এ জার্নি উইথ পোয়েট্রি অ্যান্ড ফর ‍রিফ্রেশমেন্ট

কুয়াকাটা ভ্রমণের গদ্য

এ জার্নি উইথ পোয়েট্রি অ্যান্ড ফর ‍রিফ্রেশমেন্ট

সমুদ্র কি তোমার ছেলে/ আদর দিয়ে চোখে মাখাও— সঞ্জীব চৌধুরির গানটির সাথে আমাদের শহর ছাড়া। আদতে ঘুরতে যাওয়ার একটা দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিলো আমাদের। চন্দ্রনাথ, গুলিয়াখালী, বাঁশবাড়িয়া, কক্সবাজার, সুপ্তধারা ঝর্ণা। কিন্তু সেসবকে উপেক্ষা করে যখন মনে হলো, এই শহরে আমরা পঁচে যাচ্ছি। তখন সমুদ্র স্নানের সাধ জাগলো। বিশাল সমুদ্রের সামনে একটু কাঁদতে ইচ্ছে হলো। ইচ্ছে হলো সৈকতে শুয়ে বৃষ্টিতে ভিজি। মূলত সমুদ্র দেখার বয়স লাগে। সে বয়স যতদিন না হয়— প্রেমিকা প্রত্যাখান করে, সমুদ্র কাঁদায় না, সৈকত পিছুটান দেয় না। আর চোখের সামনে ভেসে ওঠেনা স্প্যানিশ নাবিকের ছবি, যার বুকে বহুদিন ধরে লেগে আছে প্রেমিকার চুলের ঘ্রাণ।

বাসের টিকিট কাটা হয়েছিল সাড়ে ছয়টার। সাকুরা পরিবহনের। আমরা ছিলাম ছয়জন। আমি, কবি আহমেদ মুসা, ফটোগ্রাফার মাসুম বিল্লাহ আর বিভাগের তিনজন ছোটভাই। মামুন, মুহাইমিনুল, আল আমিন। যাদের সাথে আমাদের আড্ডাগত দুরত্ব নেই বললেই চলে। বাসে আমাদের যাত্রা ছিলো দীর্ঘ। আবহাওয়া মেঘলা ছিলো। রওনা হওয়ার আগ মুহূর্তেও বৃষ্টি হয়েছিলো। রাস্তা ছিলো ভেজা। তারপরও মুহাইমিনুলের মত ছিলো সূর্যোদয় দেখার। কিন্তু যখন কুয়াকাটায় নামলাম। ঝুম বৃষ্টি। সারা রাস্তা ছিলো পাগলামির। বিশেষত মামুন আর আল আমিন ছিলো বেশি আনন্দে। আর সে আনন্দের হুজুগে হেডফোন, আলুর চিপস। আল আমিন অবশ্য বাসা থেকে নুডুলস নিয়ে এসেছিলো। ওর বোনের রান্নার প্রশংসা করতে হয়। বেশ সুস্বাদু ছিলো। ফেরিতে উঠে সবাই চলে গেলাম সোজা ছাদে। ছাদেই প্রথম আমাদের যে যার স্বভাবে চলে গেলাম। খাওয়া হলো ঢাউস সাইজের পেয়ারা।

সমুদ্র সৈকতে নারকেল গাছের উপর বসে বিশ্রামরত লেখক ও আলোকচিত্রী মাসুম। ছবি: আহমেদ মুসা

জলের কাছে গেলে মানুষ কবি হয়ে ওঠে। যে কেউ! মেঘলা আকাশে দু’পাশে অন্ধকারের মধ্যে বিস্তীর্ণ সবুজ। কোথাও একটু আধটু আলো। চায়ের দোকান। ঠাণ্ডা বাতাস পেরিয়ে ছুটে যাচ্ছে ছাপ্পান্ন সিটের একটি বাস। তার জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে একজন তরুণ কবির কবিতা। আর তারপর পদ্মার উন্মুক্ত ঢেউ। জলের উপর আলোর চুম্বন অনায়াসে উচ্চারণ করালো— রাতের পদ্মাকে সুদীপা’র মতো মনে হয়! সুদীপা এখানে প্রতীকি। সুদীপা’র ব্যকরণগত পরিচয় সে আমাদের জুনিয়র ছাত্রী। মূলত কবিতা সৎ এবং প্রকৃতি কখনোই বিশ্বাসঘাতক নয়। সুদীপা’র যৌবন আর মুহাইমিনুলের এক লাইন অশ্লীলতা নিয়ে আমরা পার হয়ে যাই পদ্মা। আমি ঝিঝি ডাকা রাতে প্রিয় বন্ধুর সাথে হেঁটে যাবার গল্প শোনাই। আমি ঘাসের গলা পর্যন্ত জমা পানির গল্প শোনাই। মুসাও গল্প বলে, আমার মনে থাকে না। আমি তখন জীবনানন্দের শহরে ঢোকার জন্য উদগ্রীব। আমি প্রতিটা জানালার দিকে তাকিয়ে থাকি। কেউ কোথাও জানালা ধরে বসে নেইতো আবার।

কুয়াকাটা নামার পর ঝুম বৃষ্টিতো আগেই বলেছি। তখন মাত্র ফজরের আজান দেয়। দোকানের ঝাপের নিচে আশ্রয় নিয়েছি আমি আর মাসুম। মুসা ওদের নিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃষ্টি কমার পর সোজা চলে গেছি সৈকতে। ঠাণ্ডা বাতাস আর সমুদ্রের ঢেউ সকালেই মনটা ভালো করে দিয়েছিল। আমরা যখন সমুদ্রের ঘাটে মুসা সিগারেট ধরিয়েছিলো। সেটা আবার দুটো ছেলে দেখেছিলো। আমরা যখন সৈকতে নেমেছি। ছেলে দু’টো ফিরে এসে সিগারেট চাইলো। সকালে তখনো দোকান খোলেনি। সিগারেট যারা খায় তারা নাকি এমন করে। অদ্ভূদ ব্যাপার না। সাতটার দিকে হোটেলে ফোন দিলাম। আমরা অবশ্য ঢাকা থেকেই বুকিং দিয়ে এসেছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম চেক ইন কখন। তিনি বললেন, আসেন আপনাদের একটা রুম দিচ্ছি ফ্রেস হন, পরে আপনাদের রুম খালি হলে চেক ইন করবেন। গিয়ে দেখি রুম খালি। তিন বেডের দুই রুম ছিলো আমাদের। হাতমুখ ধুয়ে সমুদ্রের কিনারা ধরে পূর্ব দিকে হেটে যাবার সিদ্ধান্ত নিই। যাবার পথে মাঝে মাঝে ছবি তোলা চলছে। কারণ, মাসুমের ক্যামেরাতো সাথেই ছিলো। কুয়াকাটা বোটানিক্যাল গার্ডেন যাওয়ার আগে আমরা বাগদা চিংড়ির পোনা ধরা দেখলাম। প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে বোঝা গেলো ব্যাপারটা। একটা চায়ের দোকানে চা খেয়ে সবাই যে যার মতো সমুদ্র দেখতে লাগলাম। মাসুম গাছে হেলান দিয়ে, মুহাইমিনুল নৌকায় বসে, মামুন আর আল আমিন পানিতে নেমে, মুসা দোলনায় আর আমি একটা চৌকিতে।

অদূরে গল্পে মগ্ন কবি আহমেদ মুসা ও লেখক। ছবি: টিএম মাসুম বিল্লাহ

বিশাল সমুদ্রের কাছে যার যা পাওনা মিটিয়ে নেয়ার কথা কোন একদিন বলেছিল কেউ। সম্ভবত সেদিন তার হাতে আন্না ফ্রাঙ্কের ডাইরি ছিলো অথবা এক গোছা কচুরি ফুল। মনে নেই, কিছু মানুষের কথা মনে না করাই বোধ হয় ভালো। আর সেই পাওনা মিটিয়ে নেবার দিনে, সূর্য মেঘে ঢাকা। অবারিত নীল জল ছুয়ে উঠে আসছে বাতাস। আমার কাঁদতে ইচ্ছে হলো। সমুদ্রের কাছে এসে না কেঁদে আমি ফিরে যাবো? না, আমি যেতে পারি না। আমার প্রতীক্ষায় কাতর হৃদয় আমাকে নিয়ে যায় একটি নিঃসঙ্গ গ্লাডিউলাসের মতো ফুটে থাকা নারীর কাছে। এই সময়গুলোতে কোলাহলের মধ্যেও মানুষ নিঃসঙ্গ থাকে, মানুষ শ্রেফ মনে করে প্রিয়তমার হৃদয়, মানুষ অনুভব করে তার অজস্র দুঃখ, সে দু’ফোটা চোখের জলে ফেলে যেতে চায় বিগত সময়ের সমস্ত যন্ত্রণা, রাতে ঘুমোতে না পারার মধুর স্মৃতিগুলো। মূলত সমুদ্রের কাছে গেলে মানুষকে কাঁদতে হয় প্রকাশ্যে অথবা অন্তরালে এবং মানুষ কাঁদে। সমুদ্রের কাছে সে ভীষণ ছোট।

ওইদিন দুপুরে খেয়ে আমরা মোটামুটি বিশ্রাম নিলাম। একটা ছোট খাটো ঘুমও দিয়েছিলাম কেউ কেউ। তারপর বিকালে কি করলাম মনে নেই। দোকানগুলো একটু ঘুরে দেখেছিলাম। রাতে খাওয়া দাওয়া করে, কিছু আজে বাজে গল্প করেছিলাম। রাতে সমুদ্রের পাড়ে গিয়েছিলাম। একটা ছেলের গান শুনেছিলাম আমরা। মাসুম না মুসা যেন তাকে কিছু টাকাও দিয়েছিল। মনে নেই। পরদিন দুপুরের আগে গোসল করলাম। আহমেদ মুসা গেলো মহুয়া আনতে। মহুয়ার দাম ঠিক ভূতে যোগালো আর রাতের গল্প না হয় নাই করলাম। তবে আল আমিনকে মনে থাকবে চিরকাল। দ্বিতীয় দিন রাতে কেনাকাটা করলাম কিছু। আমার আর মাসুমের চাপটা ছিল বেশি। ওর গার্লফ্রেন্ড আমার অবশ্য অন্য ব্যাপার- ভাই-বোন আর বান্ধবী। দ্বিতীয় দিন রাতে মাসুম দুইটা চৌকি ভাড়া করেছিলো। তিনজনে মিলে সমুদ্র দেখতে শুয়েছিলাম। আর বিশ টাকার বাদাম। খারাপ ছিলো না। বাদাম নাকি শেষই হচ্ছিল না। পরদিন আমরা রওনা হয়েছিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। ‘নিরাপদ সড়ক’ আন্দোলনের জন্য বাস চলাচল বন্ধ ছিলো। আমরা পটুয়াখালী থেকে লঞ্চে এসেছিলাম। আমাদের ঢাকা ত্যাগের গল্প ছিলো চার রাত তিন দিন। আর তারপর সকালে আমরা সদরঘাট নেমে যে যার পথে। কিন্তু আমার ভ্রমণ শেষ হয়েছিল আরও আগে। তখন কুয়াকাটায় দ্বিতীয় রাত।

শেষ সন্ধ্যায় মাসুমের তোলা একটি মাস্টার পিস।

সমুদ্র দেখা শেষ করার আগে যখন বাতাস ঘিরে ধরে মানুষের অবয়ব। ঠাণ্ডা লাগে। বিষন্ন মন আরও বেশি বিষন্ন হয়। তীব্র অভিমান হয় প্রিয় সেসব মানুষের প্রতি, যারা বোঝে হৃদয়ের কাছে মানুষ কতটা অসহায়; অথচ দিনের পর দিন সংসারের গান শোনে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিকেলের সেই নারীর কথা, যে হেসেছিলো প্রেমিকের চোখ দেখে। এমন সময় কবিতা পড়া যেতে পারে। নিঃসঙ্গ সে সময় কাছাকাছি বসে থাকা মানুষগুলোও দূরে যায়। যে যার নিজস্ব জগৎ নিয়ে কথা বলে। আমি শেষবার সমুদ্রকে এক নিঃশ্বাসে শুষে নেই আর  একটি শীতার্ত পাখির মতো কাঁপা-কণ্ঠে বলে উঠি “নারী তুমি কি বোঝোনা তার তিরিশ বছর কাল/ কুমারী থাকার অভিশাপ? বোঝো না কি/ তিরিশ বছর কত কাঁদায় যৌবন কোকিলের পাষণ্ড রোদন!”