ইসলামের ইতিহাসে ন্যায়বিচারের বিরল দৃষ্টান্ত

ইসলামের ইতিহাসে ন্যায়বিচারের বিরল দৃষ্টান্ত

কুতাইবা ইবনে মুসলিম ছিলেন উমাইয়া শাসকদের অন্যতম বিজয়ী সেনাপতি। সমরকন্দ পুরোটা জুড়ে ছিল নগররক্ষা দেয়াল। একবার তিনি অকস্মাৎ সমরকন্দ আক্রমণ করে সমরকন্দবাসীদের অবরুদ্ধ করে ফেলেন। সমরকন্দবাসীরা ইতোপূর্বে চীন ও ফারগানার শাসকদের সাথে মিত্রতা তৈরি করে মুসলিমদের সাথে লড়াই করে আসছিল। এবার তারা অসহায় অবস্থায় তাদের কাছে নিজেদের জন্য সাহায্য চায়। চীনের অধিপতির নেতৃত্বে একটা বিশাল বাহিনী আরবদের মোকাবেলায় এগিয়ে আসে। তাদের পরিকল্পনা ছিল, রাতের আধারেই মুসলিম বাহিনীর উপর হামলা করবে। কিন্তু কুতাইবা এই কৌশল বুঝতে পেরে সালেহ বিন মুসলিমের নেতৃত্বে ৬০০ জনের বাহিনী প্রেরণ করেন। ডানে ও বামে মাত্র ২০০ জন করে ৪০০ জন এবং সম্মুখে ২০০ জনের শিবির স্থাপন করে সৈন্য মোতায়েন করেন, যাতে শত্রু সৈন্যের উপর তিন দিক থেকে হামলা করা যায়। এই কৌশলে চীন ও ফারগানার সম্মিলিত সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয় সামনে ও পেছনের উভয়দিকের আক্রমণে ভীত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

ইতোমধ্যে অবরোধ একমাস অতিক্রান্ত হয়। সাহায্যকারী বাহিনীর পরাজয়ে সমরকন্দবাসীর মনোবল ভেঙে পড়ে। মুসলিম বাহিনীও কামানের সাহায্যে নগরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরে পাথর নিক্ষেপ শুরু করে। ফলে সমরকন্দবাসী সন্ধির প্রস্তাব পাঠায়। কুতাইবা ও সমরকন্দের শাসকদের-এর মধ্যে তিন শর্তে সন্ধি হয়। ১. সমরকন্দবাসী ২২ লক্ষ দিরহাম কর প্রদান করবে। ২. মন্দির, মূর্তি এবং অগ্নিপূজকদের অগ্নিকুণ্ডের ব্যাপারে মুসলমানদের অধিকার থাকবে। ৩. মুসলমানগণ মসজিদ নির্মাণ করবে এবং নামাজ পড়বে, মুসলিম সৈন্যদের তিনদিন পর্যন্ত মেহমানদারি করা হবে। এরপর মুসলমানগণ শহরে প্রবেশ করেন। সমরকন্দ হচ্ছে উত্তর এশিয়ার এমন ভূমি যা সিল্করোডের সংযোগ অঞ্চল হওয়ায় ধনী অঞ্চল ছিল। প্রচুর সোনা ও রূপার মত মূল্যবান খনিজসমৃদ্ধ অঞ্চল এটি। ফলত মন্দিরগুলো সমৃদ্ধ ছিল। মূর্তি ছিল সোনার, সন্ধির শর্তানুযায়ী কুতাইবা এগুলো গলানোর নির্দেশ দিলেন। সমরকন্দবাসীরা বললো- আমরা এগুলো না জ্বলানোর পরামর্শ দিচ্ছি। নতুবা আপনারা ধ্বংস হয়ে যাবেন। কুতাইবা বললেন, তোমাদের বিশ্বাস যদি এই হয়, তবে আমি তা নিজহাতে প্রজ্জ্বলন করছি। এরপর মূর্তিগুলো থেকে ২৫০০ মণ স্বর্ণ পাওয়া গেল। নিজেদের উপাস্যদের এমন অবস্থা দেখে সমরকন্দবাসীদের অনেকেই মুসলিম হয়ে গেল।

এটা ছিল ৭১২ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। এর পাঁচ বছর পর উমার ইবনে আব্দুল আজিজ মুসলিম জাহানের খলিফা হন। তখন সমরকন্দের প্রধান পুরোহিতের পক্ষে থেকে এক ব্যক্তি তার নিকট যান। খলিফা তখন নিজের ঘরের দেয়াল নিজ হাতে মেরামত করছেন। সেই ব্যক্তি প্রবল বিস্মিত হন। অতঃপর তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘ইসলামের কী নীতি এটাই নয় যে, তারা যখন কোনও দেশ দখল করতে চায় প্রথমে তাদের ইসলামের আহ্বান জানায় কিংবা তাদেরকে করের শর্তে বশ্যতার আহ্বান জানায় এবং সে দেশের মানুষ এই দুইয়ে সম্মত না হয়, তখনই যুদ্ধের আহ্বান জানায়।’ খলিফা বললেন। ‘এটাই নিয়ম।’ আগন্তুক বললেন, কুতাইবা আমাদের উপর ঘোষণা ছাড়াই আমাদের উপর আক্রমণ করেছে। খলিফা অভিযোগ নথিবদ্ধ করতে নির্দেশ দেন। একইসাথে সমরকন্দের গভর্নরকে একজন ঈমানদার কাজী তথা বিচারক নিয়োগের নির্দেশ দেন যিনি ফায়সালা করবেন। একইসঙ্গে গভর্নরকে বলেন, তিনি যেন কুতাইবার হয়ে আদালতে শুনানির জন্য হাজির হয়। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে কাজী ফায়সালা দেন যেহেতু ইসলামি যুদ্ধনীতি ব্যাহত হয়েছে তাই সমরকন্দ দখল অবৈধ। মুসলিমগণ শহর হস্তান্তর করে অনতিবিলম্বে সেই পূর্বের সেনাছাউনিতে ফিরে যাবে। অতঃপর পুনরায় যুদ্ধ কিংবা সন্ধি করে শহরে প্রবেশ করবে। এই বিচারে প্রধান পুরোহিত বিস্মিত হন। লোকদের মাঝে ঘোষণা, ‘এটা অবশ্যই সত্য ধর্ম’। তিনি এবং অন্য অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সমরকন্দবাসী মুসলিমদের শাসনে থাকাটাকেই পছন্দ করে।

 

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি :
*تاريخ الرسل والملوك
* الكامل في التاريخ
* The end of the jihad state: The Reign of Hisham Ibn ‘Abd al-Malik and the Collapse of the Umayyads, Khaled Yahea Blanckship