একাদশ সংসদ নির্বাচন আসন্ন। আগামী ২৭ ডিসেম্বর নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অন্যদিকে একাদশ জাতীয় সংসদের জন্য অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে আকারে ছোট একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তার বক্তব্য অনুযায়ী, অক্টোবরে যে সরকার গঠন করা হবে সে সরকারে বাইরের কেউ ও টেকনোক্রেট থেকে কেউ আসবে না এবং সরকারের আকার ছোট হবে। তবে জাতীয় পার্টি থেকে দু-একজন এই মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন ওবায়দুল কাদের।
আমরা জানি, আদালতের একটি রায়কে অবলম্বন করে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। এরপর দশম নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। দেখা যায়, নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপিসহ ৭০ শতাংশ রাজনৈতিক দল ঐ নির্বাচন বর্জন করে। ৩৯টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণে করে মাত্র ১২টি দল। পরে নজিরবিহীন একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে বর্তমান সরকার গঠন করা হয়। ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা প্রশ্ন ওঠে।
অতীতে যে কয়টি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে তার সবগুলোতেই ক্ষমতাসীন দল জয়লাভ করেছে। এ ব্যবস্থায় সরকার বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। আর যে কয়টি নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে তার সবগুলোই সর্বশেষ ক্ষমতাসীন দল পরাজিত হয়েছে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিগত পাঁচ বছরেও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে নতুন করে কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা হয়নি। তাই বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে প্রক্রিয়ায় তথা যে সাংবিধানিক কাঠামোতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, ধরে নেয়া যায় যে একই কাঠামোতেই অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অর্থাৎ সংসদ বহাল রেখেই অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় নির্বাচন। এ প্রসঙ্গে সংবিধানে ১২৩নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে (ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে’। উল্লেখ্য, আমাদের সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই। অন্য অর্থে বললে, ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ বলে সংবিধানে কোনো বিধান নেই। বিদ্যমান সরকারই নির্বাচন আয়োজনে কমিশনকে সার্বিকভাবে সহায়তা করবে। তবে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সংবিধানে কিছু ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন, সংবিধানের ৫৬ (৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘(৪) সংসদ ভাংগিয়া যাওয়া এবং সংসদ-সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে এই অনুচ্ছেদের (২) বা (৩) দফার অধীন নিয়োগদানের প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার অব্যবহিত পূর্বে যাহারা সংসদ-সদস্য ছিলেন, এই দফার উদ্দেশ্যসাধনকল্পে তাহারা সদস্যরূপে বহাল রহিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন’। এর অর্থ হলো যদি কোনো কারণে সংসদ ভেঙে দেয়া হয় অথবা সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়, তথাপিও সংসদ সদস্যরা তাদের পদে বহাল থাকবেন, তবে ওই সময় সংসদের অধিবেশন বসবে না। তবে সংসদ সদস্যরা যেসব সুযোগ-সুবিধা এবং প্রিভিলেজ (বিশেষ সুবিধা) ভোগ করে থাকেন, সংসদ ভেঙে দেয়ার হলে সেগুলো অব্যাহত থাকবে কি-না, সেটি স্পষ্ট নয়।
আরেকটি বিষয় হলো, নির্বাচনকালীন যে মন্ত্রিসভা গঠিত হবে তার সদস্য নেয়া হবে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেই। এর অর্থ হলো যে দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে গঠিত নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপির অংশগ্রহণের সুযোগ থাকলেও এবার যেহেতু বিএনপি সংসদের বাইরের একটি দল, তাই তাদের মধ্য থেকে কাউকে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় নেয়ার সুযোগ সংবিধানে নেই। সম্প্রতি ওবায়দুল কাদেরও তার বক্তব্যে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন।
আপোসের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক বাতিল না হওয়ায় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। কারণ বর্তমান সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যেই পরবর্তী মেয়াদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং তা বর্তমান সংসদ বহাল রেখেই। এই বিধান বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড’ বা সবার জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা যাবে না।
উপরোক্ত বিশ্লেষণের সারাংশ দাঁড়ায় যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকাবস্থায়ই অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কোনো কারণে নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়া হলেও তা সরকারের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। সংবিধানের ৫৭ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনোকিছুই অযোগ্য করিবে না।’ এর অর্থ হলো, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের সময় স্বপদে বহাল থাকবেন, বহাল থাকবে তার ছোট আকারের মন্ত্রিসভা। আর এই অবস্থাতেই নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আপোসের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক বাতিল না হওয়ায় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। কারণ বর্তমান সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যেই পরবর্তী মেয়াদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং তা বর্তমান সংসদ বহাল রেখেই। এই বিধান বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড’ বা সবার জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা যাবে না। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে প্রতিযোগিতামূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে কি-না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে কোথাও কোনো অনিয়ম হবে না—এমন নিশ্চয়তা দেওয়ার সুযোগ তাঁর নেই’। তাছাড়া অতীতে যে কয়টি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে তার সবগুলোতেই ক্ষমতাসীন দল জয়লাভ করেছে। এ ব্যবস্থায় সরকার বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। আর যে কয়টি নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে তার সবগুলোই সর্বশেষ ক্ষমতাসীন দল পরাজিত হয়েছে।
তাই আমরা মনে করি, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হওয়া জরুরি, যাতে দশম জাতীয় নির্বাচনের মত আমাদেরকে আরেকটি একতরফা নির্বাচন দেখতে না হয়। আশা করি, আমাদের সম্মানিত রাজনীতিবিদ ক্ষুদ্র স্বার্থের বিপরীতে আমাদের গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিতে জনগণের কাঙ্ক্ষিত উদ্যোগ নেবেন এবং বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেবেন।