাত বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। দ্বিতীয়বার এরকম অপরাধ করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
  • ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণা করলে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড, ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড হতে পারে।
  • কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের বিষয়েও বিধান রয়েছে এই আইনে। সেখানে ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, কম্পিউটার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম. কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ডিভাইস, ডিজিটাল সিস্টেম বা ডিজিটাল নেটওয়ার্কে প্রবেশাধিকার ব্যাহত করে, এমন ডিজিটাল সন্ত্রাসী কাজের জন্য অপরাধী হবেন এবং এজন্য অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড অথবা এনধিক এক কোটি অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
  • ছবি বিকৃতি বা অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছেকৃতভাবে বা অজ্ঞাতসারে কারো ব্যক্তিগত ছবি তোলা, প্রকাশ করা বা বিকৃত করা বা ধারণ করার মতো অপরাধ করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। ইন্টারনেটে পর্নগ্রাফি ও শিশু পর্নগ্রাফির অপরাধে সাত বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
  • কোন ব্যাংক, বীমা বা আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান থেকে কোন ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আইনানুগ কর্তৃত্ব ছাড়া অনলাইন লেনদেন করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
  • বাংলাদেশ বা বিশ্বের যেকোনো বসে বাংলাদেশের কোন নাগরিক যদি এই আইন লঙ্ঘন করেন, তাহলেই তার বিরুদ্ধে এই আইনে বিচার করা যাবে।
  • ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। অভিযোগ গঠনের ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে এর মধ্যে করা সম্ভব না হলে সর্বোচ্চ ৯০ কার্যদিবস পর্যন্ত বাড়ানো যাবে।

সুতরাং এটা স্পষ্ট যে ‘ডিজিটাল আইন ২০১৮’ ৫৭ ধারার চেয়ে ভয়াবহ। এতে করে সবচেয়ে বেশি সমস্যার মধ্যে সাংবাদিকরা। যে সকল ধারায় তারা দোষী সাব্যস্ত হতে পারে তা সম্পূর্ণ জামিন অযোগ্য। একজন সাংবাদিক কখনোই একজন মন্ত্রীর ঘুষ নেয়ার দৃশ্য তার অনুমতি নিয়ে ধারণ করবে না। কিন্তু গোপনে তা ধারণ করলে সে অপরাধী গণ্য হবে এতে করে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব বাধাগ্রস্ত হবে। আর জন হয়রানিতো রয়েছেই। সাধারণ মানুষ মত প্রকাশ করলে তার জন্য যে কোন মুহূর্তে অপরাধী বলে গণ্য হতে পারেন।